ড. মোহাম্মদ আমীন
আল্লাহ খোদা ঈশ্বর, গড ভগ ভগবান, কোরআন নামাজ রোজা হজ, রমজান শহিদ মুরুব্বি, মহকুমা
আল্লাহ, খোদা, ঈশ্বর, গড। ভগ ও ভগবান
ঈশ্বর: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে সংস্কৃত ঈশ্বর (√ঈশ্+বর) শব্দের দুটি পৃথক ভুক্তি রয়েছে।
প্রথম ভুক্তিমতে, ঈশ্বর অর্থ (বিশেষ্যে) আল্লাহ, খোদা, বিধাতা, সৃষ্টিকর্তা, স্রষ্টা, God।
দ্বিতীয় ভুক্তিমতে, ঈশ্বর অর্থ (বিশেষ্যে) অধিপতি, প্রভু; প্রণয়ী, হৃদয়েশ; গুরু, দেবতার স্থান বা তীর্থক্ষেত্র জ্ঞাপক চিহ্নবিশেষ ‘ ঁ ‘ এবং (বিশেষণে) শ্রেষ্ঠ, প্রধান।
ভগ: সংস্কৃত (√ভজ্+অ) অর্থ (বিশেষ্যে) ছয়টি ঐশী গুণ (ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য); সৌভাগ্য, সৌন্দর্য, মাহাত্ম্য, ধর্ম, মোক্ষ। যোনি (ভগাঙ্কুর), মলদ্বার (ভগন্দর)। চাঁদ, সূর্য।
ভগবৎ: সংস্কৃত ভগবৎ (ভগ+বৎ) অর্থ (বিশেষ্যে) ভগবান, ঈশ্বর।
ভগবান: সংস্কৃত ভগবান (ভগ+বৎ) অর্থ (বিশেষ্যে) যিনি ষড়গুণের অধিকারী, পরমেশ্বর; (বিশেষণে) পূজ্য। স্ত্রীলিঙ্গে ভগবতী।
অতএব, ঈশ্বর ও ভগবান এক নন। দটি ভিন্ন সত্তা। ভগবান অনেক হতে পারেন, ঈশ্বর কিন্তু অদ্বিতীয়।
কুরআন, কোরআন, কোরান: কোনটি শুদ্ধ বানান
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে কুরআন, কোরআন, কোরান— তিনটি বানানকে তিনটি পৃথকভুক্তিতে শুদ্ধ হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, কুরআন, কোরআন ও কোরান অর্থ (বিশেষ্যে) হজরত মুহম্মদ (সা.) কর্তৃক আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত ঐশীবাণী সম্বলিত গ্রন্থ, ১১৪টি সুরা বা অনুচ্ছেদে বিভক্ত ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মূল ধর্মগ্রন্থ; কোরানশরিফ, কুরআন এবং কোরান এর বানান ভেদ।
রোজা রমজান
রোজা: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, ফারসি রোজা অর্থ (বিশেষ্যে) ইসলামধর্মীয় বিধি অনুসারে (প্রধানত হিজরি পঞ্জিকার রমজান মাসে) সূর্যোদয়ের সামান্য পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার বর্জন ও কামপ্রবৃত্তি দমনরূপ কৃচ্ছ্রতাসাধন। যারা রোজা রাখেন তাদের রোজাদার বলা হয়।
প্রয়োগ: আল্লাহ আমার রোজা কবুল করুন।
রোজা রাখা:রোজা রাখা অর্থ ইসলামধর্মীয় বিধি অনুসারে (প্রধানত হিজরি পঞ্জিকার রমজান মাসে) সূর্যোদয়ের সামান্য পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার বর্জন ও কামপ্রবৃত্তি দমনরূপ কৃচ্ছ্রতাসাধনব্রত পালন করা।
প্রয়োগ: রোজারাখা ফরজ।
রোজা বানানে জ, এটিই প্রমিত বানান। অনুরূপ: রোজাদার, রোজ হাশর, রোজনামা, রোজনামচা, রোজকার, রোজগার, রোজগারি, রোজগেরে। এগুলো ফারসি শব্দ।
রমজান: আরবি রমজান অর্থ (বিশেষ্যে) হিজরি বর্ষপঞ্জির নবম মাস; যে মাসব্যাপী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কৃচ্ছসাধন এবং সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিরম্বু উপবাসব্রত পালন করতে হয়।
প্রয়োগ: ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির – – – (নজরুল)।
ব্যাবহারিক না কি ব্যবহারিক
প্রসঙ্গ: ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. থেকে সদ্যপ্রকাশিত ‘ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র’ গ্রন্থের ‘ব্যাবহারিক’ বানান।
‘ব্যবহারিক’ নয় কেন, কেন ‘ব্যাবহারিক’? বাংলা ব্যাকরণমতে, প্রারম্ভে ‘অ-কার’-যুক্ত কোনো শব্দের সঙ্গে ‘ইক-প্রত্যয়’ যুক্ত হলে সাধারণত ওই শব্দের বানানের প্রথম বর্ণের ‘অ-কার’ পরিবর্তিত হয়ে ‘আ-কার’ হয়ে যায়। যেমন:
অর্থ+ইক= আর্থিক।
বর্ষ+ইক= বার্ষিক।
পরিশ্রম+ইক= পারিশ্রমিক।
নন্দন+ইক= নান্দনিক।
সময়+ইক= সাময়িক।
তেমনি, ব্যবহার+ইক= ব্যাবহারিক।
আগে ‘ব্যবহারিক’ বানান প্রমিত ছিল, তৎসঙ্গে ‘ব্যাবহারিক’ বানানও প্রমিত হিসেবে অভিধানে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে, ‘ব্যবহারিক’ বানানটি অধিক প্রচলিত ছিল। কিন্তু, বাংলা একাডেমির সর্বশেষ অভিধান (প্রথম প্রকাশ: ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ) ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ গ্রন্থে একমাত্র ‘ব্যাবহারিক’ শব্দকে প্রমিত করা হয়েছে; ‘ব্যবহারিক’ শব্দকে ওই অভিধানে স্থানই দেওয়া হয়নি। অতএব, বাংলা একাডেমি হতে প্রকাশিত সর্বশেষ অভিধানমতেে, এই প্রসঙ্গে একমাত্র প্রমিত বানান হলো, ‘ব্যাবহারিক’।
শহিদ শহিদ মিনার ও শহীদ
শহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নির্মিত মিনার বা শহিদদের নিমিত্ত মিনার বা শহিদের স্মরণে মিনার— প্রভৃতি অর্থ প্রকাশের জন্য ‘শহিদমিনার’ বা ‘শহিদ মিনার’ কথাটি ব্যবহার করা হয়।
অনেকে বলেন— সমাসবদ্ধ শব্দে ফাঁক রাখা যায় না। তাই ‘শহিদ মিনার’ কথাটি শুদ্ধ নয়। শুদ্ধ হবে ‘শহিদমিনার’ বা ‘শহিদ-মিনার’। তাই তারা মনে করেন ‘শহিদ মিনার’ অশুদ্ধ। আসলে কি অশুদ্ধ? না, ‘শহিদ মিনার’ কথাটি অশুদ্ধ নয়, বরং ব্যাকরণগতভাবে সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও প্রমিত। এবার দেখা যাক তার কারণ:
সমাসবদ্ধ পদ একসঙ্গে লিখতে হয়, এটি সত্য— তবে সবসময় নয়? কখন? “উচ্চারণ, অর্থদ্যোতকতা ও শ্রুতিমাধুর্য বিবেচনায় যখন সুবিধা মনে হয়, তখন। নতুবা, ফাঁক রেখে লেখাই বিধেয়, এটিই বাংলার বৈশিষ্ট্য।”
বাংলা ব্যাকরণে অসংলগ্ন সমাস বলে একটি কথা আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “সমাসবদ্ধ পদ অসংলগ্নভাবেও লেখা যায়। অসংলগ্নভাবে লেখা হলেও তা সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে গণ্য হয়।” বাংলায় সমাসের প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে ইচ্ছা-নির্ভর বিষয়। ‘জয় বাংলা’ কথাটিকে অভিধান যতই সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে ‘জয়বাংলা’ বলুক না কেন—, ‘জয় বাংলা’ লিখলে ব্যাকরণগতভাবে কিংবা অর্থ ও শ্রুতিমাধুর্য প্রকাশে কোনো বিঘ্ন হয় না, বরং শ্রতিমাধুর্য বৃদ্ধি পায়।
‘বিজয়দিবস’ আর ‘বিজয় দিবস’, উভয় ধারাই শুদ্ধ ও ব্যাকরণসম্মত। প্রথমটি— ‘সংলগ্ন সমাস’ এবং দ্বিতীয়টি ‘অসংলগ্ন সমাস’। তেমনি শুদ্ধ- নিখিল বাংলা চিরন্তন আকালি যুব সংহতি সমিতি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম সমিতি প্রভৃতি।
সুতরাং, ‘শহিদ মিনার’ ও ‘শহিদমিনার’ দুটোই শুদ্ধ, প্রমিত এবং ব্যাকরণসম্মত। অধিকন্তু, প্রচলন ও জনপ্রিয়তার দিকে এগিয়ে আছে ‘শহিদ মিনার’। অতএব, নির্দ্বিধচিত্তে লিখুন— ‘শহিদ মিনার’।
আল্লাহ শব্দের বাংলা
আল্লাহ আরবি শব্দ। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে,
আল্লাহ শব্দের অর্থ (বিশেষ্যে) “পবিত্র কোরানে বর্ণিত নিরাকার পরমেশ্বর ও বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা এবং এক ও অদ্বিতীয় সত্তা; জীবজগতের প্রভু ও রক্ষাকর্তা, যিনি পাপীকে শাস্তি দেন ও পুণ্যবানকে পুরস্কৃত করেন, খোদা, সৃষ্টিকর্তা।”
আল্লাহ শব্দের অর্থ (বিশেষ্যে) “পবিত্র কোরানে বর্ণিত নিরাকার পরমেশ্বর ও বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা এবং এক ও অদ্বিতীয় সত্তা; জীবজগতের প্রভু ও রক্ষাকর্তা, যিনি পাপীকে শাস্তি দেন ও পুণ্যবানকে পুরস্কৃত করেন, খোদা, সৃষ্টিকর্তা।”
একই অভিধানমতে, আরবি মওলা আল্লাহর সমার্থক। মওলা শব্দের অভিধান নির্দেশিত অর্থ (বিশেষ্যে)— আল্লাহ, প্রভু এবং ফারসি খোদা অর্থ— আল্লাহ, বিধাতা, ঈশ্বর।
অতএব, আল্লাহকে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো একক শব্দে বলতে হলে বলা যায়— মওলা, খোদা, সৃষ্টিকর্তা। যদিও আল্লাহ ছাড়া আর কোনো শব্দ দিয়ে আল্লাহকে বর্ণনা করা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কারণ, আল্লাহ শব্দটি অদ্বিতীয় নাম হিসেবে পবিত্র কোরান নির্দেশিত গুণাবলি বহন করে। তাই আল্লাহ’কে আল্লাহ বলাই সর্বোত্তম। এটিই তাঁর নাম।
আরবি রহিম অর্থ দয়ালু। রহিম মিয়া নামের কোনো ব্যক্তিকে কি আমরা দয়ালুমিয়া ডাকি? বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, চায়নিজ, জাপানি, নাইজার-কঙ্গো, আফ্রো-এশীয়, নাইলো-সাহারান, খোইসান, ফারসি, সেমীয়, স্প্যানিশ, ফরাসি, গ্রিক, লাতিন, পোর্তুগিজ, রাশিয়ান, আরবি, উর্দু, কোরিয়ান, পশতু, গ্রিক, তামিল, মালে, ম্যান্ডারিন, বার্মিজ, মুন্ডা যে ভাষাতেই হোক না, আল্লাহ শব্দের সর্বোত্তম অর্থ— আল্লাহ।
মুরুব্বি ও মুরুব্বিআনা
মুরুব্বি আরবি উৎসের শব্দ। এর অর্থ— (বিশেষ্যে) অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক, রক্ষক, উপদেষ্টা। সাধারণভাবে বাংলায় মুরুব্বি শব্দটি গুরুজন; শ্রদ্ধাভাজন, প্রবীণ প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
মুরুব্বিআনা: আরবি ‘মুরুব্বি’ শব্দের সঙ্গে ফারসি ‘আনা’ যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে মুরুব্বিয়ানা। শব্দটি বিশেষ্যে (ব্যাঙ্গার্থে) মুরুব্বিসুলভ আচরণ, মাতব্বরি প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
মহকুমা
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান (সংকলন ও সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ হারুন রশিদ), বাংলা একাডেমি ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: জ্যৈষ্ঠ ১৪২২/মে ২০১৫) অনুযায়ী মহকুমা … [আ. মহকামাহ্ مـحــكــمــة]”। এর ব্যুৎপত্তি চিত্রে দেখুন।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, আরবি উৎসের মহকুমা অর্থ— (বিশেষ্যে) কয়েকটি থানার সমন্বয়ে গঠিত প্রশাসনিক অঞ্চল।
একসময় বাংলাদেশে যেসব মহকুমা ছিল তার সবগুলো (চট্টগ্রামের পটিয়া ও তৎকালীন রাঙ্গামাটির রামগড় মহকুমা ব্যতীত) সবগুলো জেলায় উন্নীত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, প্রাক্তন রামগড় মহকুমা বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলার এবং প্রাক্তন পটিয়া মহকুমা চট্টগ্রাম জেলার একটি উপজেলা
√— — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — √
আবশ্যিকভাবে আপনার আগ্রহ সৃষ্টি করবে এমন কয়েকটি লিংক: প্রয়োজনীয় কিছু লিংক:
শুবাচ গ্রুপ এর লিংক: www.draminbd.com