এবি ছিদ্দিক, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
‘নারী’ শব্দটির অনেক সমার্থক শব্দের মধ্যে ‘বামা’ একটি। সংস্কৃত ‘বাম’ শব্দের সঙ্গে ‘আ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘বামা’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘বামা’ শব্দটির জন্য আরও অনেক অর্থ উল্লেখ রয়েছে। অভিধান অনুসারে ‘নারী’-র পাশাপাশি সুন্দরী নারী, দেবী দুর্গা ও
দেবী লক্ষ্মী অর্থেও ‘বামা’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে। প্রয়োজনে বিশেষণ হিসেবে ‘বিরুদ্ধাচারিণী’ কিংবা
‘অপ্রসন্না’ অর্থেও ‘বামা’ শব্দটি ব্যবহারে কোনো বাধা নেই। ‘বামা’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ উল্লেখ করা আমার লেখার
বিষয় নয়, “নারীর সমার্থক হিসেবে আমরা ‘বামা’ শব্দটি কেন ব্যবহার করি তথা
বামার একটি অর্থ ‘নারী’ কেন হল?” সেটিই হচ্ছে আমার মূল বিষয়। আমি ‘বামা’ শব্দটি প্রথম শুনেছিলাম মাধ্যমিক স্কুলে অধ্যয়নকালে। স্যার যখন প্রথম বার শব্দটি বলেছিলেন, তখন শব্দটি নিয়ে একটি ছোটোগল্পও বলেছিলে। গল্পটি ছিল নিম্নরূপ—
“বহুকাল পূর্বে মানুষ বর্তমানের মতো
বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক রীতি
মেনে বিয়ে করত না। তখনকার রীতি ছিল—
যদি কোনো জোয়ান পুরুষ কোনো যুবতী
নারীকে পছন্দ করে; একই নারী ঐ পুরুষকেও পছন্দ করে এবং উভয়ই একে অপরকে বিয়ে করতে রাজি থাকে, তবে ঐ পুরুষকে ঘোড়া ও তরবারি নিয়ে কনের বাড়িতে থেকে কনেকে ভাগিয়ে নিয়ে আসতে হতো। এই কাজটি করার সময় পুরুষ তথা বর সবসময় তার বাম হাতে হবু স্ত্রীকে আগলে রাখত এবং ডান হাতে তরবারি চালাত। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে গেলেও গাড়ির বাম পাশে হবু স্ত্রীকে বসিয়ে ডানপাশ থেকে কনেপক্ষের লোকজনের আক্রমণ প্রতিহত করতে হতো। যেহেতু কনে তথা নারীকে সবসময় বাম হাতে ধরে রাখা হতো বা বাম পাশে আগলে রাখা হতো, তাই নারীর আরেকটি নাম হয়ে গিয়েছিল ‘বামা’।”
স্যারের বলা গল্পটি আমি অনেক জায়গায়
খোঁজাখুঁজি করেছি, কিন্তু কোনো হদিস
পাইনি। তবে কোরান এবং বাইবেলেও বর্ণিত আছে— পুরুষ(আদম)-এর বাম পাঁজর দিয়ে নারী(হাওয়া)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল। আর সেই নারী দুর্বল বলে তার রক্ষার্থে বা তাকে আগলে রাখার প্রয়োজনবোধ থেকে
হয়তো পুরুষ তার বাম পাশে নারীকে আশ্রয়
দিয়ে থাকে। যার কারণে ভাষাগতভাবে নারীর অন্য একটি নাম হয়ে গিয়েছে ‘বামা’।
আর কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও মনোগতভাবে
বিপদে-আপদে, ঘরে-বাইরে এবং বিভিন্ন
সামাজিকতায় নারীকে পুরুষের বাম পাশে
রাখার রেওয়াজটা দেখতে পাওয়া যায়।
আর ডানপাশটা কিন্তু শক্তিমান ও জ্যেষ্ঠদের স্থান হিসেবে গণ্য। লক্ষ করার মতো বিষয় হচ্ছে, বাঙালি হিন্দুদের বিবাহ বা যে-কোনো শুভ কাজে মেয়েদের পুরুষের বাম পাশে বসা বাধ্যতামূলক। দেবীরাও সর্বদা দেবতাদের বাম পাশে অবস্থান করেন(রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তি দ্রষ্টব্য)। বাম-বিতর্কে আরও একটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে— নারীরা যাত্রার শুরুতে বাম পা স্বভাবতই আগে বাড়ায় এবং সেজন্যই তারা বামা। এসবের বাইরেও নারীদের যে পুরুষেরা সদা বাম পাশে রাখে, তা আমি অতি সহজেই বুঝতে পারি। পার্কে বলুন বা কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে; যখনই জোড়ায় জোড়ায়
কপোত-কপোতীদের চলতে দেখা পাই, তখনই খেয়াল করি কপোতী মহাশয়া প্রায়ই কপোত মহাশয়ের বাম পাশে অবস্থান করেন! বিষয়টি সবচেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করার অন্যতম উত্তম উপায় হচ্ছে কোনো রমণীর সঙ্গে রিকশায় চড়ে বসা। আমি নিজেও যখন আমার কোনো বোন বা আমার মায়ের সঙ্গে রিকশায় চড়ি, তখন নিজের অজান্তেই ডান পাশে বসি। যদি কখনো বা ভুলে বাম পাশে বসি, তবে মিনিট পার না হতেই পাশ বদলাতে হয়। তখনই বুঝে যাই, আরে! বামপাশ তো বামাদের জন্য! মেয়েদের বাম পাশে বসা নিয়ে নাকি রামকৃষ্ণ একবার তাঁর একশিষ্যকে বলেছিলেন, “নরেন
হল পুরুষ সিংহ। পুরুষেরা কখনো গাড়ির
বাম পাশে বসে না।” পরীক্ষার জন্য গাড়ি
ডাকা হলে নরেন গাড়ির ডান পাশেই বসেন।
ডান-বাম নিয়ে কথা না বাড়িয়ে মূল কথায় ফিরে আসা যাক। বলছিলাম, “সংস্কৃত ‘বাম’-র সঙ্গে ‘আ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘বামা’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। ‘বাম’ শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে ‘বিপরীত’ তথা ‘উলটো’। নারীজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ‘উলটো’ শব্দটি কেমন যেন মিলে যায়।
নারীদের উলটো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
নিয়ে শ্রী সতীশচন্দ্র ঘটক কয়েকটি চমৎকার
উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
“আমরা(পুরুষেরা) রোগ হলেই ডাক্তার ডাকি কিংন্তু তাঁরা(নারীরা) ততক্ষণ রোগ চেপে রাখেন যতক্ষণ না সে(রোগ) নিজে ধরা দেয়। আমাদের সন্তান যখন পরের সন্তানের কাছে অন্যায়ভাবে মার খায়, তখন আমরা পরের সন্তানের বাপ-মায়ের নিকট গিয়ে নালিশ করি। কিন্তু তাঁরা(নারীরা) পালিশ করেন নিজ সন্তানের
পৃষ্ঠদেশ এবং সঙ্গে সঙ্গে বলেন যে, ‘কেন
গেলি মারামারি করতে?'”
এমন অনেক উলটো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের
কারণে ‘উলটো’ অর্থে ‘বাম’ শব্দটি নারীর
সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে এবং অলংকার হিসেবে
‘আ’ প্রত্যয় পরিধান করে হয়ে গিয়েছে
‘বামা’!
‘বাম’ শব্দের আরও একটি অর্থ হচ্ছে ‘সুন্দর’। একজন পুরুষের কাছে পৃথিবীর
সবচেয়ে সুন্দর জিনিস ‘নারী’ ছাড়া আর
কীই-বা হতে পারে! তাই পুরুষ জাতি সুন্দর
‘বাম’-কে সুন্দরীতে পরিণত করার জন্য
শব্দটির শেষে একটি ‘আ’ প্রত্যয় লাগিয়ে
দিয়ে বানিয়ে দিল ‘বামা’! আবার একদল
ব্যক্তি বলেন, “আপনাদের জানা দেখছি মোটেও শুদ্ধ
নয়! শুনুন তবে— ‘নারী’ অর্থে ব্যবহৃত ‘বামা’ শব্দটি এসেছে
মূলত ইংরেজি ‘বাম(Balm)’ শব্দটি থেকে! যেহেতু বামের সংস্পর্শে মানুষ পরম
শান্তি পায় এবং নারীর সংস্পর্শেও পরম
শান্তি পায়, সেহেতু ইংরেজির ‘বাম’
শব্দটিতে কিছুটা মেয়েলি ভাব এনে পুরুষ মানুষেরা নারীদের ‘বামা’ ডাকা শুরু করে দিয়েছে।”
শেষের ব্যাখ্যাটি যে নিছক মজার ছলে দেওয়া, তা বোঝার জন্য শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন বলে মনে হয় না।
‘বামা’ শব্দটির এমন আরও অনেক মজার
মজার ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে। সবকটি
উল্লেখ করতে গেলে আমার লেখা ফুরাবে
না। তাই আমি এখানেই ইতি টানছি।
পুনশ্চ: শ্রদ্ধেয় ম্যানুয়েল ত্রিপুরা দাদা, শ্রীময়ী অনামিকা মুখার্জি দিদি, শ্রীযুক্তা শায়েরী ঘটক দিদি এবং শ্রীমান কেশব কুমার রায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তাঁদের মন্তব্যের মূল বিষয়টুকুও আমার বিবৃতিতে জুড়ে দিয়েছি।
সূত্র : শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
প্রয়োজনীয় লিংক