ড. মোহাম্মদ আমীন
মনির বাক্য রচনা করেছে, “আমরা সবাই বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র।” মনির এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। গৃহশিক্ষক মনিরের লেখা বাক্যটি কেটে দিয়ে বেশ কড়া করে ধমক দিয়ে বললেন, “বাঙালি হয়ে বাংলা জানো না, ছি! বাংলাটা তোমরা ডুবিয়ে ছাড়বে।
মনির বলল, স্যার, আমার ভুল হলো কোথায়?
গৃহশিক্ষক সাহেদ বললেন, তুমি একই সঙ্গে একই বিশেষ্যের জন্য দুটো বহুবচনজ্ঞাপক পদ ব্যবহার করেছ। ‘আমরা’ ও ‘সবাই’ এ দুটোর যে-কোনো একটি লেখাই হচ্ছে নিয়ম। এমন অশুদ্ধ বাক্যচয়ন পদ্ধতি তুমি কোন গর্দভের কাছে শিখেছ?
মনির বলল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে শিখেছি।
শিক্ষক বললেন, রবীন্দ্রনাথ এমন করতেই পারেন না। তিনি তোমার মতো গর্দভ নন, বিশ্বকবি, বাংলার সূর্য; বুঝলে?
মনির বলল, তিনি এমন ভুল করেছেন, আমি প্রমাণ দিতে পারি।
কোথায়? শিক্ষক বিস্মিত হয়ে বললেন।
“আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে…।”
শিক্ষক বললেন, এটা আর্ষপ্রয়োগ। কবিতার জন্য করেছেন। বৃহত্তর কল্যাণের জন্য অনেক ছোটো ছোটো কল্যাণকে বিসর্জন দিতে হয়। ধনী লোকদের শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য জন্য অনেক গরিব লোকের জায়গা অধিগ্রহণ করে নেওয়া হয়। ‘এক্ষুনি’ দিয়ে একটা বাক্য রচনা করো।
মনির লিখল, “আমরা দাঁড়িয়ে বলিলাম, এক্ষুনি বাহিরব।”
গৃহশিক্ষক সাহেদ এ বাক্যটাও কেটে দিলেন।
এটা কাটলেন কেন স্যার? মনির জানতে চাইল।
সাধুচলিত মিশ্রণ দূষণীয়। তুমি সাধুর সঙ্গে চণ্ডালকে এক পঙ্ক্তিতে বসিয়ে গুরুচণ্ডালী দোষ করেছ। আর ‘বাহিরিব’ এমন বিদঘুটে শব্দ কোথায় পেলে? এটা তো একটা ভয়ঙ্কর চণ্ডালীয় শব্দ। রবীন্দ্রনাথ শুনতে পেলে লজ্জা পাবেন, পাণিনি করবেন আত্মহত্যা। ছি ছি করবেন সুনীতিবাবু।
“কাঁপে আমার দিবানিশির সকল আঁধার আলা! নিত্য রবে প্রাণ-পোড়ানো গানের আগুন জ্বালা। ”
শিক্ষক বলল, কিন্তু তুমি সাধুচলিত মিশ্রণ করেছ কেন?
মনির বলল, কারণ, আমি রবীন্দ্রনাথ হতে চাই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “ভাবিতেছিলাম উঠি কি না উঠি/ অন্ধ তোমার গেছে কি না ছুটি।” লাইন দুটো রবীন্দ্রনাথের ‘সুপ্রভাত’ কবিতার। এখানে সাধু চলিত মিশ্রণ আছে- এটাও গুরুচণ্ডালী। আর একটা বলব?
বলো, শিক্ষক বললেন।
“তুমি পড়িতেছ হেসে, তরঙ্গের মতো এসে, হৃদয়ে আমার।” আরও বলব স্যার।
বলো।
“আকাশে তো আমি রাখি নাই , মোর উড়িবার ইতিহাস/ তবু, উড়েছিনু এই মোর উল্লাস।” আরও বলব স্যার।
শিক্ষক বললেন, আর বলতে হবে না। ব্যাকরণ হচ্ছে ভাষার সংবিধান, ভাষার আইন। এটি মেনে ভাষাপ্রশাসন চালাতে হয়।
মনির বলল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ভাষা প্রশাসন এবং ভাষার আইন ভঙ্গ করলেন কীভাবে?
শিক্ষক বললেন, শোনো তাহলে – “রবীন্দ্রনাথ একটা কবিতায় লিখেছিলেন, ‘বনবেতসের-বাঁশিতে-’বা এ রকম একটা লাইন। যাতে ‘বনবেতসের বাঁশিতে’ বাগ্ভঙ্গিটি ছিল।
চারুচন্দ্র চমকে উঠে বলেছিলেন, গুরুদেব, বেতস তো বাঁশ নয়, বেত। ও দিয়ে তো বাঁশি তৈরি হয় না।
রবীন্দ্রনাথ একটু ভেবে অক্ষরটা কাটতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নিয়ে বলেছিলেন, আজ থেকে বেতসের বিকল্প অর্থ বেত হবে।
চারুচন্দ্র বলেছিলেন, তা মানলাম কিন্তু বেত দিয়ে বাঁশী কীভাবে বানাবে?
রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিয়েছিলেন, এটা আমার কাজ নয়। এটা বাঁশরীর কাজ। আমার কাজ আমি করে ফেলেছি। বাঁশ থেকে বাঁশী হলে বেত থেকেও হবে।”
মনির বলল, স্যার, এ তো রীতিমতো সন্ত্রাস। ক্ষমাতসীন দলের পোলপানরা করে। রবীন্দ্রনাথ করতে গেলেন কেন?
শিক্ষক বললেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের রাজাধিরাজ, তিনিই প্রেসিডেন্ট, তিনিই সম্রাট, তিনিই ভাষা, তিনিই আইন; তিনিই আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও ভাষা সংবিধানের স্রষ্টা। যিনি বানিয়েছেন তিন ভাঙতে পারেন। তার গড়ার ক্ষমতা আছে, তাই ভাঙলে অসুবিধা নেই। বিখ্যাতরা দু একটা ভুল করতে পারেন।
মনির বলল, বিখ্যাতরা করতে পারলে আমি করতে পারব না কেন?
গৃহশিক্ষক সাহেদ বললের, আমাদের দেশের রাজনীতি আর প্রশাসনে প্রভাবশালীরা সংবিধান আর নিয়ম না- মেনে আইন, বিচার আর প্রশাসনের উপর যেভাবে হস্তক্ষেপ করে তা কি আমি করতে পারব?
না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্ররা সকল আইন ও প্রশাসনের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে যা নীরিহদের ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে মেরে মেলতে পারে, তা কি তুমি করতে পারবে?
না। কিন্তু তারা পারছে, আমি কখন পারব?
বিখ্যাত হয়ে যাও। রবীন্দ্রনাথের মতো নোবেল পুরস্কার অর্জন করো। তারপর – – -।
শিক্ষকের কথা শেষ হওয়ার আগে পড়ার রুমে ঢুকলেন মনিরের বাবা ইসলাম সাহেব। তিনিও শিক্ষক, বাংলার প্রফেসর। বাবাকে দেখে মনির বলল, পাকিস্তনের অধিবাসীদের কী বলা হয়?
পাকিস্তানি।
জাপানের অধিবাসীদের কী বলা হয়?
জাপানি।
বাংলাদেশের অধিবাসীদের কী বলা হয়?
বাংলাদেশি।
কাবুলের অধিবাসীদের কী বলা হবে?
কাবুলি।
হয়নি। কাবুলের অধিবাসীদের বলা হয় কাবুলিওয়ালা।
চুপ, এমন আজেবাজে বাক্য বলবে না।
মনির বলল, রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্প পড়োনি? রহমত কাবুলের লোক ছিলেন। তাই রবিঠাকুর তাকে কাবুলিওয়ালা বলেছেন।
মনিরের বাবা বললেন, তিনি বলতে পারবেন। কারণ তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
মনির বলল, আমিও বলব- বাংলাদেশিওয়ালা, জাপানিওয়ালা, নেপালিওয়ালা; কারণ আমিও নোবেল পুরষ্কার পেতে চাই।
প্রফেসর ইসলাম বললেন, কিন্তু তার আগে নোবেল পুরস্কার পেয়ে নাও।
মনির বলল, বাবা, নোবেল পুরস্কার আগে না কি কাবুলিওয়ালা আগে? আচ্ছা বাবা, নোবেল পুরস্কার পেলে কী ভাষা নিয়ে, ব্যাকরণ নিয়ে যা ইচ্ছে তা করা যায়?
ইসলাম সাহেব বললেন, রাজনীতিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তি যদি রাজনীতিতে যা ইচ্ছে তা করতে পারেন, প্রশাসনে ক্ষমতাধর ব্যক্তি যদি প্রাশাসনিক ক্ষেত্রে যা খুশি তা করতে পারেন তা হলে ভাষা ও সাহিত্যে ক্ষমতাধর রবীন্দ্রনাথ কেন করতে পারবেন না? শোনো বাবা, প্রত্যেক জায়গায় সন্ত্রাস আছে,সন্ত্রাসী আছে। এমনকি বুয়েটেও।
আপনি কী বলতে চাইছেন, রবীন্দ্রনাথ একজন সন্ত্রাসী?
নয় তো কী? ইগো, স্বার্থ আর জেদ প্রভৃতি সন্ত্রাসের উপাদান। সুনীতিকুমার ছিলেন ঈ-কার ভক্ত, আবার রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ই-কার ভক্ত। কেউ ‘সাদা’ আবার কেউ লিখতেন ‘শাদা’; কেউ বলেন ‘ণ’ লাগবে না, আবার কেউ কেউ বলেন, এতগুলো (স ষ শ) দিয়ে কী করব? জ নিয়েও বেজায় আপত্তি। একটা জ হলেও চলে; ঈ এবং ঊ বাদ দেওয়া হয় না কে? আসলে, নিজেদের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে বাংলাটা অনেক আগে থেকে ডুবিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আমরা কেবল গুরুদের অনুসরণ করে যাচ্ছি।
বাবা, বাকটা রুদ্ধ করুন, মনির বলল।
কেন? চমকে উঠে জানতে চাইলেন প্রফেসর ইসলাম সাহেব।
মনির বলল, সত্য কথা বললে মরতে হয়। আপনি যে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন মন্তব্য করছেন, এটি তাঁর ভক্তরা জানতে পারলে আপনাকে রুমে নিয়ে গিয়ে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। আপনাকে মেরে ফেললে আমি ‘বাবা’ কাকে ডাকব, বাবা?
মনিরের বাবা বাংলার প্রফেসর ইসলাম সাহেব বললেন, যেসব পিতার সন্তানেরা সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছে তাদের তুমি বাবা ডাকবে।