বাংলা বাঙালা বাঙ্গালা

. মোহাম্মদ আমীন

বাংলা বাঙালা বাঙ্গালা

বৈয়াকরণদের বিশ্লেষণে জানা যায়, ‘বঙ্গ’ শব্দ থেকে বাঙ্গালা ও বাঙালি শব্দের উদ্ভব। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণেও অভিন্ন বিষয় ওঠ আসে। অনেক বছর আগে, মূলত ভাষা ও জাতি অর্থে ‘বাঙ্গালা’ এবং ‘বাঙ্গালি’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়। কালক্রমে তা হয়ে দাঁড়ায় বাঙলা, বাঙালি এবং আরও পরে বাংলা শব্দে এসে স্থিতি লাভ করে। আ-কার থাকায় জাতি অর্থ প্রকাশে অনুস্বার বাদ দিয়ে ‘বাংলা’ শব্দটিকে ‘বাঙালি’ লেখা হয়। কারণ, অনুস্বারে স্বরচিহ্ন যুক্ত করার নিয়ম নেই। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অনুস্বার (ং) অনুমোদন করেননি। তিনি নিজে বিভিন্ন সময়ে বাঙ্গালা, বাঙ্গলা ও বাঙ্লা লিখেছেন। কখনো ‘বাংলা’ লেখেননি। তিনি বলেছেন, “সঙ্গতি রাখিবার জন্য অনুস্বার দিয়া বাংলা না লিখিয়া চলতি ভাষায় বাঙলা (বাঙ্‌লা) লেখাই ভাল।”

বঙ্গ শব্দের উদ্ভব ঘটেছে বঙ্গা থেকে। বঙ্গা অর্থ সূর্য। আর্য তো দূরের কথা দ্রাবিঢ়দেরও পূর্বে এদেশের মানুষ বঙ্গাকে দেবতা হিসেবে মান্য করত। তখন কোনো

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

ধর্ম বা ধর্মীয় বিধি-বিধানের সৃষ্টিও হয়নি। সূর্যকে অনেক দেশে দেবতা হিসেবে গ্রহণ করলেও তাদের বহু পূর্বে এদেশের মানুষ বিশ্বের মধ্যে প্রথম বঙ্গা অর্থাৎ সূর্যকে দেবতারূপে স্বীকার করেছে। এজন্য গবেষকেদের ধারণা বঙ্গা থেকে দেশের নাম হিসেবে বঙ্গ শব্দের উদ্ভব। এতদ্‌ঞ্চলের আদি ভাষা ছিল প্রাকৃত। তাকে সংস্কার করে হয়েছে সংস্কৃত। সুতরাং সংস্কৃত আলাদা কোনো ভাষা নয়। বাংলা ভাষারই একটি পণ্ডিতি রূপ মাত্র। প্রাকৃত তথা বাংলা থেকে সৃষ্ট সংস্কৃত ভাষাটি পণ্ডিতদের দখলে থাকায় সাধারণ মানুষ তাকে প্রত্যাখান করেছে। সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য বর্জন করে দেশি-বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটানোর রেওয়াজ শুরু করেন। ভাষা যেহেতু গণমানুষের তাই তাদের প্রয়োগরীতিকে অস্বীকার করা যায় না। তাই ভাষায় পরিবর্ত অনিবার্য। বাংলা সেই অনিবার্যতার একটি মনোরম ও সর্বজনীন রূপ। প্রসঙ্গক্রমে সুভাষ ভট্টাচার্য এই অভিমতন ব্যক্ত করেছেন যে, এই সংগতি অনিবার্য নয়। বাংলায় এমন বহু শব্দ আছে, যা বর্তমানে অনুস্বার দিয়ে লেখা হলেও, আ-কার, এ-কার প্রভৃতি যোগ হলে ‘ঙ’ এসে যায়। যেমন : রং থেকে রঙের, ব্যাং থেকে ব্যাঙাচি; বাংলা ও বাঙালির ক্ষেত্রেও তেমন ঘটলে তাতে আপত্তির কারণ নেই।”

বাংলা শব্দটি শুধু ভাষা বা জতি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। অনেকে উপাধি হিসেবেও ব্যবহার করে থাকেন। আমার এক বন্ধুর নাম হিরু বাঙালি। বাংলাদেশের অনেক গ্রামের নাম আছে বাংলাগ্রাম,বাংলাপাড়া ইত্যদি। আর্মেনিয়ার মালাতিয়া সেবাস্তিয়া জেলার একটি ছোটো এলাকার নাম বাংলাদেশ। আর্মেনীয়রা যখন এ দেশে খুব প্রভাবশালী ছিল সেই সপ্তদশ শতকে অনেক বাঙালি তাদের আর্মেনীয় বসের কারণে যাতায়াতের সুবাদে ওখানে বসতি গড়ে তুলেছিল। তাই এলাকটির নাম হয় বাংলাদেশে। অনেকে মনে করেন, এটি বিশ্বের প্রথম বাংলাদেশ নাম। রং শব্দের বানান একসময় রঙ্গ (রঙ) লেখা হতো। অনেক শব্দের ‘ঙ্গ’ পরবর্তী কালে ‘ঙ’ হয়ে গিয়েছে। যেমন : কাঙ্গাল কাঙাল, সঙ্গিন সঙিন, রঙ্গিন রঙিন, ভাঙ্গা ভাঙা, ডাঙ্গা ডাঙা প্রভৃতি। ‘সং’ বানান সম্পর্কে অনেকের আপত্তি থাকলেও সঙ, রঙ, ঢঙ প্রভৃতি অপেক্ষা সং রং এবং ঢং এখন অধিক প্রচলিত ও জনপ্রিয়। সুনীতিকুমার এবং মুহম্মদ আবদুল হাই অনুস্বারের প্রধান বিরোধী ছিলেন। আবদুল হাই লিখেছেন, “হরফ সংস্কারের সময় অনুস্বারকে বর্জন করা উচিত। অনুস্বারের সব প্রয়োজন ঙ মেটাতে পারে। ঙ-এর প্রয়োজন অনুস্বার মেটাতে পারে না।”

আবদুল হাই সাহেবের মন্তব্যের প্রতিমন্তব্যে সুভাষ ভট্টাচার্য লিখেছেন, “কিন্তু আবদুল হাইয়ের এই মন্তব্য সত্ত্বে বর্তমান ঝোঁক অনুস্বারের দিকেই।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম দিকে ‘বাঙ্গালা’ লিখতেন। পরে ‘বাঙলা’ এবং আরও পরে বিনা দ্বিধায় ‘বাংলা’ লিখেছেন। মণীন্দ্রকুমার ঘোষ লেখেন ‘বাংলা’। ‘বাংলা বানান’ নামের তাঁর একটি গ্রন্থও রয়েছে। চিন্তাহরণ চক্রবর্তীও লিখেছেন বাংলা। রাজশেখর বসু ‘বাংলা’ ও ‘বাঙলা’ দুইই লিখেছেন। এখন বাংলা সাহিত্যের খ্যাত-অখ্যাত সব সাহিত্যিকই ‘বাংলা’ লেখেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেও ‘বাংলা’ লেখা হয়েছে। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানেও বাংলা বানানকে প্রমিত নির্দেশ করা হয়েছে। সর্বোপরি, আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। বাঙলাদেশ নয়। সব প্রয়োজন মেটাতে পারে না বলে কোনো অক্ষরকে বাদ দেওয়ার জন্য হাই সাহেবের মন্তব্যকে অনেক বুদ্ধিজীবী হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ কোনো বর্ণ দিয়ে সব প্রয়োজ মেটানো যায় না।

বর্তমানে বাংলা শব্দটি এতই জনপ্রিয়, প্রচলিত এবং লেখ্যবান্ধব যে সুনীতিকুমারের আপত্তি অগ্রাহ্য হয়ে গিয়েছে। আবদুল হাই সাহেবের কথা হয়ে গেছে অপাঙ্‌ক্তেয়। বাংলা শব্দের কাছে বাঙ্গালা, বাংলা, বাঙ্গলা সবকটি শব্দ পরাজিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে ‘বাংলা’। আগে কী লেখা হতো সেটা গবেষণার বিষয় হতে পারে, প্রায়োগিক কিছু নয়। তা হলে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিমানে চড়ে আমাদের আটলান্টিক পাড়ি দিতে হবে। ভাষা জীবন্ত প্রকৃতির মতো। এর পরিবর্তন অনিবার্য। তাই পরিবর্তনকে গ্রহণ করাই জীবন্ত ভাষার বৈশিষ্ট্য। অতএব আমরা ‘বাংলা’র পক্ষে। 

#subach

Leave a Comment