লক্ষ লক্ষ্য উপলক্ষ উপলক্ষ্য

ড. মোহাম্মদ আমীন

লক্ষ লক্ষ্য উপলক্ষ উপলক্ষ্য

আমার লক্ষ্য ছেলেটির প্রতি লক্ষ রেখে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া-এই উপলক্ষ্যে আজকের এ আয়োজন। উপরের বাক্যটি লক্ষ করলে বুঝবেন, ‘লক্ষ’ আর ‘লক্ষ্য’ অর্থে অভিন্ন নয়। মূলত ‘লক্ষ’ ও ‘লক্ষ্য’ দুটি ভিন্ন শব্দ। যেমন অর্থে তেমন বানানে। তবে উচ্চারণ অভিন্ন, তাই গন্ডগোলটা আরও বেশি হয়। শব্দ-দুটোর

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অর্থ, আচরণ এবং দ্যোতনাগত পার্থক্য রয়েছে।তেমনই পার্থক্য রয়েছে ‘উপলক্ষ’ আর ‘উপলক্ষ্যে’। সংখ্যাবাচক পদ হিসাবে ‘লক্ষ’ শব্দের বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। অঙ্ক বা সংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে সর্বদা ‘লক্ষ’ বসবে। যেমন : দশ লক্ষ টাকা দিয়ে গাড়িটা কেনা হলো। আবার ‘খেয়াল রাখা’ প্রকাশেও ‘লক্ষ’ ব্যবহার করা হয়। এটি তখন ক্রিয়াপদ। যেমন : আমার লক্ষ্য ছেলেটির প্রতি লক্ষ রেখে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া।‘লক্ষ’ করার যোগ্য বা ‘লক্ষ’ করার বস্তু অর্থে, অর্থাৎ বিশেষ্য ও বিশেষণে ‘লক্ষ’ই একমাত্র বানান। যেমন :  লক্ষ না-থাকায় লক্ষ টাকা বেহাত হয়ে গেল। অঙ্ক বা সংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে সর্বদা ‘লক্ষ’ বসবে।  যেমন :“যে মাটির বুকে লুকিয়ে আছ লক্ষ মুক্তি সেনা/ দে না, তোরা দে না, সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে না।”  আবার ‘খেয়াল রাখা’ প্রকাশেও ‘লক্ষ’ ব্যবহার করা হয়। এটি তখন ক্রিয়াপদ। যেমন : ছাত্রছাত্রীদের প্রতি ‘লক্ষ’ রাখো।

সংস্কৃত ‘লক্ষ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশেষ্যে খেয়াল করা, শতসহস্র সংখ্যা, লাখ এবং বিশেষণে শতসহস্র সংখ্যক, অসংখ্য, সংখ্যাতীত। এবার ‘লক্ষ’ শব্দের পদার্থ দেখা যাক:

  1. খেয়াল করা : শিশুটির প্রতি ‘লক্ষ’ রেখো।
  2. শতসহস্র সংখ্যা, লাখ : একশ হাজারে এক লক্ষ।
  3. অসংখ্য, সংখ্যাতীত : লাখ লাখ মানুষ পথে নেমে এসেছে।।

বিশেষ্য বা বিশেষণ হিসাবে ব্যবহার করা হলে ‘লক্ষ’ বানানে ‘য-ফলা’ (লক্ষ্য) ব্যবহার করতে হয়, কিন্তু ক্রিয়াপদ ও সংখ্যাবাচক পদ হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘য-ফলা’ ব্যবহার বিধেয় নয়। যেমন : নেতার লক্ষ্য দেশের উন্নয়নের প্রতি লক্ষ রাখা, কেবল নিজের প্রতি লক্ষ রাখা নয়। এই বাক্যে ‘লক্ষ্য’ পদটি কর্তার উদ্দেশ্য, তাক ও কাম্য বিষয়কে দ্যোতিত করছে। অন্যদিকে, ‘লক্ষ’ পদটি খেয়াল রাখা প্রকাশ করছে।  সাধারণত উদ্দেশ্য প্রকাশের জন্য ‘লক্ষ্য’ ব্যবহার করা হয়।যেমন :

“যদি লক্ষ্য থাকে অটুট,

বিশ্বাস হৃদয়ে; হবে হবেই দেখা, দেখা হবে বিজয়ে।”

‘লক্ষ্য’ শব্দের আভিধানিক অর্থ উদ্দেশ্য, তাক (target), কাম্য বস্তু বা বিষয় এবং বিশেষণে লক্ষণাশক্তির দ্বারা জ্ঞাতব্য, উদ্দিষ্ট, জ্ঞেয় প্রভৃতি। নিম্নের বাক্যসমূহে ‘লক্ষ্য’ শব্দের পদার্থ দেখুন:

  • উদ্দেশ্য : লক্ষ্য আমার বিসিএস।
  • টার্গেট : লক্ষভ্রষ্ট হয়েছে আঘাত।
  • তাক : সরকারের উদ্দেশ্য আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে শহরকে ভিক্ষুকমুক্ত করা।
  • কাম্য বস্তু বা বিষয় : উদ্দেশ্য অর্জনে পিছপা হওয়া চলবে না।

সংস্কৃত ‘উপলক্ষ্য’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে– উদ্দেশ্য, প্রয়োজন, অবলম্বন, ব্যাপদেশ, ঘটনাক্রম এবং বিশেষণে উদ্দিষ্ট, প্রয়োজনীয় প্রভৃতি। অর্থ হতে বোঝা যায়,

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

উপলক্ষ্য শব্দের সঙ্গে লক্ষ্য শব্দের অর্থগত মিল আছে এবং অনেক ক্ষেত্রে উভয় শব্দ সমার্থক। লক্ষ্য শব্দের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে উপলক্ষ্য লেখা যায়। যেমন : আমাদের উপলক্ষ্যে কেউ বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না। আমাদের লক্ষ্যে কেউ বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না।

উপলক্ষ্য = উপ + লক্ষ্য; লক্ষ্য এর উপ বা সহকারী যে; আশ্রয়, অবলম্বন, প্রয়োজন, উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, ব্যাপদেশ, ছল, ছুতা, occasion বা আয়োজন অর্থে

প্রচলিত। এসব অর্থ যেখানে নিহিত, সেখানে অবশ্যই উপলক্ষ্য হবে, উপলক্ষ নয়। উদ্দেশ্য ও উদ্দেশ শব্দের মতো ‘লক্ষ’, ‘লক্ষ্য’, ‘উপলক্ষ’ ও ‘উপলক্ষ্য’ শব্দের বানান এবং প্রয়োগ নিয়েও বিভ্রাট দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে ‘চক্ষু বা মনশ্চক্ষুর’ দ্বারা কোনও কোনও বস্তু বা বিষয়কে নিজের মধ্যে নেওয়া বা লওয়ার কাজটি দিশাগ্রস্ত থাকে যাতে, তাকে লক্ষ বলা হয়। এ লক্ষ যাতে থাকে সেটিই হচ্ছে লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীদের উদ্দেশে বললেন, সবার প্রতি লক্ষ রাখাই আমার লক্ষ্য।  সংগতকারণে উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য ভিন্ন অর্থ ধারণ করে। অনেকে লিখেন, “স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান।” এটি ভুল, শুদ্ধ হবে, “স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান।”

‘উপলক্ষ’ হচ্ছে ‘লক্ষ’ এর সহকারী অন্যদিকে ‘উপলক্ষ্য’ হচ্ছে ‘লক্ষ্য’ এর সহকারী। লক্ষ্য থাকলেই উপলক্ষ্য থাকতে পারে কিন্তু লক্ষ থাকলে উপলক্ষের সম্ভবান খুবই ক্ষীণ। সে কারণে ‘উপলক্ষ’ শব্দটির প্রয়োগ প্রায়শ ত্রুটিপূর্ণ হয়। তাই ‘উপলক্ষ’ শব্দটি না-লেখাই সমীচীন। বাংলাভাষীগণ শব্দটি যেভাবে প্রয়োগ করেন, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে শব্দটি আসলে ‘উপলক্ষ্য’কেই বোঝায়; ভুল বানানের কারণে সেগুলো ‘য’ফলাহীন হয়ে রয়েছে। এজন্য বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘উপলক্ষ’ শব্দটি রাখাই হয়নি।

লক্ষ্য উপলক্ষ্য নিয়ে এবার একটি কথোপকথন

জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত ফুটবলে ম্যাচে শান্তিনিকেতনের ছেলেরা আট-শূন্য গোলে জিতেছে। অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশি খেলোয়াড়দের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কক্ষের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন, লক্ষ্য ছেলেদের উৎসাহ প্রদান। 
খেলোয়াড়দের লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ  বললেন, কেমন হলো খেলা?
দলনেতা বলল, গুরুদেব, আমাদের দল জিতেছ। লক্ষ্য আমাদের অর্জিত হয়েছে।
কয়গোল দিয়েছ? রবীন্দ্রনাথ বললেন।
আমরা তাদের আট গোলে হারিয়ে দিয়েছি।
রবীন্দ্রনাথ দলনেতার কথা শুনে মুচকি হেসে বললেন, জিতেছ ভালো, তোমাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, উপলক্ষ্য সার্থক হয়েছে; তা বলে আট গোল কেন? এ কী করলে তোমরা!
গুরুদেব, কম হয়ে গেছে না কি? প্রমথনাথ বিশি জানতে চাইলেন।
রবীন্দ্রনাথ মুচকি হাসিটাকে মুখটি হাসিতে পরিব্যপ্ত করে বললেন, ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে, না কি।

#subach

উৎস

  • কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
  •  ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

Leave a Comment