বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইগুলো কেমন? কেমন এর মান, কীভাবে প্রকাশিত হয় এগুলো- এসব বিষয় জানানোর জন্য হুমায়ুন আজাদের লেখা “বাংলা একাডেমি বই: নকল, ভুল, ও বিকৃত অনুবাদের উৎসব’ শিরোনামের প্রবন্ধ থেকে কিয়দংশ নিম্নে প্রদান করা হলো :
“বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ (১৯৮৮) বইটি হাতে নিয়েূ স্তম্ভিত হ’তে হয়; কিছুতেই বোঝা যায় না এ-তুচ্ছ বইটির জন্য পাঁচজন প্রবীণ সম্পাদকের কেনো দরকার পড়লো, আর তাঁরাই বা কী করলেন? তারা প্রবীণ, কিন্তু কেউ ভাষাবিজ্ঞানী নন, ভাষার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ, শুদ্ধ-অশুদ্ধতা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা এত পুরোনো যে এখন অচল। বইটিতে সাম্প্রতিক অপপ্রয়োগের কোনো উদাহরণ পাওয়া যায় না, যে-সব উদাহরণ বিভিন্ন বইপুস্তকে পাওয়া যায়, তাই এখানে খণ্ডিতভাবে সংগৃহীত হয়েছে। বইটি শুদ্ধত-অশুদ্ধতা, প্রয়োগ-অপপ্রয়োগক সম্পর্কে কোনা ধারণা দেয় না পাঠককে, যদিও অপধারণা দেয় অনেক। বইটির ‘প্রসঙ্গ কথা’য় মহাপরিচালক নিজেই অপপ্রয়োগ করেছেন দুটি শব্দ : একটি ‘সচেতনতা’, অন্যটি ‘অনস্বীকার্য’। দুটিই ভুল শব্দ, তবে প্রথমটিকে মেনে নেয়া গেলেও দ্বিতীয়টিকে মানা যায় না। বইটিতে ফলশ্রুতি (পৃ ৩৭) সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আভিধানিক অর্থ পুণ্যকর্ম করলে যে ফল হয় তার বিবরণ বা তা শোনা।’ আসলেই কি এর অর্থ এই? শব্দটি তো মূলত ‘শ্রুতিফল’, যার অর্থ ‘বেদ প্রভৃতি পুণ্যগ্রন্থের পাঠ শোনার পুণ্য’, অর্থাৎ ‘শ্রুতির ফল’। ‘শ্রুতিফল’ বিপর্যয়গ্রস্ত হয়ে হয়েছে ‘ফলশ্রুতি’, এখন ফলাফল অর্থে, নিরর্থকভাবে, ব্যবহৃত হয়। বইটিতে ‘অংক’ (পৃ ৩৯) বানানকে অশুদ্ধ ব’লে নির্দেশ করা হয়েছে, তবে একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধান-এ ‘অংক’ বানানটিই আছে প্রথম। ‘অংক’ বানানকে এখনো যারা ভুল মনে করেন তারা খুবই ভুল জগতে আছেন। বইটিতে ‘প্রচার-মাধ্যমে ভাষার অপপ্রয়োগ ’ অংশে কিছু অশুদ্ধ উদাহরণের শুদ্ধ রূপ দেখানো হয়েছে। কতো তারিখের কোন পত্রিকা থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে, তা দেখানো হয়নি ব’লে উদাহরণগুলোকে মনে হয় বানানো। এগুলো বিশৃঙ্খল উদাহরণ মাত্র; সাম্প্রতিক বাক্যিক অপপ্রয়োগের কোনো সূত্র উদ্ঘাটনের চেষ্টা এতে নেই।
বাংলা একাডেমীর কিছু বই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড়ো করা হয়েছে, সম্ভবত সম্মানীর জন্যে; ওই বইগুলো হ’তে পারত প্রকাশিত আকারের অর্ধেক।
আইনের কিছু বই চোখে পড়ে, যাতে অপ্রয়োজনীয় কথা পাতার পর পাতা বলা হয়েছে, উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে বড়ো বড়ো; একটি বইতে, শুনেছি বাঙলাদেশের পুরো সংবিধানটিই ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। সংগীতকোষ(১৯৮৭), আধুনিক ভাষাতত্ত্ব (১৯৮৫), বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (১৯৮৪) ও আরো অনেক বই রয়েছে বাংলা একাডেমীর, যেগুলোকে বলা যায় ফাঁপা বই। কিছু বই আছে, লেখক হিশেবে যাদের নাম ছাপা হয়েছে প্রচ্ছদে ও ভেতরে, তাঁরা লেখক নন, সংকলক মাত্র। সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত (১৯৮৫), উনিশশতকে বাংলাদেশের সংবাদসাময়িকপত্র (১৯৮৫) প্রভৃতি সংকলিত গ্রন্থ; সংবাদপত্র থেকে নকল ক’রে, আজকাল প্রতিলিপিযন্ত্রের কল্যাণে যান্ত্রিকভাবে এমন বই উৎপাদন করা যায়। এমন বইয়ের প্রচ্ছদে ও ভেতরে সংকল হিশেবে নাম থাকা উচিত সংকলনকারীদের, কিন্তু বাংলা একাডেমীর বইতে তাঁদের নাম আছে লেখক হিসেবে। সম্মানীর জন্যে এ-ব্যবস্থা করা হয়েছে হয়তো।
বাংলা একাডেমীর খুব কম বইই মূল্যবান। অধিকাংশ বইই তুচ্ছাতিতুচ্ছ চিন্তার প্রকাশ, অসংখ্য বই ইংরেজি বইয়ের— এমনকি বাঙলা বইয়ের নকল; কিন্তু লেখকরা তা স্বীকার করেন নি। তাঁরা নকল করেছেন, বিশৃঙ্খলভাবে অনুবাদ করেছেন, অনেকে ইংরেজি না বুঝেই অনুবাদ করেছেন, এবং বই হয়ে উঠেছে ভয়াবহ। যদি পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকে, তবে তা অবিলম্বে পরিত্যাজ্য; ভুল পাঠ্যবই এইডসের থেকেও ক্ষতিকর। অনুবাদ কতোটা ভুল, বিকৃত হ’তে পারে, তা বাংলা একাডেমীর কিছু বই না দেখলে বিশ্বাস হয় না।”
উদ্ধৃতি : হুমায়ুন আজাদ; উৎস : সীমাবদ্ধতার সূত্র, বাংলা একাডেমীর বই: নকল, ভুল, ও বিকৃত অনুবাদের উৎস, চতুর্থ মুদ্রণ; পৃষ্ঠা ১৩৫, ১৩৬; আগামী প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা।