অলিক না কি অলীক, লাল সালাম, পান্ডা, মাঝিমাল্লা ও মাল্লা

ড. মোহাম্মদ আমীন

অলিক না কি অলীক, লাল সালাম, পান্ডা, মাঝিমাল্লা ও মাল্লা

অলিক না কি অলীক: শব্দটির বানান অলীক। ঈ-কার অপরিহার্য। অলীক (√অল্‌+ঈক) তৎসম শব্দ। এর অর্থ— (বিশেষ্যে) মিথ্যা, অসত্য; কপাল, ললাট, ভাগ্য এবং (বিশেষণে) কাল্পনিক। তবে অলিকুল বানানে ই-কার। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, অলিকুল (অলি+কুল) অর্থ— (বিশেষ্যে) ভ্রমরের ঝাঁক, ভ্রমরকুল।

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

মাঝিমাল্লা ও মাল্লা: মাঝি ও মাল্লা শব্দের মিলনে মাঝিমাল্লা শব্দের উদ্ভব। বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা মাঝিমাল্লা অর্থ: মাঝি ও তার সহকর্মী। নৌযানের মাঝি এবং মাঝিকে নৌ পরিচালনার কাজে সহায়তাকারীদের একত্রে মাঝিমাল্লা বলা হয়। আরবি মল্লাহ্ থেকে উদ্ভূত মাল্লা অর্থ: (বিশেষ্যে) নৌকার মাঝি বা তার সহযোগী, মাঝির সহযোগী, নাবিক।

পান্ডা: মন্দির বা আশ্রমের সেবায়েতগণকে ‘পাণ্ডা’ বলা হয় কেন?” মন্দির বা আশ্রমের সেবায়েতগণকে পাণ্ডা বলা হয় না; পান্ডা বলা হয়। তাঁরা ‘পান্ডা’ বলে তাঁদের পান্ডা বলা হয়। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, হিন্দি পান্ডা অর্থ— (বিশেষ্যে) তীর্থস্থানের পূজারী; (ব্যঙ্গে) প্রধান ব্যক্তি। নেপালি পান্ডা অর্থ ভালুকজাতীয় সাদাকালো রঙের লাজুকপ্রকৃতির ছোটো প্রাণী।

লাল সালাম: লাল সালাম ( red salute ) বা লাল সেলাম কথাটি বিপ্লবী স্লোগান, দলীয় বিপ্লবী অভিবাদন, শ্রদ্ধা নিবেদনমূলক অভিব্যক্তি, সমর্থকদের প্রতি সমর্থন ও ভালোবাসা জ্ঞাপন প্রভৃতি কাজে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত অভিবাদন হিসেবে কথাটির প্রয়োগ সর্বাধিক। অনেক সময় বিশেষ বার্তা, বাণী বা ইঙ্গিত প্রদান কিংবা বিশেষ নির্দেশ জ্ঞাপনের জন্যও ব্যবহার করা হয়। রক্তের রং লাল। বিপ্লবে রক্তপাত হয়, প্রয়োজনে রক্ত বা জীবন দানের শপথ নিতে হয়। তাই লাল দ্বারা বিপ্লব বোঝানো হয়। এজন্য বিপ্লবীদের পতাকার রংও লাল। কোনো কমিউনিস্ট নেতা মারা গেলে তাঁর সম্মানার্থে surkh salam শব্দটিও ব্যবহার করা হয়। ফারসি surkh শব্দের অর্থ লাল। এটা দক্ষিণ এশিয়া— বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কমরেড বা কমিউনিস্টগণ বলে থাকেন। কমিউনিস্টদের মধ্যে পরস্পর প্রাত্যহিক অভিবাদন হিসেবেও কথাটি ব্যবহৃত হয়। এখন কমিউনিস্ট ছাড়াও উদারপন্থি অনেক রাজনীতিক দলের সমাবেশে কথাটি শোনা যায়।

#subach

Leave a Comment

কে কখন আলাদা ও কখন পৃথক বসে; তাই বনাম তা-ই

ড. মোহাম্মদ আমীন

কে কখন আলাদা ও কখন পৃথক বসে; তাই বনাম তা-ই

আপনাকে যেতে বলেছে কে?” এই বাক্যে প্রথম কে, বিভক্তি এবং দ্বিতীয় কে, সর্বনাম। কে কে দেশের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করতে চাও?” এই বাক্যে কে কে সর্বনাম এবং জীবন-এর সঙ্গে যুক্ত কে বিভক্তি। অনুরূপ: তাকে কে এখানে আসতে বলেছে?

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

() সর্বনাম হিসেবে ব্যবহৃত হলে কে আলাদা বসে। যেমন: তোমার বাবা কে তা আমি জানতাম না। এখানে কে শব্দটি সর্বনাম হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় বাবা থেকে পৃথক বসেছে। সাধারণত প্রশ্নবোধক বাক্যে কে শব্দটিকে পূর্ববর্তী শব্দ থেকে ফাঁক রেখে লেখার বহুল প্রয়োগ লক্ষণীয়। যেমন: আপনি কে? তোমরা কে কে যাবে? তুমি কে?
(প্রশ্নবোধক হোক বা না হোক বিভক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হলে কে পূর্ব শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে। যেমন: আপনাকে যেতে হবে। তোমাকে আমার চাই। মা, আমাকে ডাকছ? দেশকে ভালোবাস, জাতিকে সেবা দাও। মামাকে দেখতে যাবে না হাসপাতালে? আপাকে ডাকব?

তাই: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘তাই’ শব্দের তিনটি পৃথক ভুক্তি দেখা যায়। প্রথম ভুক্তিমতে, সংস্কৃত ‘তদ্‌’ থেকে উদ্ভূত ও বাক্যে সর্বনাম হিসেবে ব্যবহৃত ‘তাই’ শব্দের অর্থ— সেই বস্তুই, সেই কাজই এবং তাহাই শব্দের চলিত রূপ। যেমন: রাতে বিড়াল দেখল ছেলেটি, তাই দেখে ভয়ে সে অজ্ঞান। যা চাইছি তাই দিতে হবে। আমার তাই প্রয়োজন। তাই যদি না পাই তো আমার যা-ইচ্ছে তাই করব। দ্বিতীয় ভুক্তিমতে, সংস্কৃত ‘তস্মাৎ’ থেক উদ্ভূত ও বাক্যে অব্যয় হিসেবে ব্যবহৃত ‘তাই’ শব্দের অর্থ— সুতরাং, সে জন্য। যেমন: ক্লাস ছিল, তাই যেতে পারিনি। তাই তোমারে দেখতে এলেন অনেক দিনের পর। তৃতীয় ভুক্তিমতে, তাই শব্দের অর্থ শিশুর করতালি, হাত তালি প্রভৃতি। যেমন: তাই তাই তাই, মামার বাড়ি যাই/ মামি করছে দুভাত নাক ডুবিয়ে খাই।

তা-ই: অভিধানে ‘তা-ই’ বানানের কোনো শব্দ নেই। অনেকে ‘তা-ই’ শব্দটি ‘তাহাই’ শব্দের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। অনেকে আবশ্যকতা কিংবা বাধ্যবাধকতা বা জেদ, গুরুত্ব ইত্যাদি প্রকাশে ‘তাই’ এর স্থলে ‘তা-ই’ ব্যবহার করে থাকেন। যারা এটি ব্যবহার করেন তাদের অভিমত— জোর দেওয়ার জন্য ‘তা-ই’ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ‘তা-ই’ শব্দটি অনাবশ্যক। ‘তাহাই’ শব্দের চলিত রূপ ‘তাই’। সুতরাং, ‘তা-ই’ শব্দটি নিরর্থক এবং অপ্রয়োজনীয়।

উদহারণ: যা চাইছি তাই (তা-ই) দিতে হবে। আমার তাই (তা-ই) প্রয়োজন। তাই যদি না পাই তো আমার যা-ইচ্ছে তাই (তা-ই )করব। এখানে ‘তাই’-এর স্থলে তা-ই লেখা সমীচীন নয়। অতএব, লিখুন ‘তাই’। ‘তা-ই’ লিখবেন না। ‘তা-ই’ আদৌ সংগত বানান নয়।

উৎস: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

#subach

Leave a Comment

মদন, নয়ছয়, গুণ ও মান; জাদুকর ও যাদুকর

ড. মোহাম্মদ আমীন

মদন, নয়ছয়, গুণ ও মান; জাদুকর ও যাদুকর

নয়ছয়: নয়ছয় কথাটির প্রায়োগিক ও আলংকারিক অর্থ  এলোমেলো, বিশৃঙ্খলা, অপব্যয় প্রভৃতি। কিন্তু নয়ছয় কেন? অন্য অঙ্কও তো হতে পারত! পারত, কিন্তু তা যৌক্তিক হতো না। মূলত ইংরেজি 9 এবং 6 থেকে বাগ্‌ধারাটির উদ্ভব। ইংরেজি নয়কে উল্টালে পাওয়া যায় ইংরেজি ছয়; আবার ইংরেজি ছয়কে উল্টালে পাওয়া যায় ইংরেজি নয়। অর্থাৎ যা 9  ব্যক্তি ও অবস্থানভেদে তাই 6 হয়ে যায়। নয় থেকে সহজে 6-এ চলে আসার জন্য কলম ধরার কিংবা তাদের আকার আকৃতি বা রূপ পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। কেবল স্থান পরিবর্তন ও ব্যক্তিগত দর্শনই যথেষ্ট। তাই এই দুটি অঙ্ক নিয়ে যা খুশি তা করা যায়; যেমন ইচ্ছে তেমন ব্যাখ্যা করা যায়। উল্টিয়ে দিলে যাহা 9 তাহা  6 হয়ে প্রতিভাত করার সমূহ যুক্তি উপস্থাপন করা যায়। এটি একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা। প্রত্যেকের অবস্থান, দর্শন ও  নিজকীয়তা থেকে অঙ্ক দুটির লিখিত রূপকে কোনো রূপ পরিবর্তন ছাড়া ব্যাখ্যা করা যায়। তাই ব্যক্তিগত দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কোনো কিছুকে ইচ্ছেমতো প্রয়োগ বা ব্যাখা বা অপচয় করা অর্থেও শব্দটি ব্যবহার করা হয়। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাংলা নয়ছয় অর্থ (বিশেষণে) তছনছ, বিশৃঙ্খল;  (আলংকারিক অর্থে) অপব্যয়, আর্থিক অনিয়ম প্রভৃতি।

প্রয়োগ: নয়ছয় করলে অভাবে পড়তে হবে। সরকারি অর্থ নিয়ে নয়ছয় কোনো নতুন ঘটনা নয়।

মদন: ‘মদন’ হিন্দু পুরাণে বর্ণিত প্রেমের দেবতা। কন্দর্প; কামদেব; অনঙ্গ; অতনু; মন্মথ; মনোভব; মনসিজ; পঞ্চশর; স্মর; পুষ্পধন্বা; মকরকেতন; রতিপতি প্রমূখ কামদেবতা বা মদন নামে পরিচিত। মদন যেহেতু পুরাণে বর্নাণিত একটি নাম বিশেষ। তাই এর কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। অনেকে Cupid-কে মদনের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। কারণ কিউপিড হচ্ছে The god of love. বংশীবাদক অর্ফিয়াস, প্রেমের দেবতা। যার বাঁশী শুনলে মানুষ তো বটেই, পশুপাখি, এমনকি গাছপালা পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত।

গুণ মান: গুণ’ হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়-বস্তুতে বিদ্যমান শর্ত, যোগ্যতা, ক্ষমতা, সামর্থ্য প্রভৃতি। আর মান হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়/বস্তুতে বিদ্যমান বা
ঘোষিত গুণ বজায় রাখা/থাকা।

জাদুকর না কি যাদুকর: বাংলা একাডেমির অভিধানে প্রথামে ‘যাদু’ বানান প্রমিত ছিল। পরবর্তীকালে সেটা সংস্কার করে ‘জাদু’ শব্দকে প্রমিত করা হয়েছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রণীত ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা বানানের নিয়মে বলা আছে অসংস্কৃত (তদ্‌ভব, দেশি ও বিদেশি) শব্দে ‘য’ না লিখিয়া ‘জ’ লেখা বিধেয়। অতএব ‘জাদুকর’ বানানই প্রমিত।

Leave a Comment

মাকাল ফল মাকাল শিব ও মহাকাল

ড. মোহাম্মদ আমীন

মাকাল ফল মাকাল শিব ও মহাকাল

মাকাল ফল কী? বর্ষাকালে ফোটে এমন ঘণ্টাকৃতির রোমশ সাদা ফুল ও হালকা সবুজাভ দাগযুক্ত উজ্জ্বল লাল রঙের ডিম্বাকার এবং দেখতে আকর্ষণীয়, কিন্তু বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত ফল। খাঁজকাটা পাতাবিশিষ্ট বীরুৎশ্রেণির লতানো উদ্ভিদে এই ফলটি জন্মায়। তাই ওই লতাটিও মাকাল নামে পরিচিত। উপাধি ‘ফল’ হলেও এটি এমন একটি ‘ফল’ যা

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

কেউ খায় না। তবু ফল উপাধি নিয়ে টিকে আছে, যদিও ফলের কোনো ভালো গুণ তার নেই। মানুষের মধ্যেও এমন কিছু লোক দেখা যায়, যারা এমন পদবি-পদক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, অথচ তা ধারণের যোগ্যতা আদৌ তাদের নেই।‘মাকাল ফল’ কথাটির অন্য একটি অর্থ আছে। সেই অর্থটি হচ্ছে — সুদর্শন কিন্তু অন্তঃসারশূন্য ব্যক্তি। বস্তুত, এই অর্থ প্রকাশে ‘মাকাল ফল’ শব্দজোড়টি সমধিক প্রচলিত ও ব্যবহৃত হয়। তাই ফলের গুণ না-থাকা সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যে ‘মাকাল ফল’ বাগ্‌ধারাটির বেশ প্রভাব লক্ষণীয়।

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, “সংস্কৃত ‘মহাকাল’ শব্দ থেকে ‘মাকাল’ শব্দের উদ্ভব।”মহাকাল হচ্ছে ভারতীয় পুরাণে বর্ণিত মহাদেব ‘শিব’-এর রুদ্র রূপ। শিব, রুদ্র রূপ ধারণ করলে তাঁর বাহ্যিকরূপ আকর্ষণীয় থাকলেও ভেতরের রূপ প্রচণ্ড ক্ষতিকর, ঘৃণার্হ আর বীভৎস হয়ে যায়। যার সঙ্গে মাকাল ফলের তুলনা চলে। তাই মহাকালের রুদ্র রূপের সঙ্গে মাকাল-এর অর্থকে দ্যোতিত করে ফলটির বাংলা নাম রাখা হয়েছে ‘মাকাল ফল’।

মাকাল ফল কথাটির আলংকরিক অর্থ “সুদর্শন কিন্তু অন্তঃসারশূন্য ব্যক্তি”। কেন এমন অর্থ ? কারণ আছে। মাকাল ফল দেখতে খুবই সুন্দর, কিন্তু খাওয়ার অযোগ্য। এটি বেশ আকর্ষণীয়, তবে দুর্গন্ধযুক্ত ও বিষাক্ত। তাই কেউ তাকে পছন্দ করে না। মাকাল ফলের বাহ্যিক অবয়ব অতীব সুন্দর, কিন্তু ভেতরের অংশ এত কুৎসিত যে, সে অংশের দিকে তাকালে মন বিতৃষ্ণায় ঘৃণার্হ হয়ে ওঠে। তাই এর  আলংকরিক অর্থ – সুদর্শন কিন্তু অন্তঃসারশূন্য ব্যক্তিআমাদের চারিপাশে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা দেখতে মাকাল ফলের মতো সুন্দর, পরিপাটি ও আকর্ষণীয়, কিন্তু মনোভাবের দিক থেকে ভেতরটা বিষাক্ত, দুর্গন্ধময় এবং কুৎসিত।

#subach

 

Leave a Comment

অংশীদারত্ব ও অংশীদারিত্ব কোনটি সঠিক

ড. মোহাম্মদ আমীন

অংশীদারত্ব ও অংশীদারিত্ব কোনটি সঠিক

অংশ থেকে অংশী, ‘অংশী’ থেকে ‘অংশীদার’, ‘অংশীদার’ থেকে ‘অংশীদারি’ ও ‘অংশীদারত্ব’ এবং বলা হয় ‘অংশীদারি’ থেকে ‘অংশীদারিত্ব’। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে ‘অংশীদারি’ শব্দের অর্থই অংশীদারত্ব, সেখানে ‘অংশীদরিত্ব’ শব্দটি কি বাহুল্য নয়?  এবার দেখা যাক শব্দগুলোর অর্থ, ব্যুৎপত্তি এবং প্রায়োগিক উপযোগিতা।

বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত অংশ (√অন্‌শ্‌+অ) শব্দের অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। তবে আলোচ্য প্রবন্ধের জন্য প্রযোজ্য অর্থসমূহ হচ্ছে ভাগ, অঞ্চল,

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

মালিকানা প্রভৃতি। বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত অংশী (অন্‌শ্‌+ইন্) শব্দের অর্থ: অংশ আছে এমন, অংশবিশিষ্ট প্রভৃতি।‘অংশ’ এবং ‘অংশী’ সংস্কৃত হলেও ‘অংশীদার’ ও ‘অংশীদারি’ সংস্কৃত নয়। কারণ ‘অংশী’ শব্দের সঙ্গে যথাক্রমে ফারসি ‘দার’ ও ‘দারি’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘অংশীদার’ ও ‘অংশীদারি’ শব্দ দুটি গঠিত হয়েছে।

বাংলা একডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ফারসি অংশীদার শব্দের অর্থ সম্পত্তি বা ব্যবসায়ে যার অংশ আছে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘partner’। কোনো অংশে বা বিষয়ে যার ভাগ আছে তিনিই অংশীদার বা পার্টনার এবং অংশীদারের পদ, মর্যাদা, কাজ বা গুণ কিংবা মালিকানা অর্জনের হেতৃত্ব প্রভৃতিই হচ্ছে অংশীদারত্ব। অন্যদিকে বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ফারসি অংশীদারি শব্দের অর্থ মালিকানা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘partnership’। মালিকানা বা পার্টনারশিপ নিজেই অংশীদারের একটি কাজ বা গুণ তথা অংশীদারত্ব। সুতরাং এর সঙ্গে পুনরায় ত্ব যুক্ত করা অনাবশ্যক।

এ বিষয়ে প্রচলিত অভিধান কী বলে তা দেখা যাক। ভারত থেকে প্রকাশিত ‘আকাদেমি বানান অভিধান (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, চতুর্থ সংস্করণ, ২০০৩)’ এবং অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘সংসদ বানান অভিধান [পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ ২০০৯-এর তৃতীয় মুদ্রণ ২০১৩]’- দুটি অভিধানেই কেবল অংশীদারিত্ব শব্দটি পাওয়া যায়, কিন্তু ‘অংশীদারত্ব’ শব্দটি ওই দুটি অভিধানে রাখা হয়নি।

 অন্যদিকে, ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণের বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান [প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ১৯৯২] বা ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণের বাংলা একাডেমি বাঙলা উচ্চারণ অভিধান [পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৯৯)] বা ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণের বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান [দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯২-এর পরিমার্জিত সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০০] বা ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণের বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধান [পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৮] বা ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণের বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান [প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৬; পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ: এপ্রিল ২০১৬]- এই অভিধানগুলোর  কোনোটাতে- ‘অংশীদারত্ব’ বা ‘অংশীদারিত্ব’ শব্দ পাওয়া যায় না। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসও তাঁর অভিধানে শব্দদুটোর একটিকেও স্থান দেননি। রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’তেও শব্দদুটো পাওয়া যায়নি।

আমরা সাধারণত বাংলা একাডেমির অভিধান অনুসরণ করি, কিন্তুে একাডেমির বাংলা অভিধানসমূহে অংশীদারত্বআংশীদারিত্ব শব্দ নেই। সে হিসেবে ধরে নিতে হয়, অংশীদারত্ব এবং অংশীদারিত্ব উভয় শব্দই অপ্রমিত বা ভুল বা অস্তিত্বহীন। কিন্তু তা নয়, অভিধানে কোনো শব্দ না-থাকলে তা নেই বা ভুল কিংবা অস্তিত্বহীন ধরে নেওয়া সমীচীন নয়। অভিধান একটি দোকানের মতো। একটি দোকানে সব পণ্য রাখা, থাকা বা পাওয়া অসম্ভব। কোনো একটি দোকানে একটি পণ্য নেই- তার মানে এই নয় যে, পণ্যটি অস্তিত্বহীন। মনে রাখতে হবে, বাংলায় চার লাখের অধিক শব্দ আছে, কিন্তু এ পর্যন্ত কেবল চুয়াত্তর হাজারের মতো শব্দ অভিধানভুক্ত করা হয়েছে বা অভিধানে পাওয়া যায়।

বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবাকো), সংস্কার, গবেষণা ও আইন অনুবিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা “সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলা (ব্যবহারিক শব্দকোষ)” নামের একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। এই পুস্তিকায় ‘অংশীদারিত্ব’ শব্দটি রায়েছে। এখানে এই শব্দটির উপস্থিতি যেমন হাস্যকর তেমনি উদ্ভট। কেননা, এই পুস্তিকার শিরোনামের নিম্নে প্রথম বন্ধনী দিয়ে লেখা হয়েছে, বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুসরণে পুস্তিকাটি সংকলিত। আমার দেখলাম, বাংলা একাডেমির সর্বশেষ অভিধানেও অংশীদারিত্ব শব্দটি নেই। তাহলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাবাকো এটি কোথায় পেল? তাদের জন্য কি বাংলা একাডেমি নতুন আইন করেছে? এটি বাবাকোর অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়।  বাবাকোর কোনো পুস্তিকা আমি পড়ি না। কেননা, বইপুস্তক রচনায় তাদের সৃজনশীলতা নকলনবিশের মতো। তাই ওদের সংকলিত পুস্তকে শুদ্ধ কিছু থাকলেও আমার ভুল মনে হয়।

উৎস: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

#subach

 

Leave a Comment

কিভাবে কীভাবে, কিসে কীসে, কি ভাবে, কী ভাবে: কি বনাম কী

ড. মোহাম্মদ আমীন

কিভাবে কীভাবে, কিসে কীসে, কি ভাবে, কী ভাবে: কি বনাম কী

কি বনাম কী: ১. ‘কি’ প্রশ্নবোধক অব্যয়। যে সকল প্রশ্নের ‍উত্তর ‘হাঁ’ বা ‘না’ শব্দের মাধ্যমেও কিংবা কেবল অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমেও সন্তোষজনকভাবে দেওয়া যায় সে সকল প্রশ্নবোধক বাক্যে ‘কি’ লিখবেন। যেমন : আমি কি খাব? (Will I eat?), আমি কি আসতে পারি স্যার? টাকা আছে কি? তুমি কি জানো? (Do you know?)

২. যে সকল প্রশ্নের উত্তর ‘হাঁ বা ‘না‘ দিয়ে কিংবা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সন্তোষজনকভাবে দেওয়া সম্ভব নয় সে সকল প্রশ্নবোধক বাক্যে ‘কী’ লিখবেন। যেমন : আমি কী খাব? (What will I eat?), তুমি কী চাও? (What do you want?), কী করে এতদূর এলে? তোমার বাবা কী করেন? তুমি কী জানো? (What do you know?)

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

৩. ‘কী’ বিস্ময়সূচক পদ। তবে বিস্ময় ছাড়াও অনিশ্চয়তা, অবজ্ঞা, সম্মান গৌরব, প্রশংসা প্রভৃতি প্রকাশেও ‘কী’ ব্যবহার করা হয়। যেমন – বিস্ময় : কী দারুণ! অনিশ্চয়তা : কী জানি কী হয় না হয়। অবজ্ঞা : সে আবার কী ধনী? প্রশংসা : কী ধনী তিনি জানো? ছেলেটি যে কী সাহসী জানলে তুমি হতবাক হয়ে যাবে।

কিভাবে ও কীভাবে: একজন শুবাচি কিভাবে ও কীভাবে শব্দের প্রয়োগ দেখতে চাইলেন। কিভাবে, কিরকম, কিরূপ বানানের কোনো শব্দ বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায়: কীভাবে, কীরূপ, কীরকম, কীজন্য,কীদৃক (কীরকম), কীদৃশ (কীরূপ) প্রভৃতি। আলোচনা হবে কীভাবে শব্দটি নিয়ে।

কি ভাবে হতে পারে। এর অর্থ কি চিন্তা করে। যেমন: সে কি ভাবে? ( সে কি চিন্তা করে?)। সে কি ভাবে না যে, দেশে এখন দুর্যোগ চলছে? উত্তর হতে পারে হ্যাঁ বা না। কীভাবে অর্থ কোন উপায়ে (তারা কীভাবে এই সংকট থেকে রেহাই পাবে? অর্থ: তারা কোন উপায়ে এই সংকট থেকে রেহাই পাবে ।) ‘কী ভাবে’ অর্থ কী চিন্তা করে, চিন্তার বিষয়, ভাবনার বিষয় ( তারা কী ভাবে এই সংকট নিয়ে? অর্থ: এই সংকট বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনা কী?)

কীভাবে কীসে কিভাবে কিসে: ‘কিভাবে’ ও ‘কিসে’ ভুল বানান। এর শুদ্ধ রূপ যথাক্রমে ‘কীভাবে’ ও কীসে। শব্দদুটোয় ‘ক’-এর সঙ্গে ঈ-কার অপরিহার্য। কীভাবে: বাক্যে ক্রিয়াবিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা কীভাবে অর্থ— কেমন করে (কীভাবে যাবে?)। কীসে: বাক্যে সর্বনাম হিসেবে ব্যবহৃত বাংলা কীসে অর্থ— কী থেকে, কেমন করে, কার মধ্যে। কীসে এসেছ?

‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ২.১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “কীভাবে, কীরকম, কীরূপে প্রভৃতি শব্দেও ঈ-কার হবে। যেসব প্রশ্নবাচক বাক্যের উত্তর ‘হ্যাঁ ’বা ‘না’ দিয়ে দেওয়া যায়, সেইসব বাক্যে ব্যবহৃত ‘কি’ হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন: তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে? গতকাল তারা এসেছিল কি?

কি এবং কী— এ দুটির পার্থক্য থেকেই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। হ্যাঁ বা না দিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া গেলে ‘কি’ হয়। অন্যসব ক্ষেত্রে লেখা হয় ‘কী’। ‘কীভাবে’ কথার সঙ্গে যুক্ত বিষয়ের উত্তর হ্যাঁ বা না দিয়ে দেওয়া যায় না। তাই ‘কীভাবে’ শুদ্ধ। আবার ‘কি ভাবে’, ‘কী ভাবে’ এগুলোও শুদ্ধ। যেমন
সে কী ভাবে? ( What does he think?)
সে কী ভাবে? (Does he think?)
সে কীভাবে এটা করল? (How did he do it?)

সূত্র: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

#subach/

Leave a Comment

উৎপত্তি বনাম ব্যুৎপত্তি; ব্যুৎপত্তি ও ব্যুৎপত্তিগত অর্থ

ড. মোহাম্মদ আমীন

উৎপত্তি বনাম ব্যুৎপত্তি; ব্যুৎপত্তি ও ব্যুৎপত্তিগত অর্থ

উৎপত্তি বনাম ব্যুৎপত্তি: সংস্কৃত উৎপত্তি (উৎ+√পদ্‌+তি) অর্থ— (বিশেষ্যে) উৎস, উদ্ভব, শুরু, জন্ম, সূচনা, প্রকাশ, অভ্যুদয়। যেমন:
বিশ্বের উৎপত্তি, প্রাণের উৎপত্তি, পানির উৎপত্তি, মানুষের উৎপত্তি, ভাষার উৎপত্তি, রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিজ্ঞানের উৎপত্তি, ধর্মের উৎপত্তি, বাংলাদেশের উৎপত্তি, সাগরের উৎপত্তি; অগ্নিপরীক্ষা কথার উৎপত্তি, ব্যাকরণের প্রভৃতি।
.

ব্যুৎপত্তি মূলত একটি ব্যাকরণিক শব্দ।বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান মতে ব্যুৎপত্তি (বি+উদ্‌+√পদ্‌+তি) অর্থ (ব্যা.) প্রকৃতি-প্রত্যয়াদি বিশ্লেষণদ্বারা

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

শব্দের গঠনবিচার’; যেমন:

অগ্নিপরীক্ষা শব্দের ব্যুৎপত্তি— [স. অগ্নি+পরীক্ষা]’;
ব্যুৎপত্তি শব্দের ব্যুৎপত্তি—[স. বি+উদ্‌+√পদ্‌+তি];
প্রত্যেক শব্দের ব্যুৎপত্তি— [স. প্রতি+এক];
ব্যূহ শব্দের ব্যুৎপত্তি— [স. √বি+ঊহ্‌+অ]।
মনে রাখুন, য-ফলা পরের বিষয়। ভাষার উৎপত্তির পর শব্দের ব্যুৎপত্তি। তাই উৎপত্তিতে য-ফলা নেই, ব্যুৎপত্তিতে আছে।
.

ব্যুৎপত্তি ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: ব্যুৎপত্তি: কোনও শব্দের বিশ্লেষণ তার ধাতু, প্রকৃতি, প্রত্যয় ইত্যাদির পরিচয়ের নাম ব্যুৎপত্তি। শব্দকে বিশ্লেষণ করে তার ধাতু প্রত্যয় ইত্যাদি বের করাকে বলা হয় ব্যুৎপত্তি নির্ণয়। ব্যুৎপত্তি নির্ণয়কে প্রকৃতিপ্রত্যয় নির্ণয়ও বলা হয়।

ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: এটি সাধিত শব্দের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কোনও শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করলে, তাতে যে যে অংশ পাওয়া যায়, সেই অংশগুলোর অর্থের সমন্বয়ে শব্দটির যে অর্থ হয়, তাকেই বলা হয় ব্যুৎপত্তিগত অর্থ। যেমন: করণীয় শব্দের ব্যুৎপত্তি : √কর্‌+ অনীয়। ব্যুৎপত্তিগত অর্থযা করা উচিত। অনেক শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ প্রচলিত অর্থ একই হয় না। যেমন: পঙ্কজ শব্দের

ব্যুৎপত্তিগত অর্থ : পঙ্কে যা জন্মায়; কিন্তু প্রচলিত অর্থেপঙ্কজবলতে পঙ্কে যা জন্মায় তার সবকিছুকে বোঝায় না। পঙ্কজ শব্দের প্রচলিত অর্থ পদ্ম।

সূত্র: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ অপপ্রয়োগ, . মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

#subach/

Leave a Comment

আঁতেল ও আঁতলামো, লাঠিসোটা, প্রক্ষালন ও প্রক্ষালন কক্ষ, ধর্মকর্ম বনাম ধর্মকাম

ড. মোহাম্মদ আমীন

আঁতেল ও আঁতলামো, লাঠিসোটা, প্রক্ষালন ও প্রক্ষালন কক্ষ, ধর্মকর্ম বনাম ধর্মকাম

আঁতেল ও আঁতলামো

আঁতেল: আঁতেল ফরাসি উৎসের শব্দ। বাক্যে সাধারণত বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত আঁতেল অর্থ— পণ্ডিত। ইংরেজিতে যাকে বলা হয়— intellectual, বুদ্ধিজীবী। শব্দটির ব্যঙ্গার্থ— শিক্ষিত না হয়েও যে বুদ্ধিজীবীর চালচলন অনুকরণ করে, পণ্ডিতম্মন্য। ইদানীং আঁতেল শব্দটি নেতিবাচক অর্থে সমধিক ব্যবহৃত, যদিও এর ইতিবাচক অর্থ রয়েছে।
আঁতলামো: ফরাসি উৎসের শব্দ। বুদ্ধিজীবীর হাবভাব বা চালচাল অনুকরণ, পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের চেষ্টা প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে নেতিবাচক বাগ্‌ভঙ্গি হিসেবে আঁতলামো শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। আঁতলামো তাকে হাস্যকর করে তুলেছে।

লাঠিসোটা

লাঠি ও সোটা নিয়ে লাঠিসোটা বাগ্‌ভঙ্গিটি গঠিত। লাঠি শব্দের অর্থ আমরা সবাই জানি। তবে সোটা অর্থ অনেকের জানা নেই। কারণ শব্দটি এখন এককভাবে আর ব্যবহৃত হয় না। তবে অষ্টাদশ শতকেও শব্দটির ব্যবহার ছিল। সোটা অর্থ: ছোটো লাঠি। সুতরাং, লাঠিসোটা অর্থ বিভিন্ন ধরনের বা ছোটো ও বড়ো লাঠি। অর্থাৎ, বিভিন্ন ধরনের লাঠিকে বলা হয় লাঠিসোটা।

প্রক্ষালন ও প্রক্ষালন কক্ষ

সংস্কৃত প্রক্ষালন (প্র+√ক্ষালি+অন) অর্থ— (বিশেষ্যে) ধৌতকরণ। প্রক্ষালক অর্থ— ধৌতকারী। যে কক্ষে ধৌত করা হয় তাকে বলা হয় প্রক্ষালন কক্ষ
ধৌতককর্ম এবং মলমূত্র ত্যাগ ও মলমূত্র ত্যাগের কারণে অত্যাবশ্যক ধৌতকর্মাদি একই কক্ষে করা হয়। যে কক্ষে মলমূত্র ত্যাগ করা হয় সে কক্ষে ধৌত বা শৌচকরণ কার্য অনিবার্য। তাই মঞ্জুভাষ হিসেবে মলমূত্র ত্যাগ করা যায় এমন কক্ষকে সাধারণত প্রক্ষালন কক্ষ বলা হয়।
তবে কিছু কিছু কক্ষ আছে যেখানে কেবল প্রক্ষালন কর্ম করা যায়, মলমূত্র ত্যাগ করা যায় না। এগুলোকেও প্রক্ষালন কক্ষ বলা হয়।

ধর্মকর্ম বনাম ধর্মকাম

কর্ম ও কাম সমার্থক হলেও ধর্মকর্ম ও ধর্মকাম সমার্থক নয়। ধর্মকর্ম অর্থ— ধর্মশাস্ত্রে নির্দেশিত ক্রিয়াকর্ম, ধর্মানুষ্ঠান। ধর্মকর্ম শব্দটি বিশেষ্য। অন্যদিকে, ধর্মকাম অর্থ— পুণ্যলাভের আশায় ধর্মকর্ম করে এমন। এটি বিশেষণ। ধর্মকর্ম অনুসারে ধর্মকাম সম্পাদিত হয়।
ধর্মকাম ঠাকুরদা সারাক্ষণ ধর্মকর্মে ব্যস্ত থাকেন।

Leave a Comment

ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে: পুরো ছড়া: ছড়ার ইতিবৃত্ত

ড. মোহাম্মদ আমীন

ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে: পুরো ছড়া: ছড়ার ইতিবৃত্ত

ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো

ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।

ধান ফুরালো, পান ফুরলো
খাজনার উপায় কী?
আর টা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।।

ধনিয়া পিয়াজ গেছে পচে
সইরষা ক্ষেতে জল,
খরাবন্যায় শেষ করিল
বছরের ফসল।।

ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি
সব শুধু আজ খালি,
সবার গায়ে ছেঁড়া কাপড়
শত শত তালি।।

গোরুছাগল, হাঁসমুরগিমাছ
যা কিছু  মোর ছিল
নদীর টানে বাঁধটি ভেঙে
সবই ভেসে গেল।।

বারেতে পাঁচ গাঁয়েতে
দিছি আলুর সার
আর কটা দিন সবুর করো
মশাই জমিদার।।

ছড়াটির লেখক কে তা আমি জানি না। আমার পিতামহ গোলাম শরীফের অনেক পুরানো একটা ডায়েরিতে পেয়েছি।  এটি তাঁর লেখা কি না তাও আমি জানি না।

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

তবে তিনি ছড়া লিখতেন। তিনি ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আরবি ভাষার শিক্ষক। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের বন্ধু আত্মীয়। আহমদ ছফা, আহমদ হোসেন প্রমুখ ছিলেন তাঁর ভক্ত। তাঁর একটা ডায়েরিতে বিভিন্ন লোকালয়ে প্রচলিত কিছু ছড়া, কবিতা, প্রবাদ, প্রবচন, ধাঁধাঁ রয়েছে। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে ছড়াটি তার পুরানো ডায়েরি হতে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে প্রকাশ করা হয়েছিল। পুরানো ডায়েরি ছিল বলে শব্দের বানান শব্দসজ্জায় কিছুটা ভুল হয়েছিল। এখন তা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে পুনরায় প্রকাশ করা হলো। সেসময় ছড়াটি শুবাচের জনালায় যযাতি হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার পর শুবাচি খুরশেদ আহমেদ মন্তব্য জানালায় লিখেছিলেন,‘ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো/ বর্গী এল দেশেছড়াটির মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাস কথা কয়! এই ছড়াটি :

) ১৭৪০এর দশকে বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলে অশ্বারোহী মারাঠা বর্গিদের পৌনঃপুনিক অতর্কিত আক্রমণ, লুণ্ঠন সন্ত্রাস থেকে গ্রামবাঙলার অধিবাসীদের রক্ষা করায় বাংলার তৎকালীন নবাব আলিবর্দি খাঁএর পূর্ণ ব্যর্থতার নিদর্শন;
) নবাবের পক্ষে পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক শাসকদের পক্ষে খাজনা আদায়ে জমিদারের নানান বাহিনীর চাপপ্রয়োগ অত্যাচারের নিদর্শন;
) সেকালেও কৃষকের ভাগ্যে খরাবন্যাজনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিদ্যমানতার নিদর্শন;
) সেকালের গ্রামবাসীদের দারিদ্রের নিদর্শন;
) খাজনা দেওয়াসহ জীবনধারণের জন্য আলু রসুন চাষসহ বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলার তৎকালীন কৃষকদের অব্যাহত সংগ্রামের, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখায় তাদের পূর্বাবস্থায় ফিরে আসার ক্ষমতাররেজিলিয়েন্সেরনিদর্শন; এবং
) ছড়ার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে বর্গি, খাজনা, খরাবন্যা, চাষবাস জীবনসংগ্রামের বিষয়ে অবগত দীক্ষিত করে তোলার ঐতিহ্যের নিদর্শন।

ছড়াটি পড়ে প্রবীণ শুবাচি বিধুভূষণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, “কিন্তু এতো কিছু থাকতে রসুন দিয়েই কেন খাজনা শোধ করতে হবে সেই ব্যাখ্যা কেন কেউ দিচ্ছেন না বুঝতে পারছি না। নিশচয়ই এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে।আসলেই আছে। এখন পিঁয়াজের দাম প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। রাতে মানুষ পিঁয়াজের খেত পাহারা দেয়। ছড়াটি যখন লেখা হয়ে তখন হয়তো এই সময়ের পিঁয়াজের দাম বৃদ্ধির মতো রসুনের দামও বেড়ে গিয়েছিল।

#subach

Leave a Comment

রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সমসাময়িক প্রশাসনিক প্রাশাসনিক 

ড. মোহাম্মদ আমীন

রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সমসাময়িক প্রশাসনিক প্রাশাসনিক 

রাজনৈতিক অর্থনৈতিক: কেন্দ্র+ইক = কৈন্দ্রিক, কেশ+ ইক = কৈশিক, গিরি+ইক = গৈরিক, চিত্ত+ ইক= চৈত্তিক, চৈত্রী+ ইক= চৈত্রিক, চীন+ইক = চৈনিক, জীবন+ইক = জৈবনিক, বিষয়+ইক = বৈষয়িক, বিচার+ ইক= বৈচারিক; তেমনি নীতি +ইক = নৈতিক। সুতরাং,

  • রাজ + (নীতি + ইক) = রাজ+ নৈতিক = রাজনৈতিক।
  • আবার রাজনীতি+ ইক = রাজনীতিক। যেমন ঃ মাস+ইক = মাসিক, সাহিত্য+ইক = সাহিত্যিক।
  • সেভাবে; অর্থ + (নীতি+ ইক) = অর্থ+ নৈতিক = অর্থনৈতিক।
  • আবার অর্থনীতি + ইক= আর্থনৈতিক। যেমন : বর্ষ + ইক = বার্ষিক।

অতএব, রাজনৈতিক, রাজনীতিক, অর্থনৈতিক, আর্থনীতিক সবকটি শুদ্ধ।

কূটনৈতিক : উৎপাত +ইক =ঔৎপাতিক, উৎসর্গ+ইক= ঔৎসর্গিক, উত্তরপদ+ইক = ঔত্তরপাদিক, ওদন+ইক = ঔদনিক, উদর+ইক = ওদরিক, উদ্‌বাহ+ইক =

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

ঔদ্‌বাহিক, ‍উদ্ধার+ইক = ঔদ্ধারিক, উপকূল+ইক= ঔপকূলিক, উপাচার+ইক = ঔপাচারিক, উপদেশ+ইক = ঔপদেশিক, উপন্যাস+ইক = ঔপন্যাসিক, উপনিবেশ+ ইক = ঔপনিবেশিক, উপমা+ইক = ঔপমিক, উপায়+ইক= ঔপয়িক, ‍উপসর্গ+ইক= ঔপসর্গিক। সে হিসেবে কূটনীতি + ইক = কৌটনীতিক হওয়ার কথা, কিন্তু অভিধানে এমন শব্দ আমি পাইনি। অভিধানে পায়, কূটনৈতিক। কূট শব্দের সঙ্গে নৈতিক যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে কূটনৈতিক। অর্থাৎ কূট + নীতি+ ইক = কূট + নৈতিক = কূটনৈতিক। লিখুটন কূটনৈতিক, কূটনীতিক নয়।

সমসাময়িক না কি সামসময়িক : সমসময় (একই সময়) + ষ্ণিক (ইক) = সামসময়িক। এর অর্থ একই সময়ের বা সমকালীন। ব্যাকরণ অনুযায়ী সামসময়িক শুদ্ধ, তবে সমসাময়িক অধিক প্রচলিত। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানেও সমসামিয়ক শব্দটাকে সামসময়িক শব্দের অশুদ্ধ প্রচলিত ‍রূপ নির্দেশ করা হয়েছে। অতএব লিখুন, সামসময়িক।

প্রশাসন প্রশাসনিক ‘প্রশাসন’ শব্দের সঙ্গে ‘ইক’ প্রত্যয় যুক্ত করলে হয়, ‘প্রশাসন+ ইক = প্রাশাসনিক’। যেমন : সময় + ইক = সাময়িক, বর্ষ+ ইক = বার্ষিক, প্রত্যহ + ইক = প্রাত্যাহিক, নন্দন+ইক = নান্দনিক, সমষ্টি + ইক = সামষ্টিক ইত্যাদি। এ হিসেবে ‘প্রাশাসনিক’ শব্দটি শুদ্ধ। ‘শাসন’ শব্দের সঙ্গে ইক প্রত্যয় যুক্ত করলে হয়, ‘শাসন + ইক =শাসনিক’। যেমন : মাস+ ইক = মাসিক, কাল + ইক = কালিক, আত্মন্ + ইক = আত্মিক, জাল+ ইক = জালিক ইত্যাদি। এভাবে শাসন শব্দের সঙ্গে ‘ইক’ প্রত্যয় যোগে প্রাপ্ত ‘শাসনিক’ শব্দের সঙ্গে ‘প্র’ উপসর্গ যোগ করলে হয় ‘প্র+ শাসনিক= প্রশাসনিক’।

অতএব, ব্যাকরণগতভাবে ‘প্রশাসনিক’ এবং ‘প্রাশাসনিক’- দুটোই শুদ্ধ। ‘সমসাময়িক’ এবং ‘সামসময়িক’ শব্দদ্বয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

উৎস: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

#subach

Leave a Comment