শঙ্খনীল: শঙ্খ ও নীল শব্দের সমন্বয়ে শঙ্খনীল। শঙ্খ এমন একটা প্রাণী, যে তার পুরো শরীরকে কঠিন খোলসের মধ্যে লুকিয়ে রাখে এবং কোনোভাবে খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসতে পারে না। ওটাই তার সংসার, ওটাই তার বিস্তৃত নীল আকাশ, ব্রহ্মাণ্ড, ওখানে থাকে তার নীলকান্তমণি। শঙ্খের খোলস খুব শক্ত। সে নিজে ওই খোলসের মধ্যে এত দৃঢ়ভাবে আটকে থাকে যে কোনোভাবে তা ছেড়ে বের হয়ে আসতে পারে না। ওই খোলস কাঁধে নিয়ে চলাফেরা করতে হয় অতি ধীর গতিতে। তার সব আশ-ভরসা ওখানে নিহিত। নীল কথার শাব্দিক অর্থ রংবিশেষ। সুতরাং, শঙ্খনীল কথাটির শাব্দিক অর্থ নীল রঙের শঙ্খ । এর শাব্দিক অর্থ নীল রঙের শঙ্খ হলেও প্রায়োগিক ও আলংকারিক অর্থ ভিন্ন।
শঙ্খনীল কথার প্রায়োগিক অর্থ হচ্ছে: সুখের মোহ, শান্তির বাসনা আর সমৃদ্ধির প্রত্যাশা থাকে এমন, সংসার। কেন তার এমন অর্থ হলো দেখা যাক:
পুরাণ মতে, “শঙ্খ হচ্ছে সৃষ্টির প্রতীক। সৃষ্টির আদিতে যখন সমগ্ৰ চরাচর জলমগ্ন ছিল তখন বিষ্ণু সমুদ্রের নিচে শাঁখের আধারে অবস্থান করছিলেন। শঙ্খ থেকে উৎপন্ন শব্দ থেকে জীবজগতের সমস্ত প্রাণের সৃষ্টি। শঙ্খ সমুদয় সুখ শান্তি আর ঐশ্বর্যের আধার। দুর্গার বাম হাতে থাকে শঙ্খ। এটি সমুদ্রের দেবতা বরুণ দুর্গাকে প্রদান করেছিলেন।” অধিকন্তু, শঙ্খ হতে পাওয়া যায় মুক্তা। তাই শঙ্খ অতি মূল্যবান এবং পবিত্র।
শঙ্খনীল শব্দের সঙ্গে যুক্ত নীল কোনো বিশেষ রং নয়। এটি হচ্ছে অতি দামি পৌরাণিক নীলকান্ত মণি। নীলকান্তমণির নীলই হচ্ছে শঙ্খনীলের নীল। তাই শঙ্খনীল মহাপ্রত্যাশার বিষয়। সহজ কথায় শঙ্খনীল হচ্ছে মোহ বাসনা সুখ শান্তি, ঐশ্বর্য সমৃদ্ধি ও প্রত্যাশার উৎস। যা মানুষ সিদ্ধ বা অসিদ্ধ যে-কোনো উপায়ে পেতে চায়। এর সমার্থক শব্দ: সংসার। এটি এমন মোহ বাসনা ও বিরল প্রত্যাশা যা পাওয়ার জন্য মানুষ পৃথিবীর মতো নীল বিস্তৃত আকাশের সীমাহীন সৌন্দর্যকে অবলীলায় অবহেলা করে শামুকের মতো একটা ছোটো খোলসে আটকে থাকে, থাকতে বাধ্য হয়।
এখানে খোলস হচ্ছে সংসার আর নীল বা নীলকান্তমণি বা নীল হচ্ছে কোলসরূপী সংসারের সুখ। যা মানুষ পেতে চায়। আর না পেলে বেদনার মতো নীল হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মানুষ এই কোলস হতে মুক্তি পেতে চেষ্টা করে, কিন্তু মোহ বাসনা আর প্রত্যাশা তাকে মুক্তি দেয় না, বরং আরও প্রবল জোরো আটকে রাখে। যে সুখ পাওয়ার জন্য মানুষ সমস্ত সৌন্দর্য আর বিস্তৃত নীল আকাশকে অবহেলা করে। শেষ পর্যন্ত সুখের বদলে কষ্টের বেদনায় নীল হয়ে যায়। এভাবে সমাপ্তি ঘটে জীবনের। সে কখনো বের হতে পারে না। মুক্তি পায় কেবল মৃত্যুতে। প্রত্যাশিত সুখ পায় না। তবু পাওয়ার আশায় আটকে থাকে। এসমস্ত বৈশিষ্ট্য দেখা যায় মানুষের সুখ আর শান্তি পাওয়ার প্রচেষ্টা আর প্রত্যাশায়। এটিই হচ্ছে শঙ্খনীল।
অর্থাৎ শঙ্খনীল কথার অর্থ: সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির মোহ বাসনা প্রত্যাশা লোভ আর লালসা; সংসার।
জীবনানন্দ দাশ শঙ্খমালা কবিতায় লিখছেন:
কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে, বলিল, তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্নায়— সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক জোনাকির দেহ হতে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে— ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা: সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা— বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর, শিং-এর মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
কড়ির মতন শাদা মুখ তার, দুইখানা হাত তার হিম; চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায় সে-আগুনে হায়।
চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার; স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আৰ্দ্র— কবেকার শঙ্খিনীমালার; এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়না কো আর।