তৎসম শব্দ চেনার কৌশল: শব্দ দেখামাত্র তৎসম শব্দ চেনার উপায়

ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম শব্দ চেনার কৌশল: শব্দ দেখামাত্র তৎসম শব্দ চেনার উপায়

বাংলায় ৫৫ ভাগের মতো শব্দ তৎসম। এগুলো চেনার কয়েকটি সহজ কৌশল নিচে দেওয়া হলো। তবে বাংলায় এমন অসংখ্য তৎসম শব্দ আছে যা নিচে লিখিত নিয়মের আওতায় পড়ে না। সেগুলো অধ্যয়নের মাধ্যমে চিনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এবার নিয়মকটি দেখে নেওয়া যাক :

১. প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুযায়ী ঈ ঊ এবং ঋ আর এসব বর্ণের কারচিহ্ন (ী, ‍ূ, ‍ৃ) যুক্ত সকল শব্দ তৎসম।

২. মূর্ধন্য-ণ যুক্ত সব শব্দ তৎসম।মূর্ধন্য-ষ যুক্ত শব্দ সাধারণত তৎসম হয় কিন্তু কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলোর বানানে মূর্ধন্য-ষ থাকলেও তৎসম নয়। যেমন : খ্রিষ্টাব্দ, খ্রিষ্ট, পোষা, ষোলো, বোষ্টম প্রভৃতি তৎসম নয়।

৩. যেসব শব্দের পূর্বে প্র, পরা, অপ, সম, অব, অনু, নির(নিঃ), দুর(দুঃ), উৎ, অধি, পরি, প্রতি, উপ, অভি, অতি শব্দগুলো যুক্ত থাকে সেগুলো তৎসম।

৪. ক্ত্র, ক্ম, ক্ষ, ক্ষ্ণ, ক্ষ্য, ক্ষ্ম, ক্ষ্ম্য, গ্ধ, গ্ন্য, গ্ম, ঘ্ন, ঙ্ক্ষ, ঙ্ম, চ্ছ্ব, চ্ছ্র, জ্ঝ, জ্ঞ, ঞ্ছ, ঢ্র, ত্ত্ব, ত্ম্য, ত্র্য, দ্ব্য, দ্ম, ধ্ন, ধ্ম, ন্ত্য, ন্ত্ব, ন্ত্র, ন্ত্র্য, ন্দ্ব, ন্ধ্য, ন্ধ্র, ন্ন্য, ল্ম, শ্ছ, শ্ম, ষ্ক্র, ষ্ট্য, ষ্ট্র, ষ্ব, ষ্ম, স্ত্য, স্থ্য, হ্ন্য, হ্ম, হ্ল প্রভৃতি যুক্তবর্ণ শুধু তৎসম শব্দে দেখা যায়।

৫. বিসর্গযুক্ত এবং বিসর্গসন্ধিসাধিত শব্দসমূহ তৎসম।

৬ . বহুবচনবাচক গণ, বৃন্দ, মণ্ডলী, বর্গ, আবলি, গুচ্ছ, দাম, নিকর, পুঞ্জ, মালা, রাজি, রাশি প্রভৃতির যে কোনো একটি থাকলে ওই শব্দ তৎসম হয়।

৭. সমাসবদ্ধ পদের একটি অংশ তৎসম হলে অপর অংশ এবং সমস্তপদটিও তৎসম হয়। যেমন চন্দ্রমুখ শব্দে চন্দ্র অংশটি তৎসম সুতরাং ‘মুখ’ এবং ‘চন্দ্রমুখ’ শব্দদুটোও তৎসম।

৮. উপমান কর্মধারয়, উপমিত কর্মধারয় এবং রূপক কর্মধারয় সমাস গঠিত শব্দ সাধারণত তৎসম হয়।

৯. অব্যয়ীভাব এবং প্রাদি সমাস দ্বারা গঠিত পদগুলো সাধারণত তৎসম হয়।

১০. শব্দের শেষে তব্য ও অনীয় থাকলে তা তৎসম হয়। যেমন কর্তব্য, মন্তব্য, বক্তব্য, দ্রষ্টব্য, ভবিতব্য, করণীয়, দর্শনীয়, বরণীয়, রমণীয় প্রভৃতি তৎসম।

১১. শব্দের শেষে তা, ত্ব, তর, তম, বান, মান, এয়, র্য প্রভৃতি থাকলে সাধারণত ওই শব্দগুলো তৎসম হয়।

১২. অব্যয়পদের শেষে ত থাকলে (প্রথমত, অন্তত, জ্ঞানত) তা তৎসম হয়।

স্মর্তব্য : বাংলায় এমন কিছু শব্দ আছে যে শব্দগুলোর সংস্কৃত বানানে নাসিক্য বর্ণ ছিল কিন্তু নাসিক্য বর্ণ ছেড়ে তৎপরিবর্তে চন্দ্রবিন্দু ধারণ করে সংস্কৃত হতে পুরোপুরি বাংলায় চলে এসেছে। তাই চন্দ্রবিন্দুযুক্ত কোনো শব্দই তৎসম নয়। যেমন : চন্দ্র হতে চাঁদ, গ্রাম হতে গাঁও, বংশ হতে বাঁশ, অংশ হতে আঁশ প্রভৃতি তৎসম নয়।

সূত্র: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

তৎসম চেনার কৌশল।

#subach

Leave a Comment

অণ্ডকোষ লিঙ্গ এবং জ্ঞানচর্চা

. মোহাম্মদ আমীন

অণ্ডকোষ লিঙ্গ এবং জ্ঞানচর্চা

অর্কিড একটি ফুল। এটি সৌন্দর্য, আনন্দ, পরিচর্যা, নান্দনিক রসবোধ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। অনেকের কাছে নামটি নিজেই একটি মাধুর্য। গ্রিক orchis থেকে অর্কিড শব্দের উদ্ভব। যার অর্থ অণ্ডকোষ (লিঙ্গমূল)। ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে অণ্ডকোষ বা অর্কিড, ফুলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। গ্রিক ভাষার অর্কিড, মধ্যযুগে ইংরেজি ভাষায় বলকওয়ার্ট নামে পরিচিত ছিল। ইংরেজি bullocks থেকে শব্দটি এসেছে। এর অর্থ অণ্ডকোষ বা লিঙ্গমূল। আধুনিক ইংরেজি শব্দ balls এর প্রাচীন রূপ beallucas। এর অর্থও অণ্ডকোষ বা লিঙ্গ।

অ্যাভোকাডো বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি ফল। বাংলাদেশেও ফলটি পরিচিত। স্পেনিশ aquacate থেকে অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে অ্যাভোকাডো শব্দের উদ্ভব। স্পেনিশরা, মেক্সিকান ahuakati থেকে শব্দটি গ্রহণ করে। এর অর্থও অণ্ডকোষ বা লিঙ্গ (penis)। ফলটি দেখতে অণ্ডকোষের মতো। তাই আজটেকরা এর নাম দেন ahuakati বা অণ্ডকোষ।

পেন্সিল (pencil) শব্দের প্রাচীন অর্থ উটের পশমে তৈরী নরম তুলি, যা দিয়ে শিল্পীরা ছবি আঁকেন। এর সঙ্গে pen ও penis শব্দের গঠনগত এবং অর্থগত মিল রয়েছে। pencil কিন্তু ইংরেজি শব্দ নয়। চতুর্দশ শতকের প্রথম দিকে ফরাসি pincel থেকে ইংরেজি pencil শব্দের সৃষ্টি। ল্যাটিন penicillus থেকে pencil শব্দের

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

উদ্ভব। এর প্রায়োগিক অর্থ রংতুলি বা পেনসিল হলেও প্রকৃত অর্থ penicillus। বাংলায় যার অর্থ, ক্ষুদে লেজ। স্মতর্ব্য, ল্যাটিন ভাষায় ‘ছোট লেজ’ মানে ‘শিশ্ন’ বা লিঙ্গ। কারণ এটি দেখতে ছোটো লেজের মতো।

অতএব, জ্ঞানের বাহন পেনসিল শব্দের মুল অর্থ শিশ্ন বা লিঙ্গ। ইংরেজি ভাষার শব্দ penis এর বাংলা শিশ্ন বা লিঙ্গ। শব্দটিকে দুই ভাগ করলে হয় pen is । যার সোজা বাংলা, এটি একটি কলম এবং অন্তর্নিহিত অর্থ জ্ঞান, সৃষ্টির ধারক, জ্ঞানচর্চা, জ্ঞানের সাধনা প্রভৃতি। কারণ কলম ছাড়া জ্ঞানের সাধনা ও সৃষ্টির বিকাশ সম্ভব নয়, যেমন সম্ভব নয় লিঙ্গ ছাড়া। অতএব জ্ঞানসাধনার মৌলিক দণ্ড pencil/ pen শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থও শিশ্ন, লিঙ্গ বা অণ্ডকোষ।

ইংরেজি musk শব্দটি বাংলায় বহুল প্রচলিত কস্তুরী শব্দের তুল্য। musk সংস্কৃত ‘মুষ্ক’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ। সংস্কৃতে মুষ্ক অর্থ অণ্ডকোষ বা লিঙ্গ। ইংরেজিতে pick শব্দের অর্থ ‘বাছাই’।বাছাই মানে চিন্তা ভাবনা করে গ্রহণ করা। তাই এর গুঢ়ার্থও জ্ঞানসাধনা। নরওয়েজিয়ান ভাষায় শব্দটির অর্থ ‘শিশ্ন’ বা লিঙ্গ। ইংরেজি fitter ফিটার শব্দের অর্থ এমন একজন দর্জি যিনি মাপানুযায়ী কাপড় কাটেন। কিন্তু নরওয়েজিয়ান ভাষায় ফিটার শব্দের অর্থ ‘নারীর যৌনাঙ্গ’।

যিশু খ্রিষ্টের কাছে যে তিন জ্ঞানী বক্তি উপহার আনিয়েছিলেন, তাদের মাগি বা magi বলা হয়। প্রাচীন পারসিক পুরোহিতমণ্ডলকেও মাগি বলা হতো। শব্দটির উৎসার্থ, সৃষ্টি তাড়নায় বিধৌত নান্দনিক পরিজ্ঞান। যার সাধারণ অর্থ শিশ্ন। বাংলায় মাগি শব্দের মূল অর্থ নারী কিন্তু এখন যৌনকর্মী।

প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে বুদ্ধিকে ‘লিঙ্গজ্যেষ্ঠ’ বলা হয়েছে। তাই বুদ্ধি মানে লিঙ্গ এবং লিঙ্গ মানে বুদ্ধি। ‘লিঙ্গপুরাণ’ নামে একটি পুরাণ আছে। যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সবিস্তার বিবৃত। ল্যাটিন লিঙ্গ (lingua) হতে ফরাসি (langage) শব্দের উদ্ভব এবং তা হতে মধ্যযুগে ইংরেজি (language) শব্দটি এসেছে। বাংলা `লিঙ্গ’ শব্দের সঙ্গে ল্যাটিন লিঙ্গ (lingua) এবং বর্তমান ইংরেজী language শব্দের মিল রয়েছে। কারণ language বা আদি লিঙ্গই হচ্ছে সৃষ্টি বা জ্ঞানসাধনের উপায়।বাংলায় লিঙ্গ শব্দটি অনেকের মনে প্রথমেই নিয়ে আসে শিশ্ন (penis)। তারপর আনে বাংলা ব্যাকরণে ব্যবহৃত gender ধারণা বা স্ত্রীলিঙ্গ-পুংলিঙ্গ। যেভাবেই আসুক লিঙ্গ শব্দটি বরাবরই জ্ঞান ও সৃষ্টিকে নির্দেশ করে।

প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে এবং বর্তমান বহু অভিধানে লিঙ্গ শব্দের প্রথম অর্থ ‘জ্ঞানসাধন, সৃষ্টি, সৌন্দর্য এবং দ্বিতীয় অর্থ চিহ্ন, লক্ষণ, প্রতীক ইত্যাদি। তাই লিঙ্গার্চনা মানে জ্ঞানের চর্চা, সুন্দর এবং সৌকর্ষের বন্দনা। তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে শিবলিঙ্গের পূজা জ্ঞানচর্চার একটি প্রতীকী রূপ। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বঙ্গীয় শব্দার্থকোষে উল্লেখ আছে, শিব = শিখা বহনকারীে। যা বর্তমান অর্কিড-এর সঙ্গে তুল্য। তারা মনে করেন, শিবের মূর্তি জ্ঞানীদের চিন্তা-চেতনায় ফুটে ওঠা জগৎময় বিস্তৃত নান্দনিক অর্কিড। যা জ্ঞান, সৌন্দর্য ও সৃষ্টির অনন্ত উৎস।

সূত্র: বাংলা ভাষার মজা. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

বাল-আবাল, আবালবৃদ্ধবনিতা

. মোহাম্মদ আমীন

বাল-আবাল, আবালবৃদ্ধবনিতা

বাল: ‘বাল (√বল+অ)’ বাংলায় ব্যবহৃত একটি তৎসম শব্দ। এর আভিধানিক ও প্রায়োগিক অর্থ বালক, শিশু, কিশোর, প্রভৃতি। শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে : বালা ও বালি। বালা শব্দের অর্থ অল্পবয়সি মেয়ে, বালিকা, কন্যা, দুহিতা, যুবতী প্রভৃতি।‘বালি’ শব্দের অর্থ কিশোরী, বালিকা প্রভৃতি। ‘বাল’ শব্দ নিয়ে গঠিত শব্দরাশির কয়েকটি হলো : বালচর্চা (শিশুপালন),

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

বালবাচ্চা (ছোটো ছেলেমেয়ে), বালবিধবা (যে কন্যা বালিকা অবস্থায় বিধবা হয়েছে), বালবৈধব্য (বালিকা অবস্থায় বৈধব্যদশা), বালভোগ (বালক কৃষ্ণকে প্রদত্ত প্রাতঃকালীন ভোগ, বালভোগ্য (শিশুদের উপভোগের যোগ্য), বালসুলভ (বালকোচিত), বালসূর্য (নবোদিত সূর্য), বালশশী (শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদ) প্রভৃতি।

বালক: ‘বালক (বাল+ক)’ শব্দের অর্থ অল্পবয়স্ক পুরুষ সন্তান, অনূর্ধ্ব ষোলো বছরের পুরুষ, শিশু, অর্বাচীন, নির্বোধ, অপক্ব, অনভিজ্ঞ প্রভৃতি। ‘বালক’ শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে বালিকা।

আবাল: আ+বাল = আবাল। ‘বাল’ শব্দের ‘আ’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে ‘আবাল’ শব্দ গঠিত হয়েছে। বিস্তৃতি, পর্যন্ত, ব্যাপকতা প্রভৃতি প্রকাশে ‘আ’ উপসর্গটি ব্যবহৃত হয়। যেমন : আ + মৃত্যু = মৃত্যু পর্যন্ত। সে বিবেচনায় ‘আবাল’ শব্দের গঠনের সঙ্গে আকণ্ঠ, আপাদমস্তক, আমরণ, আসমুদ্রহিমাচল, আজীবন, আজন্ম প্রভৃতি শব্দের গঠনের মিল রয়েছে। গঠন অনুযায়ী আবাল শব্দের আভিধানিক অর্থ বাল্যাবধি, বাল্যকাল থেকে, অল্পবয়স থেকে, শিশুকাল থেকে প্রভৃতি। প্রসঙ্গত, আবাল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে আবালি।

আবালবৃদ্ধ: ‘আবালবৃদ্ধ (আবাল+√বৃধ্+ত)” শব্দের অর্থ হচ্ছে বালক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলে। এখানে শুধু বালিক ও বৃদ্ধের কথা বলা হয়েছে। কাজেই এটি পুঃলিঙ্গ জ্ঞাপক।

আবালবৃদ্ধবনিতা: আবালবৃদ্ধবনিতা শব্দটি আবাল, বৃদ্ধ ও বনিতা শব্দ নিয়ে গঠিত। সংস্কৃত বনিতা(=বনিত+আ) শব্দের অর্থ নারী, স্ত্রী, পত্মী, প্রেয়সী প্রভৃতি।বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, আবালবৃদ্ধবনিতা (=আবালবৃদ্ধ+√বন্+ইত+আ)’ শব্দের অর্থ বালক থেকে বৃদ্ধ এবং নারী পর্যন্ত সকলে।

অনেকে মনে করেন, ‘বাল’ শব্দের অর্থ ‘গোপনাঙ্গের কেশ’, এমন মনে করা সম্পূর্ণ অজ্ঞতা । অন্য ভাষার শব্দকে নিজ ভাষার শব্দার্থের সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হীনম্মন্যতাও বটে। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের কোথাও ‘বাল’ শব্দের অর্থ হিসেবে ‘গোপনাঙ্গের কেশ’ উল্লেখ নেই। তবে কেউ কেউ শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। শুবাচে অপ্রাসঙ্গিকভাবে গালি হিসেবে শব্দটি উত্থাপন না-করার অনুরোধ রইল।

সূত্র: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, . মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

চিকা মারা ও চিকা: চিকা মারো মারে রে

. মোহাম্মদ আমীন

চিকা মারা ও চিকা: চিকা মারো মারে রে

‘চিকা’ একটি দেশি শব্দ। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে ‘চিকা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, ছোটো চোখ ও সুচালো মুখবিশিষ্ট ঘন কোমল লোমাবৃত গাঢ় ধূসরবর্ণের স্তন্যপায়ী গায়ে দুর্গন্ধযুক্ত নিশাচর ইঁদুরজাতীয় প্রাণী, ছুঁচা, ছুঁচো, গন্ধমূষিক প্রভৃতি। চট্টগ্রাম এলাকায়ও  ‘চিয়া’ নামে পরিচিত। ‘চিকা’ শব্দের আর একটি অর্থ- গুণচিহ্ন (x)বা ঢ্যারাচিহ্ন। ‘চিকা’ ও ‘মারা’ শব্দ হতে ‘চিকা মারা’ কথার উদ্ভব। বাক্যে ক্রিয়াবিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ‘চিকা মারা’ কথাটির আভিধানিক অর্থ দেওয়ালে লিখে বিজ্ঞাপিত করা, ছাপ মারা, ঢ্যারাচিহ্ন দেওয়া প্রভৃতি।

‘দেওয়াল লিখন’ বা দেওয়ালে লিখে বিজ্ঞাপিত করা কথাগুলো এখন ‘চিকা মারা’ কথাটির আড়ালে হারিয়ে গেছে। দেওয়াল লিখন বলিতে এখন ‘চিকা মারা’

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

বোঝায়। ‘চিকা’ বিশেষ্য হলেও ‘চিকা মারা’ কিন্তু ক্রিয়াবিশেষণ। চিকার বয়স যতই হোক, ‘চিকা মারা’ কথার বয়স বেশি দিনের নয়। তাহলে শব্দটির উৎপত্তি কখন এবং কীভাবে? এ নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, এই গল্পের সূত্রে ‘চিকা মারা’ কথাটির উদ্ভব। আবার অনেকে মনে করেন, এটি নিছক গল্প। আগে গল্পটি কী দেখা যাক :

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন কারণে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গাছের ছোটো ছোটো ডাল ভেঙে ডালের আগা থেঁতলিয়ে ব্রাশের ন্যায় তুলি বানাত। নিচে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের উপরের অংশেও যাতে স্লোগান লেখা যায় সে জন্য তুলিগুলোকে লাঠির মতো লম্বা করে বানানো হতো। সে সব ব্রাশ বা তুলিতে আলকাতরা লাগিয়ে দেওয়ালে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের পক্ষে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হতো। স্লোগানসমূহে কড়া ভাষায় হুমকি দেওয়া হতো সরকারকে। এখনকার মতো তখনও সরকার-বিরুদ্ধ স্লোগান লেখা ছিল নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ কাজ করলে গ্রেফতার করা হতো। গ্রেফতারের ভয়ে শিক্ষার্থীরা সাধারণত রাতের বেলা টর্চ জ্বালিয়ে দেওয়ালে এ সব স্লোগান লিখতেন।

কথিত হয়, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের কোনও এক রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী  গাছের ডাল দিয়ে তৈরি লাঠি-আকৃতির লম্বা ব্রাশ দিয়ে দেওয়ালে স্লোগান লিখছিলেন। এ সময় একদল টহল পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখে শিক্ষার্থীরা ঝোপের আড়ালে আলকাতরার টিন লুকিয়ে লাঠির মতো লম্বা তুলি দিয়ে ঝোপঝাড়ে এলোপাথারি আঘাত করতে শুরু করে।টহল পুলিশ এগিয়ে এসে বলল, এত রাতে তোমরা বাইরে কী করছ?শিক্ষার্থীরা বলল, হলে চিকার জ্বালায় থাকতে পারছি না। ঝোপ দিয়ে হলে চিকা ঢুকে। আমরা লাঠি দিয়ে চিকা মারছি।

শিক্ষার্থীদের কথায় পুলিশের সন্তুষ্ট না-হয়ে কোনও উপায় ছিল না। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছিল একতলা এবং অধিকাংশ টিনসেডে ও স্যাঁতস্যঁতে মেঝে। পাশে ছিল ঝোপঝাড়, সেখান থেকে চিকা হলে হানা দিত। শুধু হলে নয়, পুলিশের ব্যারাকেও চিকার উপদ্রব ছিল। পুলিশ দল সন্তুষ্টচিত্তে চলে যায়। শিক্ষার্থীরা এবার দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল চিকা মারার ভানে ঝোপঝাড়ে আঘাত করতে থাকে আর এক দল দেওয়াল লিখন শুরু করে। এরপর থেকে ‘দেওয়াল লিখন’ লিখতে গেলে শিক্ষার্থীরা বলত চিকা মারতে যাচ্ছে। অনেকে আগে থেকে কয়েকটা চিকা মেরে সঙ্গে নিয়ে যত। এভাবে ‘দেওয়াল লিখন’ বাগভঙ্গিটি ‘চিকা মারা’ শব্দে পরিণত হয়। এখন শুধু দেওয়ালে নয়, রাস্তাতেও ‘চিকা মারা’ হয়, গাড়িতে এমনকি শরীরেও ‘চিকা মারা’ হয়।

‘চিকা মারা’ শব্দের উৎপত্তি নিয়ে উপরে বর্ণিত গল্পটির সত্যতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ পোষণ করেন। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে ‘চিকা’ শব্দের দুটি অর্থ। একটি হচ্ছে- ছুঁচা, ছুঁচো, গন্ধমূষিক প্রভৃতি এবং অন্যটি হচ্ছে- গুণচিহ্ন বা ঢ্যারাচিহ্ন।বৈয়াকরণিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ছুঁচো অর্থ প্রকাশক ‘চিকা’ হতে নয়, বরং গুণ চিহ্ন বা ঢ্যারাচিহ্ন প্রকাশক ‘চিকা’ শব্দ হতে ‘চিকা মারা’ কথার উদ্ভব।

উৎস: বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

#subach/

 

Leave a Comment

অহংকার ও ব্যক্তিত্ব; ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব; অহংকার বনাম অহঙ্কার— কোনটি সঠিক

ড. মোহাম্মদ আমীন

অহংকার ও ব্যক্তিত্ব; ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব; অহংকার বনাম অহঙ্কার— কোনটি সঠিক

অহংকার ও ব্যক্তিত্ব:অহংকার’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ— গর্ব, বড়াই, অহমিকা, হামবড়ামি। অহমিকা, অহমহমিকা প্রভৃতি অহংকার শব্দের সমার্থক। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে,অহংকার (অহম্+√ কৃ+অ) অর্থ অহমিকা, গর্ব, দম্ভ, বড়াই; আত্মচেতনা, অহংজ্ঞান, অভিমান। ব্যক্তিত্ব: তৎসম ‘ব্যক্তিত্ব (ব্যক্তি+ত্ব)’ অর্থ— (বিশেষ্যে) ব্যক্তিবিশেষের বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তির প্রকৃতি, ব্যক্তির সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য। ইংরেজিতে personality।যেমন: আমার বাবার ব্যক্তিত্ব আমার খুব প্রিয় ছিল। করিম নামের শিক্ষকটির ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করে। এই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব আমাকে মোহিত করে দিয়েছে।

ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব: “বাবা আমার প্রিয় ব্যক্তি। বাবাআমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। কোন বাক্যটি শুদ্ধ? বাবা আমার প্রিয় ব্যক্তি’’ বাক্যটি সঠিক। ব্যক্তি: সংস্কৃত ব্যক্তি (বি+√অন্‌জ্+তি) অর্থ— (বিশেষ্যে) লোক, মানুষ; প্রকাশ (অভিব্যক্তি); ইংরেজিতে individual। যেমন: আমার বাবা আমার প্রিয় ব্যক্তি। ব্যক্তিটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। ব্যক্তিবিশেষের প্রতি আমার কোনো অবহেলা নেই। ব্যক্তিত্ব: সংস্কৃত ব্যক্তিত্ব (ব্যক্তি+ত্ব) অর্থ— (বিশেষ্যে) ব্যক্তিবিশেষের বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তির প্রকৃতি, ব্যক্তির সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য। ইংরেজিতে personality। যেমন: আমার বাবার ব্যক্তিত্ব আমার প্রিয়। করিম নামের ব্যক্তিটির ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করে এই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব আমাকে মোহিত করে দিয়েছে। ব্যক্তি হচ্ছে বস্তুগত বিষয়— স্পর্শ করা যায়, ধরা যায়, দেখা যায়। এটি মানুষ বা লোক অর্থ প্রকাশ করলে গণনা করা যায়। ব্যক্তিত্ব অদৃশ্য বিষয়— ধরা যায় না; কেবল অনুভব করা যায়। ব্যক্তিত্ব কখনো গণনা করা যায় না। যদি কেউ বলেন, “বাবা আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব”। বাক্যটি আভিধানিক অর্থে সঠিক নয়। সঠিক বাক্যটি হবে, “বাবা আমার প্রিয় ব্যক্তি।”

অহংকার ও ব্যক্তিত্বের পার্থক্য: মূলত সংস্কৃত অহমহমিকা শব্দ হতে অহমিকা শব্দের উৎপত্তি। অহমহমিকা অর্থ দুজনের মধ্যে পরস্পর আমিই বড়ো, আমিই শ্রেষ্ঠ, আমিই উত্তম— এমন হামবড়া ভাব ও অযৌক্তিক দাবি। সর্বক্ষণ নিজেকে বড়ো ভাবা এবং অন্যকে নিজের তুলনায় ছোটো মনে করাই হচ্ছে অহংকার। যার মনে এমন বোধ ও চেতনা থাকে সে অহংকারী। অহংকার সর্বক্ষণ একজন মানুষকে আত্মশ্রেষ্ঠত্বে বিভোর রাখে বলে সে কখনো শান্তি পায় না। অহংকার নিয়ে বাংলা ভাষায় অনেক চমৎকার ও হৃদয়গ্রাহী কবিতা রয়েছে। ‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই বলে যদি ডাকো গলা দেব টিপে’; আনারস কাঁঠালকে বলে তুমি বড়ো খসখসে; ছালুনি বলে সুঁই, তোমার মাথায় ছ্যাঁদা। এগুলো সব অহংকারীর স্বভাব-প্রকাশক উক্তি।

প্রাত্যহিক জীবনে অহংকার কী? সহজ কথায়, ব্যক্তিত্বের বাজে অংশটাই অহংকার। গৃহীত খাদ্যের বাজে অংশটা যেমন মল, তেমনি ব্যক্তিত্বের বাজে অংশটা অহংকার। ইংরেজিতে যাকে বলে ইগো। ইগো আর গু দুটোই একই। তাই উভয়কে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার মতো অতি সাবধানে নড়াচড়া করতে হয়। জীবের জন্য গু অপরিহার্য। তাই বলে কেউ এটি শরীর-মাথায় কিংবা জামা-কাপড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। গু নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষকে কেউ সহ্য করতে পারে না। তেমনি পারে না ইগো বা অহংকার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষকে। দুজনই হতভাগা ও বন্ধুহীন। শিক্ষা মানুষকে নিরহংকার,কিন্তু ব্যক্তিত্ববান করে তুলে। শিক্ষা যদি অহংকারকে ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে না পারে তাহলে সে শিক্ষা বৃথা। শিক্ষার চেয়ে শিক্ষিত হওয়ার অহংকার যার মধ্যে প্রবল তার চেয়ে নিকৃষ্ট আর কে হতে পারে? কেউ না। অনেক অফিসারদের মধ্যে প্রচণ্ড অহংকার দেখা যায়। পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অহংকারের মাত্রাও বেড়ে যায়।  অফিসার হওয়ার পর যার মধ্যে অমায়িক আর সেবাপরায়ণ হওয়ার চেয়ে অহমিকাবোধ প্রবল হয়ে উঠে তার চেয়ে ইতর আর কেউ হতে পারে না। এমন বোধ জন্ম নেওয়ায় তারা সাধারণ মানুষকে মনে করে দাস। নিজেদের মনে করে তাদের প্রভু।

“এরা শক্তের ভক্ত, এরা নরমের যম;
দুর্বলকে পিষ্ট করে, সবল পূজে পরম।
নিরীহদের তুই-তুকারি, বসকে বলে হুজুর,
সাধারণকে মনে করে বিড়াল-মাছি-কুকুর।
এদের ফুটানি বেশি, জানে কম—
এরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম।” — লেখক কেন মরে, ড. মোহাম্মদ আমীন

অহংকার বনাম অহঙ্কার: অহঙ্কার কি অশুদ্ধ: প্রমিত বানানবিধি অনুযায়ী, সংস্কৃত নিয়মে ম্-এর স্থলে অনুস্বার লেখা বিধেয়। যেমন: সম্‌+গীত= সংগীত; বিকল্পে সঙ্গীত; অলম্‌+কার= অলংকার; বিকল্পে অলঙ্কার। অনুরূপ: অহংকার ও বিকল্পে অহঙ্কার। সুতরাং, অহংকার ও অহঙ্কার (বিকল্পে ) দুটোই শুদ্ধ। তবে, বাংলা বানানের সমতা ও আদর্শ মান রক্ষার স্বার্থে অহংকার লেখা সমীচীন। বিকল্পে না যাওয়াই উত্তম। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে কেবল ‘অহংকার’ শব্দকে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে।

#subach

Leave a Comment

প্রতিভা ও মেধা: প্রতিভা ও মেধার পার্থক্য

ড. মোহাম্মদ আমীন

প্রতিভা ও মেধা: প্রতিভা ও মেধার পার্থক্য

বাক্যে সাধারণত বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘প্রতিভা’ শব্দের অর্থ হলো : প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, প্রজ্ঞা, উদ্ভাবনী জ্ঞান, উদ্ভাবনী বুদ্ধি, তীক্ষ্ণবুদ্ধি প্রভৃতি। ক্ষেত্র বিশেষে প্রভা বা ঔজ্জ্বল্য প্রকাশেও `প্রতিভা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।  প্রতিভা আছেন এমন কাউকে প্রতিভাধর বা প্রতিভাবান বলা হয়। অর্থ হতে দেখা যাচ্ছে, প্রতিভাবানগণ একই সঙ্গে সৃজনশীল ও বুদ্ধিমান। শব্দটির কয়েকটি পদার্থ দেখুন :

  • (১) ভাষা মানুষের প্রতিভার উজ্জ্বল দৃ্ষ্টান্ত।
  • (২) চাকা প্রতিভাবান মানুষের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।
  • (৩) জামাল নজরুল ইসলাম বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভার অধিকারী একজন বাংলাদেশি।

‘প্রতিভা’ শব্দে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, প্রজ্ঞা এবং উদ্ভাবনী জ্ঞান বা উদ্ভাবনী বুদ্ধির অনিবার্যতা রয়েছে। একজন লোক বা বস্তুকে প্রতিভাবান হতে হলে তার

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

সৃজনশীলতা থাকতে হবে। এখানে স্মৃতিশক্তি বা স্মরণশক্তি কিংবা মুখস্থশক্তির প্রয়োজন নেই। কেউ কোনো কিছু আবিষ্কার করে মুহূর্তের মধ্যে ভুলে যেতে পারে, কারো কোনো কিছু মনে না-ও থাকতে পারে এজন্য তাকে মেধাবী বলা না-গেলেও প্রতিভাবান বা প্রতিভাধর বলা যায়। আবার কেউ যদি কোনো কিছু স্মরণশক্তিতে ধরে রাখতে পারে, কিন্তু সামান্য সৃজনশীলতাও না থাকে, তো তাকে মেধাবী বলা যায়; কিন্তু প্রতিভাধর বলা যাবে না। সে হিসাবে প্রশিক্ষিত পশু, তোতপাখি, ডলফিন, কম্পিউটার, ক্যালকুলেটের প্রভৃতিকেও মেধাবী বলা যায়। বর্ডার কলি (Border collie) জাতের কুকুর তো রীতিমতো মেধা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে।

বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘মেধা’ শব্দের অর্থ স্মরণশক্তি, স্মৃতিশক্তি, ধীশক্তি, বোধশক্তি; সহজ কথায় মুখস্থশক্তি । সংস্কৃত ‘ধীশক্তি’ শব্দের অর্থ বুদ্ধিশক্তি। বুদ্ধি শব্দের অর্থ বোধ, জ্ঞান, বিচারশক্তি প্রভৃতি। সবগুলো অর্থ বিশ্লেষণ করে একিভূত করা হলে মেধা শব্দের অর্থ হয় : স্মরণশক্তি, স্মৃতিশক্তি, মুখস্থশক্তি, বুদ্ধিশক্তি, বোধশক্তি, জ্ঞানশক্তি, বিচারশক্তি প্রভৃতি। অর্থাৎ যার স্মরণশক্তি বা বুদ্ধি আছে, তাদের মেধাবী বলা হয়। এদের মধ্যে যারা বুদ্ধি বিক্রি করে খায়, তাদের বলা হয় বুদ্ধিজীবী (Intellectuals)। এবার মেধা ও প্রতিভার পদার্থ কী জানা যাক :

  • (৫) মেধাশক্তির (স্মরণশক্তি) উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে বাংলাদেশি শিশুরা প্রতিভাচ্যুত হয়ে পড়ছে।
  • (৬) মেধাবী ছেলেটি প্রতিবছর প্রথম হয়ে পাস করে, তবে প্রতিভার অভাবে পাঠ্যপুস্তুকের বাইরের কিছুই জানে না।
  • (৭) মেধা দিয়ে ভালো নম্বর পাওয়া যায়, কিন্তু ভালো কিছু সৃষ্টি করার জন্য শুধু নাম্বার যথেষ্ট নয়, প্রতিভা আবশ্যক।

মেধা শব্দের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার যোগসূত্র থাকলেও ‘মেধা’র জন্য সৃজনশীলতা অনিবার্য নয়, কেউ সৃজনশীল না-হলেও কেবল স্মরণশক্তি বা বুদ্ধি থাকলে মেধাবী হয়ে যেতে পারে। যেমন : বাংলাদেশের অধিকাংশ শিশু, যারা প্রতিবছর জিপিএ-ফাইভ নিয়ে পাস করে তাদের সিংহভাগেরই প্রতিভা নেই, তবে মেধা আছে; কারো কারো বুদ্ধিও আছে। তারা মেধার জোরে ভালো সনদ অর্জন করে, কিন্তু প্রতিভাতে অনেকেই শূন্য। মেধাবীরা স্মরণশক্তির জোরে অর্জিত সনদ নিয়ে ভালো চাকুরি পায়, তবে তাদের মধ্যে সৃজনশীল হওয়ার নজির সংখ্যা, পরিমাণ এবং গুরুত্বের দিক থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। বর্ডার কলি (Border collie) জাতের কুকুর মেধা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে, শিক্ষা তাকে আরও মেধাবী করে তোলে, কিন্তু প্রতিভাধর করতে পারে না।কারণ তাকে যা শেখানো হয় কেবল সেটাই পারে, ওই শেখানো দিয়ে নতুন কিছু করতে পারে না। 

যেসব মেধাবীরা সৃজনশীল তারা একই সঙ্গে প্রতিভাধরও, কারণ সৃজনশীলতাই হচ্ছে আসল মেধাত্ব। সারা পৃথিবীর প্রসিদ্ধ জ্ঞানী-বিজ্ঞানী আর কবিসাহিত্যিকদের দিকে তাকালে বোঝা যায়, মেধাবীরা অর্থাৎ ভালো নাম্বরদারীরা নয়, বরং প্রতিভাধরেরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারসমূহ করেছেন। নিউটন-আইনস্টাইন, এডিসন, জগদীশচন্দ্র প্রমুখ বিজ্ঞানীগণ স্মরণশক্তিতে এতই দুর্বল ছিলেন যে, নিজের বাড়ির ঠিকানা, স্ত্রীর নাম, সন্তানের চেহারা, মেয়ের বিয়ের তারিখ পর্যন্ত মনে রাখতে পারতেন না। নিউটন তো ‘নয় পাঁচে’ কত তার হিসাব কষতেই ঘেমে যেতেন; বলতেন- এত কঠিন হিসাব আমি কীভাবে করব?  তারা

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

মেধাবী নন, প্রতিভাধর। বিশ্বখ্যাত সৃজনশীলদের ৮৯.৭ ভাগই ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন না, তাঁদের স্মরণশক্তি ছিল দুর্বল। এই প্রসঙ্গে, নিউটন, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, আরজ আলী মাতুব্বর, এডিসন, মোহিতলাল মজুমদার এবং তেসলা-সহ আরো অনেকের কথা উল্লেখ করা যায়। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী গ্রেগর মেন্ডেল (Gregor Mendel), ডোনাল্ড জি হার্ডেন (Donald G. Harden), শ্রীনিভাস রামানুজান (Srinivasa Ramanujan) ও মাইকেল ফ্যারাডে (Michael Faraday) অশিক্ষিত ছিলেন। স্বশিক্ষায় ছিল তাদের বিশ্বপাল্টানো আবিষ্কারের মুল।

অর্থ বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিভা ও মেধা সমার্থক শব্দ নয়। যদি (১) নম্বর বাক্য পরিবর্তন করে লেখা হয় : ভাষা মানুষের মেধার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তা ঠিক হবে না। পশু-পাখিরও মেধা থাকতে পারে, কিন্তু প্রতিভা থাকা অবিশ্বাস্য। যেমন : পশুপাখির চিৎকার ইঙ্গিতবাহী বা অনুধাবনযোগ্য হলেও ভাষা নয়। কারণ তাদের ইঙ্গিতে সৃজনশীল কিছু নেই, কেবল স্মরণশক্তিই কাজ করে। এর বাইরে সে যেতে পারে না। উপরের আলোচনা হতে বলতে পারি, সংকীর্ণ বিবেচনায় বুদ্ধিমান, প্রতিভাধর আর মেধাবী সমার্থক, কিন্তু কার্যকরণগত তফাত যোজন যোজন। অনেকে আটপৌরে কথায় প্রতিভা আর মেধাকে সমার্থক বলললে তা আদৌ ঠিক নয়। তাহলে প্রতিভা ও মেধার কার্যকরণগত পার্থক্য কী?

এককথায়, মেধাবীরা সমস্যার সমাধান করে, প্রতিভাবানেরা ওই সমস্যাকে প্রতিহত করে। আমার মতে এটাই উভয় শব্দের কার্যকরণগত পার্থক্য। ভবনে অগ্নিকাণ্ডের আগমন বন্ধ করা মেধাবীর কাজ, কিন্তু অগ্নিকাণ্ড যাতে আঘাত না করে তা ভবন নির্মাণের সময় থেকে প্রতিহত করার কৌশল দিয়ে অগ্রসর হওয়া মেধাবীর কাজ। অতএব, মেধাবী উত্তম না কি প্রতিভাধর – এই প্রশ্নে না গিয়ে ভাবুন, দুটোই আমাদের প্রয়োজন। তবে প্রতিভার শক্তি মেধাবীদের প্রয়াসকে আরো কার্যকর এবং শানিত করে তোলে।

#subach/

Leave a Comment

কাচ পচা যাবৎ তফাত দাঁড়ি দাড়ি গাঁ গা সাধারণ ও পর্যবেক্ষণ: নিমোনিক প্রমিত বাংলা বানান

ড. মোহাম্মদ আমীন

  • কাচ: কাচ বানানে চন্দ্রবিন্দু নেই। কাচের জিনিস ভেঙে গেলে চন্দ্রও ভেঙে যেতে পারে। তাই কাচ বানানে চন্দ্রবিন্দু দেবেন না। একটা মাত্র চাঁদ, ভেঙে গেলে জ্যোৎস্না আপুর কী হবে?
  • পচাপচা বানানে চন্দ্রবিন্দু নেই। যেমন: পচা মাছ। পচা জায়গায় চন্দ্র থাকে না। পচা মাথায় চন্দ্রবিন্দু দেবেন না। পাঁচ-এর মাথায় দেবেন।
  • পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি

    যাবৎ: যাবৎ বানানে ত নেই, ৎ দিতে হবে। যাবৎ বানানে আস্ত-ত দিলে ‘যাব ত’ হয়ে যাবে। যাবৎ আর ‘যাব ত’ এক জিনিস নয়।

  • এযাবৎ: এযাবৎ লিখুন, এযাবত লিখবেন না।
  • তফাত: তফাত বানানে ৎ নেই, দুটোই আস্ত-ত। কাউকে আস্ত-ত আবার কাউকে খণ্ড-ৎ দিলে পাপ হবে। ন্যয়বিচার করুন। আল্লাহ দয়া করবেন।
  • উচিত: উচিত বানানে ৎ দেবেন না। প্রিয়জনের জন্য খণ্ড জিনিস নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। উচিত মানুষ কখনো অনুচিত কাজ করে না।
  • দাড়ি, দাঁড়ি: মুখের দাড়িতে চন্দ্রবিন্দু নেই, কিন্তু বাক্যের দাঁড়িতে চন্দ্রবিন্দু লাগবে। মুখের দাড়ি ঝুলে থাকে। তাই চন্দ্রবিন্দু পড়ে যায়। বাক্যের দাঁড়ি, দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথায় দাঁড়া বানানের চন্দ্রবিন্দু দিলে পড়ে না।
  • গা গাঁ: গা যদি শরীর হয় চন্দ্রবিন্দু দেবেন না। গাঁ যদি গ্রাম হয়, চন্দ্রবিন্দু দিতে হয়। শরীরের ওপর চন্দ্রবিন্দু থাকে না; গ্রামের ওপর চন্দ্রবিন্দু থাকে।
    কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো রূপকথা নয় সে নয়—। হেমন্ত বাবুর গানটি মনে রাখবেন।
  • সাধারণ: ‘সাধারন’ নয়, ‘সাধারণ’। তৎসম শব্দে র-এর পরের ন, ণ হয়ে যায়।
  • পর্যবেক্ষণ: ‘পর্যবেক্ষন’ নয় লিখুন ‘পর্যবেক্ষণ’। তৎসম শব্দে ষ বা ক্ষ (ক্‌+ষ)-এর পরের ন, ণ হয়ে যায়।
উৎস: নিমোনিক প্রমিত বাংলা বানান অভিধান, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

প্রয়োগ বনাম ব্যবহার: প্রয়োগ এবং ব্যবহার শব্দের পার্থক্য

. মোহাম্মদ আমীন

প্রয়োগ বনাম ব্যবহার: প্রয়োগ এবং ব্যবহার শব্দের পার্থক্য

বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘প্রয়োগ’ শব্দের অর্থ প্রযুক্তির ব্যবহার, ব্যবহারের ধরণ, নিয়োগ, দৃষ্টান্ত, ব্যবহার, উল্লেখ প্রভৃতি। ‘প্রয়োগ’ শব্দের ছয়টি অর্থ দেওয়া হলেও সাধারণত ‘প্রয়োগ’ শব্দটি প্রযুক্তির ব্যবহার, ব্যবহারের ধরণ, দৃষ্টান্ত, উল্লেখ এবং কার্যকারতা প্রভৃতি অর্থে অধিক ব্যবহৃত হয়। আমি মনে করি, ‘প্রয়োগ’ শব্দটি প্রযুক্তি, ব্যবহারের ধরণ, বাক্যবিশেষে ব্যবহার প্রভৃতি অর্থে স্থাপন করা অধিক সমীচীন। অর্থ প্রকাশে বিঘ্ন ঘটার শঙ্কা থাকার কারণ ঘটে বলে ইংরেজি use অর্থ প্রকাশে  ‘প্রয়োগ’ শব্দটি যত কম ব্যবহার করা যায় তত ভালো। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘প্রয়োগ’ এবং ‘ব্যবহার’ অভিন্নার্থে ব্যবহার করলেও বাক্যের গুণগত মান বা অর্থের তারতম্য হবে না। যেমন : “বল শব্দের তিনটি ভিন্নার্থক প্রয়োগ দেখান।” এই বাক্যে আপনি ‘প্রয়োগ’ শব্দের স্থলে ‘ব্যবহার’ লিখতে পারেন।এবার শব্দটির পদার্থ দেখা যাক :

  • ১. বানরের উপর এই ওষুধটি প্রয়োগ করে দেখতে পারেন।
  • ২. তোমার ব্যবহার ভালো ছিল, কিন্তু প্রয়োগটা শোভনীয় ছিল না।
  • ৩. প্রয়োগটি (দৃষ্টান্ত) যথার্থ ছিল।

বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘ব্যবহার’ শব্দের অর্থ – আচরণ (মার্জিত ব্যবহার), স্বভাব, মামলা-মোকাদ্দমা, আইন(ব্যবহারজীবী), কাজে প্রয়োগ (ব্যবহার করা), বিষয়কর্ম, বাণিজ্য। ‘ব্যবহার’ ‘শব্দের’ এতগুলো অর্থ থাকলেও বাক্যে এসব অর্থ পেতে হলে আপনাকে বাক্য বুঝে তা বসাতে হবে। ‘ব্যবহার’ শব্দটি সাধারণত আচরণ, আইনজীবী, কাজে প্রয়োগ, সাধারণ স্বভাব প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে অধিক ব্যবহৃত হয়। যেমন :

  • ৪. তার ব্যবহার (আচরণ) ভালো ছিল না।
  • ৫. ব্যবহারজীবী (আইনজীবী) হিসেবে তিনি ব্যবহারে (মামলা-মোকাদ্দমা) বেশ দক্ষ।
  • ৬. যন্ত্রটির ব্যবহার (প্রয়োগ) তুমি জানো কি?
  • ৭. এটিই তার জন্মগত ব্যবহার (স্বাভাবিক আচরণ)।

‘প্রয়োগ’ শব্দের একটি অর্থ ‘ব্যবহার’ হিসেবে উল্লেখ থাকায় অনেকে বলেন, ‘প্রয়োগ’ ও ‘ব্যবহার’ শব্দকে সমার্থক মনে করা যায়। কিন্তু এই সমার্থকতা সব বাক্যে সর্বস্থানে বসানোর চেষ্টা করলে বাক্যের অর্থে ভীষণ অনর্থ ঘটতে পারে। যেমন : “তুমি আমার গাড়িটা কিছুদিন ব্যবহার করতে পারো।” বাক্যটি যদি আপনি এভাবে লিখেন, “ তুমি আমার গাড়িটা কিছুদিন প্রয়োগ করতে পারো”, তাহলে বিষয়টা হাস্যকর হয়ে যাবে। যেখানে ‘ব্যবহার’ শব্দটি কারো আচরণকে প্রকাশের জন্য প্রয়োগ করা উচিত , সেখানে ‘প্রয়োগ’ শব্দ দিয়ে তা করতে গেলে আপনি অজ্ঞতার পরিচয় দেবেন। যেমন: “বয়স্ক লোকটার সঙ্গে তোমার এমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি।” বাক্যটি যদি আপনি লিখেন “বয়স্ক লোকটার সঙ্গে তোমার এমন প্রয়োগ করা উচিত হয়নি”। কেমন হবে? ‘ব্যবহার’ শব্দের আর একটি প্রয়োগ আইনজীবী নির্দেশে। আইনজীবীর অপর নাম ব্যবহারজীবী, ‘ব্যবহার’ এবং ‘প্রয়োগ’ সমার্থক ধরে নিয়ে যদি লিখেন, আমার বাবা একজন প্রয়োগজীবী, তাহলে অনর্থ অনিবার্য।

অতএব, ‘প্রয়োগ’ এবং ‘ব্যবহার’ শব্দের প্রয়োগ ও ব্যবহারে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। আচরণ, স্বভাব, আইনজীবী, প্রকাশে ব্যবহার শব্দটি নিশ্চিত ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু কার্যকারত, প্রযুক্তি কিংবা ব্যবহারের ধরণ প্রভৃতি। প্রকাশে ‘প্রয়োগ’ শব্দের ব্যবহার অধিকতর নিরাপদ। যে যাই বলুন,  ‘প্রয়োগ’ ও ‘ব্যবহার’ বড়ো হতভাগা।  আমরা প্রত্যহ কতভাবে শব্দদুটো ব্যবহার করছি,  কত কৌশল-অকৌশলে প্রয়োগ করে যাচ্ছি; তবু বেচারদ্বয়র উপস্থিতি কবিতায় আর গানে নেই বললেই চলে। কাজের লোকের মতো কাজের শব্দও ভালো আসনে বসতে পারে না, সবাই অপাঙ্‌ক্তেয় রেখে দেয়।

“রাগ করো না ‘প্রয়োগ’ তুমি, রাগ করো না ‘ব্যবহার’

অপাঙ্‌ক্তেয় নও তোমরা পঙ্‌ক্তি-ভরা রূপ বাহার।” 

উৎস: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

Leave a Comment

অপরাধ দোষ ত্রুটি ও ভুল: পার্থক্য বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগ

ড. মোহাম্মদ আমীন

অপরাধ দোষ ত্রুটি ও ভুল: পার্থক্য বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগ

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, “বসে আছি পথ চেয়ে ফাগুনের গান গেয়ে/ যত ভাবি ভুলে যাব মন মানে না- –।” এই পঙ্‌ক্তিদ্বয়ে ‘ভুল’ শব্দের স্থলে কি অন্য শব্দ চলে? চলে না। নজরুল লিখেছেন, “ কেউ ভোলে না কেউ ভোলে, অতীত দিনের স্মৃতি—”। এই দুই ক্ষেত্রেই  নজরুল আর হেমন্ত- উভয়ের ‘ভুল’ অভিন্ন অর্থ বহন করে। কিন্তু , “ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি, ক্ষমিও সে অপরাধ।” নজরলের এই ভুলের অর্থ আগের দুই ভুলের মতো বিস্মৃতি নয়, দোষ, ভ্রান্তি প্রভৃতি। 

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অপরাধ, দোষ, ত্রুটি ও ভুল পরস্পর সমার্থক মনে হলেও, তা কদাচিৎ; প্রকৃতপক্ষে তারা, বিশেষ করে ‘অপরাধ’ ও বাকি তিনটি শব্দ  বিরল ক্ষেত্রে সমার্থক।  প্রত্যেকটির রয়েছে স্বকীয়তা, নিজস্ব অর্থ দ্যোতনা। দোষ ও ত্রুটি কখনও ভুল হতে পারে, না-ও হতে পারে; অপরাধের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। সৈয়দ আবদুল হাদী গেয়েছেন, “আমার দোষে দোষী আমি নিজের বিচার চাই, আমার ভুলের কোনো ক্ষমা নাই।”  এখানে ‘দোষে’ পদের অর্থ অপরাধে, ‘দোষী’ পদের অর্থ অপরাধী এবং ‘ভুলে’ পদের অর্থ বিস্মৃতি।

সংস্কৃত ‘অপরাধ’ শব্দের অর্থ গর্হিত কাজ, দোষ, ত্রুটি, পাপ, অধর্ম প্রভৃতি। বাক্যে শব্দটি সাধারণভাবে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরাধের সঙ্গে আইনগত বিষয় অধিক জড়িত। সাধারণত গর্হিত কাজ, পাপ, অধর্ম প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে ‘অপরাধ’ শব্দটি অধিক ব্যবহৃত হয়।  যেমন : “চৌর্যবৃত্তি একটি অপরাধ”। শব্দার্থ বিবেচনায় ‘অপরাধ’ শব্দটির একটি অর্থ ‘দোষ/ত্রুটি’ দেখা গেলেও পদার্থ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘দোষ’ ও ‘ত্রুটি’ প্রকাশে বাক্যে অপরাধ শব্দটি তেমন ব্যবহার হয় না। তবে মাঝে মাঝে অপরাধ শব্দটি ‘দোষ’ প্রকাশেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। নজরুল, কিন্তু সুন্দর প্রিয়তমার দিকে তাকানোকেও অপরাধ গণ্য হতে দেখেছেন : “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মার অপরাধ/ চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিনী বলে না তো কিছু চাঁদ”। নজরুলের এই গানে সাধারণভাবে ‘অপরাধ’ শব্দের অর্থে দোষ শব্দটিও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এখন মেয়েদের দিকে, বিশেষ করে সুন্দর মেয়েদের দিকে তাকানো দোষ নয়, তার চেয়ে মারাত্মক এবং সেটি হচ্ছে অপরাধ। এজন্য আপনি নারী উত্যক্ত করার অপরাধে দোষী হতে পারেন, মামলা হয়ে যেতে পারে ‘নারী নির্যাতন’ আইনে। 

সংস্কৃত ‘দোষ’ (বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত) শব্দের অর্থ অন্যায়, অপরাধ, অনৈতিক কাজ (দোষ করা), ত্রুটি, খুঁত (দোষ করা), কু-অভ্যাস (পানদোষ), ফের, কুপ্রভাব (গ্রহের দোষ), ক্ষতি, দ্বেষ, নিন্দা, পাপ, আয়ু (বায়ু পিত্ত কফ) ত্রিদোষ প্রভৃতি। যেমন : কী দোষ ছিল যে আমার, করছ আমায় তুমি পর–।দোষ যে করে সে দোষী। যেমন : দোষী করতে জানে বন্ধু খুশি করতে জানে না – – –। সংস্কৃত ‘ভ্রম’ থেকে উদ্ভূত ‘ভুল’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে ভ্রম, ভ্রান্তি, প্রমাদ (ভুলে ভরা), বিস্মৃতি (ভুলে যাওয়া), প্রলাপ (ভুল বকা); বিশেষণে শব্দটির অর্থ ভ্রান্ত, অসত্য (ভুল ধারণা) যথার্থ নয় এমন (ভুল ব্যাখ্যা)।  যেমন : “ওগো আবার নতুন করে ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না/হারানো স্বপন চোখে এঁকো না।” সংস্কৃত ‘ত্রুটি’ শব্দের অর্থ অপরাধ, দোষ (ত্রুটি মার্জনা, অভাব, ঘাটতি (চেষ্টার ত্রুটি নেই), ভ্রম, প্রমাদ (ত্রুটিবিচ্যুতি), ক্ষতি, হানি প্রভৃতি।এটিও বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন : আমার ত্রুটি ক্ষমা করুন।

শব্দার্থসমূহ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ‘দোষ’ শব্দের একটি অর্থ ত্রুটি/ ভুল ।  এ ছাড়া উভয় শব্দের অর্থে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এজন্য শব্দটি বিশেষ ক্ষেত্রে সমার্থক হলেও খুব কম ক্ষেত্রে সমপ্রায়োগিক। এই শব্দের প্রয়োগে আইনগত অপরাধ অধিক ব্যবহার করা অনুচিত। সাধারণত কোনো অন্যায়, অপরাধ,

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অনৈতিক কাজ, খারাপ অভ্যাস, পাপ প্রভৃতির ক্ষেত্রে দোষ শব্দটি অধিক ব্যবহৃত হয়। পদার্থে বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে : ১. তোমার এ দোষ (অপরাধ) ক্ষমা করা যায় না। ২. স্বজনপ্রীতি একটি বড়ো দোষ (অনৈতিক কাজ)। ৩. অতিরিক্ত মদ্যপান মারাত্মক দোষ (পানদোষ)। ৪. ত্রিদোষ (বায়ু পিত্ত কফ ) আয়ু কমিয়ে দেয়। ৫. গ্রহদোষ (কুপ্রভাব) সহজে ফেরানো যায় না। ৬. নরহত্যা মহা দোষ (পাপ)। ৭. কপালের ফের (দোষ), নইলে কী আর এমন হয়! ৮. নরহত্যা মহা দোষ (পাপ)। ৯. কোনো ভালো মানুষ পরের দোষ (নিন্দা) গায় না। ১০. ফণী এলো, ছাগলটা নিয়ে গেল আমার বড়ো দোষ (ক্ষতি) হয়ে গেল।

এসব বাক্যে ‘দোষ’ শব্দের স্থলে ‘ত্রুটি’ ব্যবহার করা হলে তা শোভন বা যথার্থ  হবে না; অধিকন্তু, বাক্যের অর্থও ভালোভাবে রক্ষিত হবে না। স্বজনপ্রীতি  একটি ‘দোষ’, ত্রুটি নয়। প্রতিদিন অফিসে দেরি করে আসা ‘ত্রুটি’ নয়, দোষ। কিছু কিছু দোষকে কখনও ত্রুটি বলা যায় না। যেমন : মুদ্রদোষ, বায়ুদোষ, স্বপ্নদোষ, স্বভাবদোষ,পানদোষ, চরিত্রদোষ প্রভৃতি। ‘ত্রুটি’ শব্দের একটি অর্থ অপরাধ হলেও সাধারণত ‘অপরাধ’ অর্থে ত্রুটি শব্দের ব্যবহার বিরল। সাধারণত মার্জনা, অভাব, ঘাটতি, ভ্রম, প্রমাদ, ক্ষতি, হানি প্রভৃতি অর্থে ত্রুটি শব্দটির অধিক ব্যবহার লক্ষণীয়। পদার্থে বিষয়টি দেখুন : ১১. শারীরিক ত্রুটি থাকলে সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়া যায় না। ১২. ত্রুটি (ভ্রম) হয়ে গেল, বানানটা দেখে নেওয়া উচিত ছিল। ১৩. শুদ্ধতা রক্ষায় চেষ্টার ত্রুটি (অভাব) ছিল না। ১৪. সর্বোচ্চ সতর্কতা সত্ত্বেও কিছু ত্রুটি (প্রমাদ, ত্রুটিবিচ্যুতি) রয়ে গেল। ১৫. অঙ্গত্রুটি( হানি) অপরাধ নয়।

এসব ক্ষেত্রে সাধারণত দোষ শব্দের চেয়ে ত্রুটি শব্দের ব্যবহার যৌক্তিক। আর একটি বাক্য দেখুন। ১৬. আমার ত্রুটি/দোষ মার্জনা করুন। এই বাক্যে ‘ত্রুটি’ ও ‘দোষ’ উভয় শব্দের ব্যবহার প্রথমদৃষ্টে যৌক্তিক মনে হলেও এই যোক্তিকতা নির্ভর করবে কাজের বা ঘটনার প্রকৃতির উপর। আইনগত অপরাধ সাধারণত ত্রুটি

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

হিসেবে গণ্য করা হয় না। আবার ঘাটতি বা অভাবজনিত ত্রুটিকে অপরাধ বলা সমীচীন নয়। ‘জন্মদোষ’ ও ‘জন্মত্রুটি’ বানানে অভিন্ন হলেও অর্থে ভিন্ন। প্রথমটি অপরাধজনক এবং দ্বিতীয় ঘাটতি বা খুঁতজনক।  ‘‘দোষ-ত্রুটি’ দেখিয়ে দেওয়া ভালো মানুষের কাজ নয় ” বাক্যে ‘ত্রুটিদোষ’ লিখলে কেমন হয়? ভালো হয় না। দোষ, ত্রুটির চেয়ে মারাত্মক। তাই সে জোর করে আগে থাকতে চায়। এজন্য দোষত্রুটি হয়, ত্রুটিদোষ হয় না।

অনেকে মনে করেন, ‘অপরাধ’ ‘দোষ’,‘ভুল ও ‘ত্রুটি সমার্থক। আসলে তা ঠিক নয়। যেমন : দোষ করতে জানে বন্ধু খুশি করতে জানে না।” এই বাক্যে দোষ শব্দের স্থলে ‘ত্রুটি’ চলবে না, অবশ্য ভুল চলবে। তারপরও তা যথার্থ হবে না। খুব সামান্য কিছু ক্ষেত্রে ‘ভুল’ ও ত্রুটি’ শব্দের অভিন্নার্থক প্রয়োগ করা যায়। যেমন :  মাতৃভাষায় বাক্যচয়নে এমন ভুল (ত্রুটি) ক্ষমার্হ নয়। অন্য সব ক্ষেত্রে শব্দদুটি প্রায় ভিন্নার্থক। যেমন : ১৭. ভুল হয়ে গেছে (ভ্রান্তি/ত্রুটি) ১৮. প্রশ্নপত্রে ভুলে ভরা (প্রমাদ) ১৯. কথাটি ভুলে (বিস্মৃতি) যেও না। ২০. মুমূর্ষু লোকটি ভুল (প্রলাপ) বকছে। ২১. এটি তোমার ভুল (অসত্য/ যথার্থ নয় এমন) ব্যখ্যা।

 ‘ভুল’ ও ‘ত্রুটি’ শব্দের মিলনে ‘ভুলত্রুটি’ শব্দ গঠিত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘ভুল’ ও ‘ত্রুটি’ সমার্থক নয়। যেমন : আমি তার নাম ভুলে গেছি, সার্থক বাক্য হলেও আমি তার নাম ‘ত্রুটে’ গেছি অর্থহীন। একই কাণ্ড ঘটবে নিচের পঙ্‌ক্তি দুটোয় ‘ভুলে’ পদের স্থলে দোষ বা ত্রুটি বা অপরাধ বসালে : “তোমাকে ভুলে যাওয়া হলো না আমার এই অপরাধ ক্ষমা করো/যত ভাবি ভুলে যাব, মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় বেশি আরো।” তারপরও একটি কথা থেকে যায়, ভুল; যতই করি না কেন, অপরাধ, দোষ, ত্রুটি বা ভুল কিছুই আমরা এড়াতে পারি না।

ভুল সবই ভুল এ জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সেই ভুল

ভুল সবই ভুল এই শ্রাবণে মোর ফাগুন যদি দেয় দেখা সে ভুল।” 

#subach

উৎস

  • কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
  •  ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
  • পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রমবিবর্তন, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

পানি ও জল: পানি বনাম জল; জলপানি, পানীয় জল, জল বনাম পানি

. মোহাম্মদ আমীন

পানি ও জল: পানি বনাম জল; জলপানি, পানীয় জল, জল বনাম পানি

পানি আগে না কি জল? মৌখিক বা লিখিত ভাষায় সাধারণত বাঙালি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টানরা বলেন- ‘জল’, মুসলিমরা বলেন ‘পানি’। বলা হয় – ‘পানি’, বাঙালি মুসলিম এবং ‘জল’, বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি অমুসলিম। জল-পানি ছাড়াও বাংলায় এরকম আরও কিছু শব্দ রয়েছে। বাঙালি হিন্দুরা, ‘আব্বা- আম্মা’ বলেন না, বলেন–‘ বাবা-মা’, পিসি-দাদা বলেন না, মুসলিমরা, ভাইয়া বলেন না হিন্দুরা। কথা বা লেখায় ধর্মানুসারীভেদে শব্দ ব্যবহারের এই পার্থক্যের অনেকগুলো কারণের অন্যতম হচ্ছে- সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর ধর্মীয় প্রভাব, ভুল ব্যাখ্যা, জনরব, ভ্রান্তি প্রভৃতি। তবে, ধর্মাবলম্বী ছাড়াও স্থান, পরিবেশ, পেশা, নারীপুরুষ, সম্পর্ক, অভ্যাস, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, উঁচু-নীচু, রাজনীতি প্রভৃতিভেদেও বিশেষ বিশেষ শব্দ, বলায় কিংবা চয়নে পার্থক্য দেখা যায়। যেমন : একটি রাজনীতিক দল বলেন- ‘জিন্দাবাদ’, আর একদল বলেন, ‘দীর্ঘজীবী হোক’। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, যারা আাওয়ামী লীগ করেন, তারা ‘খোদা হাফেজ’ এবং যারা বিএনপি করেন তারা, ‘আল্লাহ হাফেজ’ বেশি বলেন।

‘জল’ ও ‘পানি’ দুটোই সংস্কৃতজাত শব্দ– প্রথমটি তৎসম এবং দ্বিতীয়টি তদ্ভব। সংস্কৃত ‘জল (=√জল্‌+অ)’ শব্দের বহুল প্রচলিত অর্থ পানি, বারি, সলিল প্রভৃতি।

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অন্যদিকে, সংস্কৃত ‘পানীয়’ শব্দ থেকে উদ্ভূত তদ্ভব ‘পানি’ শব্দের অর্থ জল, বারি, সলিল প্রভৃতি। বাংলায় ব্যবহৃত ‘পানি’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পানীয়’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ। এবার পরিবর্তনটি কীভাবে হয়েছে দেখা যাক : (সংস্কৃত) পানীয়> (পালি) পানীয়> (প্রাকৃত) পাণিঅ> (বাংলা) পাণি/পাণী> পানি। প্রাকৃত শব্দ “পাণিঅ” থেকে হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, গুজরাটি, মৈথিলী ও ওড়িয়া ভাষাও ‘বারি’ অর্থ প্রকাশে পানি শব্দটির ব্যবহার প্রচলিত হয়েছে। এবার পর্যালোচনা করে দেখি, বাংলা সাহিত্যে প্রথমে ‘পানি’ না কি ‘জল’ শব্দটির ব্যবহার চালু হয়েছিল। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলা সাহিত্যে ‘পানি’ শব্দের ব্যবহার সুপ্রাচীন, কিন্তু ‘জল’ শব্দের প্রচলন হয়েছে পরে । বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে ‘পানি’ শব্দটির প্রয়োগ পাওয়া যায়, কিন্তু ‘জল’ শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায় না। চর্যাপদে ভুসুক পা লিখেছেন : 
“তিণ ন চছুপইী হরিণা পিবই ন পাণী । 
হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী ।।” 
অর্থাৎ ‘ধৃত হরিণ প্রাণভয়ের হতভম্বতায় ঘাসও খায় না, ‘পাণী (পানি)’ পানও করে না।” অতএব, বলা যায় – বাংলা সাহিত্যে ‘পানি’ শব্দটি ‘জল’ শব্দের আগে এসেছে।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর অভিমত, চর্যার পদগুলো খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত হয়েছে।ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে চর্যাপদ লিখিত হয়। আধুনিক গবেষণায় দেখা যায়, চর্যা এরও আগে রচিত হয়েছে। সে হিসেবে এখন থেকে কমপক্ষে দেড় হাজার বছর বা তারও পূর্বে বাংলায় ‘পানি’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়েছিল; তখন জল শব্দের ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে ছিল না।সংগতকারণে, বাঙালির মুখেও ‘জল’ ছিল না, ‘পানি’ ছিল। এর থেকে প্রমাণিত হয়ে যে, ‘পানি’ ‘জল’-এর আগে; যদিও ‘প’ বর্ণটি বর্গীয়-জ বর্ণের পরে।

চর্যা-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের আর একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। এখানেও ‘জল’ শব্দটি পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় পানি। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আছে : 
“কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।
আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হুআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।
তার পাএ বড়ায়ি মোঁ কৈলোঁ কোন দোষে।
আঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।”

চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বিশ্লেষণ করে বলা যায়, সেকালে বাংলা সাহিত্যে ‘জল’-এর বড়ো অভাব ছিল, কিন্তু ‘পানি’র অভাব ছিল না। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচনার যুগেও মুসলিম-অমুসলিম সব বাঙালি একসঙ্গে কেবল ‘পানি’ই পান করে গেছেন, জলের দেখা দীর্ঘ কাল পাননি। অতএব, প্রাচীন বাংলায়, তদ্ভব ‘পানি’ শব্দের ব্যবহার ছিল, কিন্তু তৎসম ‘জল’ এর ব্যবহার ছিল কি না তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। অনেক হিন্দু এবং একই সঙ্গে বহু মুসলিম মনে করেন, ‘পানি’ আরবি বা ফার্সি-জাত শব্দ। আবার অনেকে বলেন, এটি উর্দু। গবেষণায় দেখা যায়, ব্যাবহারিক প্রাচীনত্বের কারণে ‘পানি’ শব্দটি অপেক্ষাকৃত গরিব এবং অশিক্ষিত বাঙালি মুসলিম শ্রমজীবীগণ অধিক হারে ব্যবহার করায় এবং তার বিপরীতে আর একটি সহজবোধ্য সংস্কৃত শব্দ (জল) থাকায় সংস্কৃত পণ্ডিতবর্গ ‘পানি’ শব্দটিকে ইসলামি শব্দ এবং অস্পৃশ্যদের ব্যবহার্য শব্দ হিসেবে প্রচার করতে শুরু করেন। এভাবে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-অমুসলিম উভয়ের কাছে প্রাচীন কাল হতে ব্যবহৃত হয়ে আসা ‘পানি’ শব্দটি সংস্কৃত হতে আগত হয়েও হিন্দুত্ব হারিয়ে ফেলে। এজন্য হিন্দুরা ‘পানি’ শব্দের পরিবর্তে ‘জল’ ব্যবহার করতে শুরু করেন। ফলে ‘জল’ হয়ে যায় হিন্দুয়ানি শব্দ। প্রকৃতপক্ষে, ‘পানি’ শব্দের সঙ্গে আরবি বা ফারসি ভাষার কোনো সম্পর্ক নেই। আরবি ভাষায় ‘পানি’ অর্থ ‘মাউন’। অন্যদিকে, ফারসি ভাষায় পানিকে বলা হয় ‘আব’। সুতরাং ‘পানি’ শব্দকে ইসলামি শব্দ বলে বাঙালি হিন্দুদের তা ব্যবহার না-করার কথাটি সত্য হলেও ‘পানি’ আরবি বা ফার্সি শব্দ- এটি ঠিক নয়। যদিও উভয় পক্ষের অনেকে এমন দাবি করে থাকেন। অধিকন্তু, হিন্দুরা ছাড়াও অধিকাংশ বাঙালি অমুসলিম সাধারণত ‘পানি’ শব্দের পরিবর্তে ‘জল’ ব্যবহার করে থাকেন।

বাঙালি হিন্দুদের জল ব্যবহারের আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ধর্মীয় প্রাবল্য। সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়নের সূচনালগ্নে হিন্দুদের দ্বারা এবং হিন্দুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত টোল-পাঠশালা প্রভৃতির প্রসার দীর্ঘকাল যাবৎ হিন্দু-প্রধান এলাকায় প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। বিশেষ করে, ইংরেজ আমলে মুসলিমরা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করায় মুসলিমরা আধুনিক শিক্ষা হতে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। এগিয়ে যেতে থাকে হিন্দুরা। সাধারণ

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

মুসলিমরা মোঘল আমলের ন্যায় আরবি-ফারসি প্রভৃতি ভাষাতে এবতেদায়ি শিক্ষা গ্রহণ করে যেতে থাকে। মাদ্‌রাসায় পাঠদানকালে মৌলবিরা বাংলা শব্দ হিসেবে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা শব্দরাশিই ব্যবহার করতেন। বাঙালি কবি-সাহিত্যিকগণের সাহিত্যকর্মেও হিন্দু কবি-সাহিত্যিকগণের তুলনায় আরবি-ফার্সি ভাষার প্রাধান্য ছিল। সংস্কৃত-প্রধান টোল বা পাঠশালার সঙ্গে মুসলিমদের এবতেদায়ি বা মাদ্‌রাসা শিক্ষার বৈপরীত্য ছিল প্রচুর। ফলে, মুসলিমরা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা সংস্কৃত হতে আগত তদ্ভব তথা প্রাকৃত ‘জল’ শব্দের ব্যবহারে সমধিক অভ্যস্থ হয়ে উঠে। অধিকন্তু, তখন বাংলা ভাষার প্রচার হিন্দু-প্রধান এলাকার বিদ্যালয়সমূহে যত ভালোভাবে করা হয়েছিল, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় করা হয়নি; মুসলিমরাও প্রথমদিকে এদিকটাকে গুরুত্ব সহকারে নেননি। ফলে, মুসলিমরা আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেন।অন্যদিকে হিন্দুরা হয়ে উঠেন অধিকমাত্রায় সংস্কৃত-অনুসারী। বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃতের প্রভাবও এর অন্যতম একটি কারণ। কাজেই মুসলিমদের কাছে ‘পানি’ এবং শিক্ষিত হিন্দুদের কাছে ‘জল’ বহুল প্রচলিত হয়ে যায়। এভাবে শিক্ষিত হিন্দুদের ব্যবহারের কারণে সব হিন্দু এবং অমুসলিমরা জল শব্দ ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে যায়।

উপরের আলোচনা হতে দেখা যায়, ‘পানি’ ও ‘জল’ দুটোই সংস্কৃতজাত শব্দ। সংস্কৃত ‘পানীয়’ শব্দটি একটু পরিবর্তন হয়ে ‘পানি’ হয়েছে বলে হয়তো মুসলিমরা সরাসরি সংস্কৃত ‘জল’ না-বলে ‘পানি’ বলে থাকেন। হিন্দিভাষীগণ ‘পানি’ বলেন। বেশির ভাগ হিন্দিভাষী অমুসলিম। মুসলিমরাও বলে থাকেন পানি। সুতরাং উপমহাদেশে, ‘জল’ এর চেয়ে ‘পানি’ বলা লোকের সংখ্যা অধিক। তবে বাংলায় বিভিন্ন শব্দ ও প্রবাদ-প্রবচনে পানির চেয়ে জলের আধিক্য বেশি। ‘পানি’ দিয়ে গঠিত এবং বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে অন্তর্ভূক্ত শব্দের সংখ্যা মাত্র পাঁচ, কিন্তু ‘জল’ দিয়ে গঠিত শব্দের সংখ্যা একশ একচল্লিশ।এটিও বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃতের একছত্র প্রভাবের কারণে ঘটেছে। বাংলায় ব্যবহৃত আরবি শব্দ যে, হিন্দুরা ব্যবহার করেন না তা নয়। হিন্দুরা ‘আইন’, ‘কাগজ’, ‘কলম’ প্রভৃতির মতো আরও অনেক আরবি বা ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন, কিন্তু জল ও পানি কীভাবে হিন্দু মুসলিম হয়ে গেল- তা যথার্থভাবে বলা কষ্টসাধ্য।

আসলে, জল আর পানি একই জিনিসি। যেভাবে উদ্ভব হোক না কেন, শব্দের কোনো প্রাতিষ্ঠানক ধর্ম নেই। বাংলা অনেক শব্দে ‘জল’ আর পানি একসঙ্গে লেখা হয়। যেমন : ‘জলপানি। শব্দটির অর্থ: ছাত্রবৃত্তি, স্কলারশিপ, জলযোগের পয়সা প্রভৃতি। আর, যে ছাত্র ‘জলপানি’ পায় সে যে মেধাবী, তা কে না জানে? সুতরাং, যারা মেধাবী তাদের কাছে জলপানি, বা জল ও পানি অভিন্ন জিনিস। শব্দকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে টেনে আনা সমীচীন বলে মনে হয় না।

সূত্র. মোহাম্মদ আমীন, বাংলা ভাষার মজা, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

ওয়েবসাইট লিংকwww.draminbd.com

শুবাচ লিংক: #subach

 

Leave a Comment