বাঙালি মুসলমানের নাম

ড. মোহাম্মদ আমীন

বাঙালি মুসলমানের নাম

ব্যক্তিনাম কী- তা আমরা জানি; কিন্তু ইসলামিক ব্যক্তিনাম কী- তা নিয়ে অনেকের সংশয় থাকতে পারে। অথচ এটিই  এ আলোচনার মুখ্য বিষয়। অতএব, আলোচনার প্রারম্ভে দেখে নিই ইসলামিক ব্যক্তিনাম’ নাম কী? প্রথমেই বলে রাখি, কাউকে অনুসরণ না-করে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের আলোকে উপমহাদেশের প্রাসঙ্গিকতায় আমি এর সংজ্ঞার্থ পরিবেশন করব। আমার সংজ্ঞার্থের সঙ্গে সবাই ঐকমত্য পোষণ করবেন- এমনটি হয় না এবং আমিও তা চাই না। আপনার ভিন্নমত আমার মতকে ঋদ্ধ করবে- এটি আমি নিশ্চিত বলতে পারি। তবে অযথা কটূক্তি করবেন না, কিংবা অহেতুক ধর্মকে টেনে আনবেন না, ইতিহাসকে উপেক্ষা করে শুধু বিশ্বাস-নির্ভর কোনো মন্তব্য করবেন না। কারণ, আমার মত গ্রহণে কেউ বাধ্য নন বা আমিও কাউকে বাধ্য করছি না। এবার আমার সংজ্ঞার্থটি দেখে নেওয়া যায় : মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত আরবি ভাষাসম্পৃক্ত কিংবা যে ভাষারই হোক না কেন, আরবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দ দ্বারা রাখা ব্যক্তিনামগুলো উপমহাদেশে ইসলামিক ব্যক্তিনাম হিসেবে পরিচিত। এ ভাষাসমূহের মধ্যে আরবি, ফারসি, হিব্রু ও তুর্কি প্রধান। অনেকের কাছে এ ভাষাসমূহের শব্দ দিয়ে রাখা নাম আরবীয় নাম হিসেবেও পরিচিত। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের ভাষাগুলো ষষ্ঠ শতকে ইসলামের আবির্ভাবের বহু পূর্ব হতে চলে আসছে।

ষষ্ঠ শতকে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে অর্থাৎ প্রাক-ইসলামিক যুগে মাতৃভাষা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের নাম রাখা হতো আরবি, হিব্রু ও ফারসি এবং

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

সীমিত মাত্রায় তুর্কি প্রভাবিত। তখন ইসলাম ধর্ম ছিল না বলে আরবি নামের ব্যক্তিবর্গ মুসলিম ছিলেন না। আবুবকর, ওমর, ওসমান, আলী, হামজাহ, হায়দার, আবু তালিব, আবদুল্লাহ, আবু লাহাব, আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান, হাফসা, সায়েফা, আমেনা, খাদিজা, মরিয়ম প্রভৃতি আরবীয় নাম হলেও ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এমন নামধারীদের কেউ মুসলিম ছিলেন না, তারা ছিলেন প্রস্তরপূজক এবং অন্যান্য স্থানীয় ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী।

অথচ ইসলামের আবির্ভাবের পর এই নামগুলোই হয়ে উঠে  মুসলিম নাম এবং অনেকে হয়ে উঠেন খ্যাতিমান মুসলিম। কিন্তু তাদের কেউ অমুসলিম থাকাকালীন পূর্বের নাম পরিবর্তন করেননি, করার চিন্তাও করেননি। কারণ, মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন আরবি ভাষায় লিখিত। তাই ধর্ম পরিবর্তন হলেও তাদের মাতৃভাষাটাই ধর্মীয় ভাষার স্থান নিয়ে নিয়েছিল। অন্যদিকে, পারসিক কবি ফেরদৌসির শাহনামার অন্যতম চরিত্র সোহরাব, রুস্তম ও তাহমিনা ছিলেন অগ্নি উপাসক, ইবরাহিম-ইয়াকুব, মুসা প্রমুখ ছিলেন ইহুদি। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে এসব নাম মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ব্যক্তিনাম। কারণ  এ নামগুলোর সঙ্গে আরবি ভাষার গভীর নৈকট্য রয়েছে। সুতরাং এটি সর্বজনবাদীস্বীকৃত যে, মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের ব্যক্তিনাম ধর্মগত নয়, বরং ভাষাগত ও স্থানপ্রভাবিত। এর কারণ, ওই অঞ্চলের প্রধান ভাষায় (আরবি) কুরআন লিখিত হয়েছে। তাই তাদের ব্যক্তি নামের সঙ্গে ধর্মীয় নামের কোনো সংঘর্ষ ঘটেনি, ফলে ভাষাগত নাম ব্যক্তিনামে এবং ব্যক্তিনাম ধর্মগত নামে আর উভয় কারণ স্থানিক সংস্কৃতে  একাকার হয়ে গেছে। উপমহাদেমের মুসলিমের ক্ষেত্রে তেমন ঘটার কি সুযোগ ছিল?

কাগজে একজন লোকের নাম লেখা আছে Ameen। নামের পর জানা গেল তিনি উমহাদেশের লোক। এই দুটি তথ্য দ্বারা Ameen নামের লোকটির ধর্মীয় পরিচয় বহুলাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়। যদিও তার জাতীয়তা বা ভাষা সম্পর্কে মোটেও নিশ্চিত হওয়া যায় না। যদি Ameen নামের লোকটির জন্ম-এলাকা অজ্ঞাত থাকত তাহলে শুধু `Ameen’ নাম দিয়ে তার ধর্ম, জাতীয়তা ও ভাষা কোনোটাই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হতো না। কারণ, পৃথিবীতে ‘Ameen’ নামের অনেক মুসলিম আছে, অনেক ইহুদি আছে, অনেক খ্রিষ্টানও আছে। যদি বলা হয়, Muhammed  Ameen , তাহলে এ নামের দ্বারা লোকটির ধর্ম বহুলাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়, যদিও তার জাতীয়তা বা ভাষা সম্পর্কে মোটেও নিশ্চিত হওয়া যায় না। কেননা, পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন দেশে এ নামের অসংখ্য মুসলিম রয়েছে।

আর একটা বিষয়, উপমহাদেশে Muhammed শব্দটাকে মোহাম্মদ, মুহাম্মদ, মুহম্মদ, মোহাম্মেদ, মো. মোহাং, এমডি,  মোহাম, মু, মুহা – অসংখ্য রূপে লেখা হয়। এরূপ ভিন্ন হওয়ার কারণ হচ্ছে স্কুলে যারা মুসলিম সন্তানদের নাম নিবন্ধন করতেন, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন অমুসলিম, বিশেষত হিন্দু। সুতরাং তাদের Muhammed নামের বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা  ছিল না। থাকলেও কেউ   কেউ লেখার স্থান কমানোর অজুহাতে অথবা অনেকে ‘শ্রী’ শব্দের পরিবর্তে এটি বসানো হচ্ছে ধরে নিয়ে Muhammed শব্দকে মো. মোহাং, মোহ. Md প্রভৃতি ইচ্ছেমতো শব্দ বসিয়ে দিতেন। অধিকাংশ মুসলিম সন্তানের পিতা নিরক্ষর ছিলেন বলে অমুসলিম শিক্ষকদের   ইচ্ছা বা কাজের ওপর মন্তব্য করার মতো সামান্য যোগ্যতাও তাদের ছিল না। তাই নির্বিবাদে মেনে নিতেন। প্রমিতা দাস লাবণী একটি ব্যক্তি নাম। এ নাম শুনে তার ধর্মীয় পরিচয় এবং একই সঙ্গে জাতীয়তা, ভাষা ও সংস্কৃতি বহুলাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়। এজন্য তার জন্ম-এলাকা জানার প্রয়োজন পড়বে না। অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই বলে দিতে পারবেন- প্রমিতা দাস লাবণী বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মহিলা। এখানে তার বাংলা নাম ও পদবি তার পরিচিতির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তেমনি, রমণী মোহন আচার্য্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রভাত কুমার স্যানাল, চন্দন দত্ত  প্রভৃতি।

আমার এক সহকর্মীর নাম শাহ উছমান ইবনে শামস। তিনি কী মুসলিম? অনেকে বলবেন, মুসলিম। তার জন্ম উপমহাদেশে হলে বলা যেত তিনি মুসলিম। কিন্তু তার বাড়ি উপমহাদেশে নয়। আসলে, তিনি একজন ইরানিয়ান ইহুদি, কিন্তু মাতৃভাষা আরবি (ইরানিয়ানদে সাধারণ মাতৃভাষা ফারসি) বলে তার নাম আরবীয়। আবির (Abir) একটি প্রসিদ্ধ হিব্রু শব্দ, যার অর্থ শক্তিশালী।বাংলায় আবির একটি রঙ। ইব্রাহিম একটি প্রসিদ্ধ হিব্রু ও আরবীয় নাম- কুরআনেও নামটি রয়েছে। সারা, সারাহ (প্রিন্সেস), মরিয়ম, মায়মুনা প্রভৃতি ইহুদীয় হিব্রু শব্দ, কুরআনে ‘মরিয়ম’ নামের একটি সুরাও রয়েছে। কিন্তু মধ্যাপ্রাচ্য-সহ পৃথিবীর অনেক দেশে এসব নামের অনেক মুসলিম দেখা যায়। কারণ এসব শব্দরাজি মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা থেকে আগত।

আমার এক খালার নাম মরিয়ম এবং আরেক খালার নাম হোসানা-দুটিই হিব্রু শব্দ; দুজনের নাম হ্রিব্রু- ইহুদীয় ভাষা; কিন্তু তারা কেউ ইহুদি নন। তবে মধ্যপ্রাচ্যের নাম এবং একই সঙ্গে আরবীয়-প্রকৃতির বলে উপমহাদেশে এসব নাম ইসলামিক নাম হিসেবে পরিচিত। তবে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো নামই ইসলামিক নাম নয়, আরবীয় নাম। আর একটা নাম দেখা যাক; আমার স্ত্রীর নাম এ্যনি (Anee)। হিব্রু ভাষায় শব্দটির অর্থ Gracious. আমার সিনিয়র এক বিখ্যাত মৌলানা কন্যার নামও এ্যানি, তিনি এখন সৌদি আরবের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরবি পড়ান। নাম দুটো মধ্যপ্রাচ্যের ভাষার হলেও আরবীয়-প্রকৃতির নয় বলে অনেকে মনে করেন- এটি খ্রিষ্টানীয় নাম।

বাবুল, দুলাল, জয়, মিন্টু, টুটুল, মিল্টন, লিংকন, রানা, সজল, সজীব, চয়নিকা, অথৈ, প্রতীতি, স্নিগ্ধা বৃষ্টি, শান্তা, রেখা প্রভৃতি এখন উপমহাদেশের বহুল প্রচলিত কয়েকটি নাম। পুরো না-শুনলে কেবল এসব নাম দিয়ে নামধারীর ধর্ম, ভাষা ও জাতীয়তা কোনো কিছু নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ উপমহাদেশে বর্ণিত নামসমূহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দেখা যায়। আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধুর নাম ছিল বাবুল, সে ছিল হিন্দু। বাবুল নামের আমার অনেক মুসলিম সহকর্মী ও ছাত্র আছে।

সুতরাং, উপমহাদেশে বাঙালি মুসলিমদের নাম ভাষাগত নয়, পুরোপুরি ধর্মগত। কেন তা ব্যাখ্যা করছি : সপ্তদশ শতকের প্রথম দিক থেকে উপমহাদেশের সঙ্গে মুসলিম তথা আরবদের পরিচয় নিবিড় ও বিস্তৃত হতে থাকে। এরপর থেকে উপমহাদেশের সঙ্গে ইসলামিক নামের পরিচয় ঘটে। আরবদের সংস্রবে আসার

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

ফলে উপমহাদেশের যেসব অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন, তাদের অস্পৃশ্য, ধর্মত্যাগী, পাপিষ্ঠ, একঘরে, কুলাঙ্গার প্রভৃতি নাম দিয়ে প্রাক্তন সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হতো। তাদের হত্যা করা হতো, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। ফলে নব্য-মুসলিমরা প্রাক্তন সমাজ হতে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচার জন্য আরবীয়দের উপর এতই নির্ভরশীল হয় পড়ত যে, নিজের পুরানো নামটাও বদলে নেওয়াকে পুণ্যের বা গৌরবের মনে করত। প্রাক্তন সমাজ ব্যবস্থাকে প্রচণ্ড ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে চলে আসত নতুন জগতে।

এভাবে, উপমহাদেশে ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে তত প্রবল হতে থাকে তাদের ধর্মীয় বোধ। পূর্বতন সমাজ থেকে বিতাড়িত ও বিচ্ছিন্ন এসন নও-মুসলিরা মাতৃভাষার আবহে ইসলাম ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশনায় গড়ে তোলে একটি নতুন সমাজ। আরবীয়দের ধর্মীয় প্রভাবের কারণে উপমহাদেশের নও মুসলিমগণ যুগের পর যু আচরিত ধর্ম আর সংস্কারকে ছুড়ে ফেলে আরবীয়দের শিক্ষাকে পরম পবিত্রতায় গ্রহণ করে। তাদের কাছে  আরবী ভাষা দেবভাষা সংস্কৃতের চেয়ে আরো প্রবল ও পবিত্র হয়ে উঠে। এটি কেমন প্রবল ছিল তা একটি ঘটনা দিয়ে তুলে ধরা যায়: 

 আব্বাস প্রথম সৌদি আরব এলেন শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য। বিশ বছর যাবৎ সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত হামিদ তাকে বিমান বন্দর থেকে নিতে এসেছে।  জেদ্দা বিমান বন্দর থেকে  বের হয়ে আসার পর পথে একটি আরবি লেখা পত্র দেখলেন। অনেক লোক কাগজটি পা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে। আব্বাস পরম শ্রদ্ধাভরে কাগজটি  ‍তুলে নিয়ে কপালে ছুঁইয়ে  চুমোর পর চুমো দিয়ে শুরু করে।  আব্বাসকে একটি কাগজে এমন পাগলের মতো  চুমো খেতে দেখে হামিদ  বলল, এটি কী? আব্বাস বলল, “আরবি লেখা  কাগজ। ফুটপাতে পড়েছিল। লোকে পা দিয়ে মাড়িয়ে পাপ করছে। তাই তুলে নিয়ে চুমো খাচ্ছি, সওয়াব হয়ে গেল।” হামিদ ছিন্ন পত্রটি পাঠ করে বলল, শুনবে কী লেখা আছে ?  কী?  হামিদ বলল, গালাগালি দিয়ে লেখা চিঠি।

সংগত কারণে উপমহাদেশের মুসলিমদের ধর্ম, তাদের প্রাক্তন সমাজ,সংস্কৃতি ও ভাষার চেয়ে পবিত্র হয়ে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে আরবীয় নামগুলো উপমহাদেশে ভাষাগত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে সম্পূর্ণ ধর্মগত হয়ে পড়ে।এ কারণে উপমহাদেশে প্রথমদৃষ্টে নামই হয়ে পড়ে ধর্ম-পরিচিতির প্রথম চিহ্ন। এভাবে বাঙালি মুসলমানের এবং একই সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের নাম রাখার ক্ষেত্রে  মাতৃভাষা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে। 

#subach

Leave a Comment

শব্দের মাঝে বিসর্গ: কখন কোথায় কেন

ড. মোহাম্মদ আমীন

শব্দের মাঝে বিসর্গ: কখন কোথায় কেন

শব্দের মাঝখানে থাকা বিসর্গের উচ্চারণ ‘কখনো হসন্ত বা খণ্ড-ত’ এর মতো হয়। যেমন: ইতঃপূর্বে (উচ্চারণ- ইতোহ্‌প্‌পুর্‌বে)। আবার কখনো বিসর্গের প্রভাবে পরবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণটি দ্বিত্ব লাভ করে। যেমন: দুঃখ (দুখ্‌খো); নিঃসঙ্কোচ (নিশ্‌শঙকোচ), দুঃসংবাদ (দুস্‌সঙবাদ) ইত্যাদি। বানানে সংশয় ও উচ্চারণ জটিলতা এড়ানোর সুবিধার্থে শব্দের মধ্যাংশে বিসর্গযুক্ত কয়েকটি শব্দের তালিকা এখানে দেওয়া হলো। এগুলো জানা থাকলে শব্দের মধ্যাংশে বিসর্গজনিত বানান-ভুলের মাত্রা বহুলাংশে কেটে যাবে। যেমন :

অতঃপর, অধঃক্রম, অধঃকৃত, অধঃক্ষেপণ, অধঃপতন, অধঃস্থিত, অধঃস্থ, অধঃশিখা, অধঃপতিত, অন্তঃক্রীড়া, অন্তঃকোণ, অন্তঃকুটিল, অন্তঃকরণ,

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অন্তঃকলহ, অন্তঃপট, অন্তপাতী, অন্তঃপুর, অন্তঃপুরচারী, অন্তঃপুরবাসিনী, অন্তঃপুরিকা, অন্তঃরাষ্ট্রিক, অন্তঃশত্রু, অন্তঃশীলা, অন্তঃশুল্ক, অন্তঃসংগতি, অন্তঃসংজ্ঞা,অন্তঃসত্তা, অন্তঃসত্ত্বা, অন্তঃসলিল, অন্তঃসলিলা, অন্তঃসার, অন্তঃসারবিহীন, অন্তঃসারশুন্য, অন্তঃস্থ, অন্তঃস্থিত; ইতঃপর, ইতঃপূর্বে; উচ্চৈঃস্বরে;

চক্ষুঃশূল, চতুঃশাখা, চতুঃশালা, চতুঃসীমা, ছন্দঃপতন, ছন্দঃপাত, ছন্দঃশাস্ত্র; জ্যোতিঃশাস্ত্র, জ্যোতিঃপুঞ্জ,জ্যোতিঃপূর্ণ, জ্যোতিঃপ্রভা; তপঃপ্রভাব, তপঃক্লেশ, তেজঃপুঞ্জ; দুঃশাসন, দঃশীল, দুঃসংবাদ, দুঃসময়, দুঃসহ, দুঃসাধ্য, দুঃসাহস, দুঃসাহসিক, দুঃস্থ, দুঃস্বপ্ন;

নিঃশ্বাস, নিঃশ্বেসন, নিঃশেষ, নিঃশর্ত, নিঃশব্দ, নিঃসীম, নিঃসৃত, নিঃস্পৃহ, নিঃস্রাব, নিঃস্নেহ, নমঃশূদ্র, নিঃশক্তি, নিঃশঙ্ক, নিঃশত্রু, নিঃসারণ, নিঃসাড়, নিঃসহায়, নিঃসরণ, নিঃসম্বল, নিঃসম্পাত, নিঃসন্ধিগ্ধ, নিঃসন্দেহ, নিঃসন্তান, নিঃসত্ত্ব, নিঃসঙ্গ, নিঃসংশয়, নিঃসংকোচ, নিঃশ্রেণি, নিঃশ্মশ্রু, নিঃস্ব, নিঃস্বত্ব, নিঃস্বর, নিঃস্বার্থ, নিঃস্বীকরণ, নিঃস্রোতা;

প্রাতঃকাল, প্রাতঃকৃত্য, প্রাতঃক্রিয়া, প্রাতঃস্মরণীয়, প্রাতঃস্নান, পয়ঃপ্রণালী, পুনঃপুন, পুনঃপ্রবেশ, পৌনঃপুনিক, প্রাতঃপ্রণাম, প্রাতঃসন্ধ্য; মনঃপ্রাণ; বয়ঃকনিষ্ঠ, বয়ঃক্রম, বক্ষঃস্থল, বহিঃস্থ, বহিঃসমুদ্র, বহিঃশুল্ক, বহিঃশত্রু, বহিঃপ্রকাশ, বয়ঃস্থ, বয়ঃসন্ধি, বয়ঃপ্রাপ্ত;

মনঃশিলা, মনঃসংযোগ, মনঃস্থ, মনঃসমীক্ষা, মনঃসমীক্ষণ, মনঃসংযোগ, মনঃপূত, মনঃপীড়া, মনঃক্ষোভ, মনঃক্ষুণ্ন, মনঃকষ্ট, মনঃকল্পিত; যশঃকীর্তন; শিরঃপীড়া, শিরঃশূল; সদ্যঃকৃত, সদ্যঃপক্ব, স্বতঃসিদ্ধ, স্বতঃস্ফূর্ত, স্রোতঃপথ, সদ্যঃপ্রবিষ্ট, স্বতঃপ্রণোদিত, স্বতঃপ্রমাণিত।

#subach

উৎস: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

Leave a Comment

অরণ্য বন ও জঙ্গল: নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা

ড. মোহাম্মদ আমীন

অরণ্য বন ও জঙ্গল: নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘অরণ্য’ শব্দের অর্থ গাছপালায় ঢাকা জায়গা যেখানে বন্য পশু বিচরণ করে, বন, জঙ্গল প্রভৃতি।বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত  ‘জঙ্গল’ শব্দের অর্থ বন, অরণ্য, ঝোপঝাড়পূর্ণ স্থান, নির্জনস্থান প্রভৃতি। অন্যদিকে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘বন’ শব্দের অর্থ অরণ্য, জঙ্গল, কানন, কুঞ্জ, গহন, বিপিন। আভিধানিক অর্থ বিবেচনায় অরণ্য, বন ও জঙ্গল – তিনটি শব্দই সমার্থক মনে হয়। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কোনো শব্দই সমার্থক হতে পারে না। কেননা, আর্থিক আর প্রায়োগিক পার্থক্যের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন থেকে সমার্থক শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। কোনো ব্যক্তি, বিষয় বা বস্তু অন্য কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয়ের মতো হওয়া মানে অভিন্ন হওয়া নয়। অভিধানে যেটি শব্দ, বাক্যে তা শব্দ থাকে না, পদ হয়ে যায়। শব্দার্থ একাধিক হতে পারে, কিন্তু পদার্থ বাক্যবিশেষে সুনির্দিষ্ট। যেমন : কেউ যদি প্রশ্ন করে, “ বলঅর্থ কী?” প্রশ্নের উত্তর হতে পারে শক্তি, খেলার বল, say প্রভৃতি। কিন্তু শব্দটি যখন বাক্যে বসে তখন তার অর্থ একদম সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। যেমন : বল শাহিন, শুধু বল দিয়ে কি বল খেলা যায়? প্রথম ‘বল’এর অর্থ say, দ্বিতীয় ‘বল’ এর অর্থ শক্তি এবং তৃতীয় বল এর অর্থ ফুটবল।

এবার বন-জঙ্গলে চলে যাই। অরমমান শব্দ থেকে অরণ্য শব্দের উৎপত্তি। প্রাচীন ভারতে অনেকে গুরুগৃহে শিক্ষাগ্রহণ সমাপ্ত করে বাড়ি ফিরতেন না। তাঁরা চিরকুমার-ব্রহ্মচারী হয়ে সংসার ও নারীসঙ্গ বর্জন করে অধ্যাত্মবিদ্যার অনুশীলন করতেন। অনেকে অধ্যাত্ম সাধনার জন্য বনে বসবাস করতেন। তাদের অরমমান বলা হতো। সাধারণ্যে, অরমমানগণ অরণ নামে পরিচিত ছিল। মূলত এ অরণ শব্দ থেকে অরণ্য শব্দের উৎপত্তি। অরণ হতে হলে এমন স্থানে বাস করতে হতো, যেটি ছিল খুবই দুর্গম এবং শ্বাপদসংকুল। ফলে সেখানে মনুষ্যবসত গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল। সে অর্থে অরণ্য হচ্ছে ঘন গাছাপালায় গভীরভাবে ঢাকা বন্যপশুর অভয়াশ্রম যেখানে সংগত কারণে স্বাভাবিক মনুষ্যবসতি সম্ভব নয়। অরণ্যে মানুষজন থাকত না বলে সেখানে রোদন করলেও  করলেও সাহায্যের কেউ থাকে না। সব আবেদন নিষ্ফল হয়ে যেত। যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে বাংলা বাগ্‌ধারা অরণ্যে রোদন, মানে নিষ্ফল আবেদন।

সুতরাং, কোনো স্থানকে অরণ্য হতে হলে ওই স্থানকে শুধু গাছপালায় আবৃত থাকলে হবে না, বন্য পশুর অবাদ বিচরণ থাকতে হবে এবং মনুষ্যবসতির অনুকূল পরিবেশও থাকতে পারবে না। যদিও বর্তমান বিশ্বে এমন স্থান ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। তাই অভিধানে এখন অরণ্যের সেই উৎপত্তিগত অর্থ কিছুটা বিস্তৃত হয়েছে। বন্য পশু বিচরণ করে গভীর জঙ্গল বা গভীর বনে। অতএব, উৎস-ঘটনা বিবেচনায় অর‌ণ্য শব্দের কার্যকর অর্থ হতে পারে ঘন গাছপালায় ঢাকা বন্যপ্রাণী অধ্যুষিত এবং মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত শ্বাপদসংকুল স্থান।

এবার বনে চলে আসা যাক। অরণ্য, বন ও জঙ্গল এ তিনটি শব্দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ ‘বন’। অভিধান ও প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রে রয়েছে তার অবাধ বিবচরণ। আলোচ্য তিন শব্দের মধ্যে কেবল বনেই ভোজন করা যায়, বেড়ানো হয়, আনন্দ করাযায়। বন নিয়েই রচিত হয়েছে আবেগঘন কবিতা, গান। শহরেও ঢুকে গেছে বোন : বনানী, বনশ্রী। সাহিত্যিকের নামও অলংকৃত করেছে বন : যেমন – বনফুল, বনবিহারী। বন নিয়ে গঠিত হয়েছে অনেক শব্দ। যেমন : বনকন্দ, বনকপোত, বনকর, নবকুক্কুট, বনচর, বনচাঁড়াল, বনচারী, বনজঙ্গল, বনজাত, বনতিক্ত, বনতুলসী, বনদেবতা, বনদেবী, বননিবাসিনী, বনপথ, বনপাল, বনফুল, বনবাদাড়, বনবাস, বনবিড়াল, বনবিহারী, বনভোজ, বনভোজন, বনমানুষ, বনমালী, বনমোরগ, বনরাজি, বনলক্ষ্মী, বনশ্রী, বসম্পদ, বনসাই, বনস্পতি প্রভৃতি। বন বলতে ফুলের বাগানও বোঝায়, যেমন : ফুলবন। হেমন্ত গেয়েছেন: “ সেদিনো বলেছিলে এই সে ফুলবনে – – -।” শচীন দেব বর্মণ গেয়েছেন, “নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা, নিশিতে যাইও ফুলবন। “ হেমন্ত-শচীনের বন আসলে অভিধানের জঙ্গল নয়। এটি অভিধানের কানন ও কুঞ্জ। অর্থাৎ বন হচ্ছে এমন একটি স্থান, যেটি অরণ্য নয়, আবার জঙ্গলও নয়।

জঙ্গল শব্দের অর্থ অভিধানে যাই থাকুক না কেন, বাক্য এবং কথায় শব্দটি সাধারণত ঝোপঝাড়পূর্ণ স্থান, নির্জনস্থান প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে অধিক ব্যবহৃত হয়। বন বা অরণ্য যদি বাঘ হয়, তাহলে জঙ্গল হচ্ছে বিড়াল এবং বন হচ্ছে চিতাবাঘ। চিতাবাঘমুক্ত স্থান জঙ্গল। তাই অরণ্য বা বনকে জঙ্গল বললে এদের অপমান করা হয়, কিন্তু জঙ্গলকে বন বা অরণ্য বললে জঙ্গল পুলকিত হয়, যদিও তা সঠিক নয়। অর্থাৎ সকল জঙ্গল, অরণ্য বা বন নয়; তবে প্রত্যেক অরণ্য বা বনে কিছু না কিছু জঙ্গল থাকেই।

উপর্যুক্ত আলোচনা হতে বলা যায়, অরণ্য হচ্ছে মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত ও পশুপাখির নিরাপদ পরিবেশমণ্ডিত ঘন গাছপালা-বেষ্ঠিত স্থান। বন হচ্ছে এমন অরণ্য যেখানে অরণ্যপশুর সঙ্গে মানুষের বসতিও কিছুটা রয়েছে। আর জঙ্গল হচ্ছে ছোটো বন। অতএব দেখা যায়, অধুনা খুব কম অরণ্যই অভিধানে বর্ণিত বিশুদ্ধ অরণ্য-চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে পারছে। আমাজান অরণ্যের গভীরে যাই হোক, ইতস্তত রয়েছে মানুষের বাস, ফুলের বাগান। তাই আমাজানের মতো গভীর অর‌ণ্যকেও বলা হচ্ছে, আমাজান বন। অবশ্য ইংরেজিতে এসব কাহিনি খুব কম।তারা ফরেস্ট দিয়েই সব কাজ সেরে ফেলে।

 

Leave a Comment

শ্রী মহাশয় থেকে জনাব, জনাব থেকে স্যার, মাননীয় ও মহামান্য

ড. মোহাম্মদ আমীন

শ্রী মহাশয় থেকে জনাব, জনাব থেকে স্যার, মাননীয় ও মহামান্য

 ‘জনাব’ একটি আরবি শব্দ। মুসলিমরাই শব্দটি উপমহাদেশে আনে। মূলত ব্যক্তি নামের পূর্বে সম্মানসূচক পদ হিসেবে শব্দটির প্রয়োগ। মুসলিম আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে মহাশয়, শ্রী প্রভৃতি শব্দের পরিবর্তে আরবি ‘জনাব’ শব্দটির প্রয়োগ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ইংরেজ আমল শুরু হলে ‘জনাব’ শব্দের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে এবং অল্প সময়ের মধ্যে মহাদাপটের সঙ্গে  ‘জনাব’ এর জায়গাটা দখল করে নেয় ‘স্যার’। ইংরেজি ‘স্যার’ শব্দের তেজ আর

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

ওজস্বিতার নিম্নে তলিয়ে যায় আরবি ‘জনাব’। প্রসঙ্গত, বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ইংরেজি স্যার শব্দ হচ্ছে শিক্ষক বা মান্য ব্যক্তিকে সম্বোধনে ব্যবহৃত শব্দ, আনুষ্ঠানিক পত্রের সম্বোধনে শ্রদ্ধা ও বিনয়ের প্রতীকরূপে ব্যবহৃত শব্দ, মহোদয়, ব্রিটিশ সরকারের প্রদত্ত খেতাব-বিশেষ প্রভৃতি। অভিধানমতে, স্যার ও জনাব সমার্থক হলেও আমরা কখনো  ইংরেজ ‘স্যার’কে আরবি ‘জনাব’-এর কাছেই যেতে দেইনি। স্যার আসার পর থেকে জনাব তলিয়ে যেতে থাকে। এখন তো জনাব রীতিমতো আপামর।

এবার দেখা যাক, কেন, কীভাবে এবং কখন ‘জনাব’ -এর জায়গটা ‘স্যার’ দখল করে নেওয়ার শক্তি পেল। যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেনে ‘স্যার’ ছিল ব্রিটিশ-রানি-প্রদত্ত একটি অতি সম্মানসূচক খেতাব। খ্যাতিমান, প্রভাবশালী, জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, কবিসাহিত্যিক, প্রশাসক, রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিদের রাজকীয় ‘স্যার’ খেতাবে ভূষিত করা হতো। স্যার, খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সর্বস্তরের লোকজনের কাছে অন্যদের চেয়ে সম্মানিত, প্রভাবশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হতো। তাই ‘স্যার’ ছিল প্রত্যেকের একটি অতি প্রত্যাশিত খেতাব। জনাব-এর বেলায় এমন কিছু ছিল না। মুঘল আমলেও জনাব ছিল অনেকটা অবহেলিত।

ব্রিটিশ রাজ ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর অনেকগুলো দেশ দখল করে নিয়ে তাদের কলোনি প্রতিষ্ঠা করে। নতুন দেশ দখলের পর ব্রিটিশ সরকার নিজ দেশের লোকদের মতো দখলীয় দেশের প্রভাবশালী ও খ্যাতিমানদেরও ‘স্যার’ খেতাব দিয়ে দখলদার শক্তির বশীভূত থাকার প্রেরণা দিয়ে বশংবদ করে নিত। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত পরাধীন দেশের প্রভাবশালীদের ‘স্যার খেতাব-প্রাপ্তি ছিল একটি মহাসম্মানের বিষয়। ব্রিটিশ-রাজ-প্রদত্ত ‘স্যার’ খেতাব প্রাপ্তদের প্রতি শাসকগোষ্ঠীও কিছুটা সমীহ প্রদর্শন করত। সংগত কারণে দেশীয়দের কাছেও তারা সম্মান, প্রভাব, মর্যাদা আর ক্ষমতার প্রতিভূ হয়ে ওঠে। ফলে ‘স্যার’ শব্দটি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাজ্যের অন্যান্য উপনিবেশের ন্যায় ভারতবর্ষেও অতি সম্মানজনক সম্বোধনে পরিণত হয়। স্যার সম্বোধন শুনলে ‘অ-স্যার’গণও পুলকিত হয়ে উঠতেন। বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীগণ পুলকিত হয়ে গদগদ করতেন ‘স্যার’ সম্বোধনে। বিড়ালকে বাঘ সম্বোধন করলে কে না-খুশি হয়? হোক না তা মিথ্যা, ভণ্ডামি বা কলঙ্কের!

ভারতবর্ষের জনগণ ব্রিটিশ প্রভুদের আনুকূল্য লাভের জন্য শুধু “খেতাবধারী-স্যার”দের নন, যে-কোনো প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদেরও ‘স্যার’ সম্বোধন করতে শুরু করে। ‘স্যার’ ডাক শুনলে তারা খুশি হতেন, গর্বিত বোধ করতেন, সম্মানিত বোধ করতেন, ফলে সহজে কাজ হাসিল হয়ে যেত। আস্তে আস্তে অবস্থা এমন হয়ে যায় যে, স্যার সম্বোধন না করলে সরকারি দপ্তরের চাকুরেরা অসম্মানিত বোধ করতে শুরু করে। ন্যাস্টি নেটিভ,‘ স্যার ডাকবে না, তা কী হয়? স্যার ডাকের এ মাজেজা দেশীয় রাজকর্মচারীদেরও সংক্রমিত করে। এভাবে ক্রমান্বয়ে স্যার শব্দটি খেতাবপ্রাপ্ত ছাড়াও প্রভাবশালী; বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসকদের সম্মান প্রদর্শনের অনিবার্য শব্দে পরিণত হয়। ফলে ‘জনাব’ শব্দটি আরো সাধারণ হয়ে যায়।

তবে এখনো জনাব শব্দটির বহুল প্রয়োগ লক্ষণীয়। কিন্তু তা কেবল আমজনতার কাছে এবং কেবল লেখার ভাষায় ব্যবহৃত হয়, মুখে কেউ কাউকে ‘জনাব’ সম্বোধন করে খুবই কম। মূলত ‘জনাব’ এখন এত সাধারণ হয়ে গেছে যে, কোনো সরকারি কর্মচারী বা জনপ্রতিনিধি কিংবা প্রভাবশালী কাউকে “জনাব—-” সম্বোধন করলে তা অপমান বলে মনে করে। বিশেষ করে সাধারণ জনগণ কোনো কাজে গিয়ে সরকারি কর্মচারীদের ‘স্যার’ শব্দের পরিবর্তে ‘জনাব’ সম্বোধন

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

করলে ওই কাজ না-হওয়ার, অধিকন্তু অপমানিত হওয়ার আশঙ্কা নিশ্চিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে তাদের অভিমত- আপনি আমাকে স্যার না-ডেকে অপমানিত করেছেন। আমি কেন করব না অপমান? এককালীন প্রভুদের ‘স্যার’ শব্দটি বর্তমানে আমাদের মতো সাধারণ জনগণের প্রভুদের ভূষণ হয়ে যায়। এখন তো অফিসের পিয়নও ‘স্যার’। রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ রানিপ্রদত্ত ‘স্যার’ খেতাব পরিত্যাগ করেছিলেন। ওই পরিত্যক্ত ‘স্যার’ নিয়ে আমরা পুলকিত হই, গর্বিত হই- পোষা-প্রাণী যেমন পুলকিত হয় প্রভুর ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টে।

ব্রিটিশ আমলে রানি ছিলেন সমগ্র রাজ্যের এবং বিশ্বের অনেকগুলো দেশের সরকার-প্রধান হিসেবে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে সার্বভৌম ক্ষমতার মহাপ্রতিভূ। রাজা-রানিকে সম্বোধন করা হতোে : এক্সালটেড হাইনেস, ইউর এক্সিলেন্সি, হার এক্সিলেন্সি প্রভৃতি কথায়। রানি ভিক্টোরিয়াকে ব্রিটিশেরা বলত, রানি; আমরা বলতাম মহারানি। রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিবর্গের অধিকাংশই ছিলেন রাজ পরিবারের ঘনিষ্ট বা তাদের আশীর্বাদপুষ্ট। তাই অধস্তনদের কাছে রাজ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্তগণও এক্সিলেন্সি, হাইনেস প্রভৃতি সম্বোধনে ভূষিত হতেন। এভাবে রাজপ্রতিনিধিগণ এক্সিলেন্সি শব্দে বারিত হয়; যা আমাদের দেশেও প্রচলিত- যার বাংলা মাননীয়, মহামানীয়, মহামান্য প্রভৃতি। যদিও বর্তমান সময়ের রাষ্ট্রপ্রতিনিধিগণ রাজার প্রতিনিধি নন, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। কিন্তু এখনো আমরা প্রাক্তন প্রভু ব্রিটিশের লেজুড়বৃত্তি হতে এখনো মুক্ত হতে পারিনি।

বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপধান। অর্ডার অব প্রিসিডেন্সমতে তিনি বাংলাদেশের প্রধান বা এক নম্বর ব্যক্তি। এক নম্বর ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সকল মাননীয় ব্যক্তির মাননীয়। সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অনুসৃত ব্রিটিশ শাসকদের রাজকীয় রীতি অনুযায়ী তাঁকে বলা হয় এক্সিলেন্সি বা এক্সালটেড হাইনেস; যার সাধারণ বাংলা হয় “মাননীয়”; কিন্তু রাষ্ট্রপতি যেহেতু মাননীয়দেরও মাননীয়, তাই বাঙালিরা শব্দটির বাংলা করেছেন মহামান্য। আমি যখন বঙ্গভবনে ছিলাম, তখন রাষ্ট্রপতি বলতাম না, বলতাম মহামান্য- মহামান্য এখন বিদেশে, মহামান্য অফিসে ঢুকছেন, মহামান্য আমাকে ডেকেছেন ইত্যাদি।

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

এবার সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিবর্গের নামের আগে মাননীয় শব্দের প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করা যাক। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গ জনগণের প্রতিনিধি। জনগণের পক্ষে, জনগণের জন্য, জনগণের কল্যাণে কাজ করার জন্য তার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। আমার কাজের জন্য আমার দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি আমার অধস্তন, জনগণের প্রতিনিধি জনগণের অধস্তন। জনপ্রতিনিধি, প্রকৃতপক্ষে জনগণের কত অধস্তন তা ভোটের সময় ভোটপ্রার্থীদের করুণ আর্তি দেখে বুঝে নিন। ঘরে ঘরে গিয়ে কী অসহায় ভঙ্গিতে করুণা প্রার্থনা করে। মনে হয় যেন এত অসহায় ভিক্ষুক পৃথিবীতে আর কেউ

নেই। এমপি-মন্ত্রীগণ জনগণের প্রতিনিধি। সে হিসেবে তারা জনগণের অধস্তন, জনগণের কাজ করার জন্যই তারা নিয়োজিত হয়েছে। তাই তারা জনগণের হুকুমের অধস্তন। অতএব, তাদেরেই উচিত জনগণকে ‘মাননীয়’ সম্বোধন করা। যেমন : উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে প্রেসিডেন্টকে বলা হয় মিস্টার প্রেসিডেন্ট, মানে জনাব প্রেসিডেন্ট; মন্ত্রীকে সম্বোধন করা হয় মিস্টার মন্ত্রী – – -। আর সেসব দেশের মন্ত্রী-এমপিরা জনগণকেও সম্বোধন করে একই রকম মিস্টার হিসেবে। সমান-সমান। কিন্তু আমরা বলি মাননীয় মন্ত্রী, মাননীয় এমপি। কিন্তু মন্ত্রী-এমপিগণ আমাদের ডাকেন আপামর। কী উদ্ভট! আমার ভোটে নির্বাচিত হয়ে, আমার প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়ে আমাকে করে দেয় আপামর, আর তারা হয়ে বসে মাননীয়। আমি অনেক মন্ত্রী এবং এমপিকেও অনেক সমাবেশে মহামান্য শব্দে সম্বোধিত হতে দেখেছি।

সরকারি কর্মচারীগণ জনগণের কর্মচারী, জনগণের অর্থে তাদের বেতন হয়- সে হিসেবে সরকারি কর্মচারীদের উচিত যাদের টাকায় তাদের বেতন হয়, তাদের অর্থাৎ জনগণকে স্যার ডাকা, মাননীয় ডাকা। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশসমূহে তাই করা হয়। জনগণকেই সরকারি কর্মচারীগণ সমীহ করেন, শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু আমাদের দেশে উলটো- কারণ ব্রিটিশপ্রভু এবং তার আগে মুগলপ্রভুদের প্রভাব হতে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। তাই আমার চাকরই আমাকে শাসায়, ভোগায় আর “গেট আউট” বলে ভাগায়।

উৎস:

  • কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ অপপ্রয়োগ, . মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
  • পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রমবিবর্তন, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
  • বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

 

Leave a Comment

আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ: আমন্ত্রণ বনাম নিমন্ত্রণ

ড. মোহাম্মদ আমীন

আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ: আমন্ত্রণ বনাম নিমন্ত্রণ

সংস্কৃত আমন্ত্রণ (+√মন্ত্র্+অন) শব্দের আভিধানিক অর্থ আহ্ববান, নিমন্ত্রণ ও সম্বোধন এবং সংস্কৃত নিমন্ত্রণ (নি+ √মন্ত্র্+অন) শব্দের আভিধানিক অর্থ দাওয়াত, ভোজনের আহ্বান, কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আহ্বান বা আমন্ত্রণ। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বঙ্গীয় শব্দার্থকোষেও উভয় শব্দের উৎস অভিন্ন ক্রিয়মূল (মন্) নির্দেশ করা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, অভিধানে নিমন্ত্রণআমন্ত্রণ শব্দের অর্থগত কোনো পার্থক্য নেই। তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অনির্ধারিত কিছু সুক্ষ্ণ পার্থক্য রয়েছে। অনেকে মনে করেন, যে সকল দাওয়াত বা আহ্বানে আহ্বানকারীর পক্ষ থেকে ভূরি-ভোজের ব্যবস্থা থাকে তাকে নিমন্ত্রণ এবং যেখানে আহ্বানকারীর পক্ষ থেকে সাধারণত ভোজের ব্যবস্থা থাকে না বা মাঝে মাঝে থাকলেও তা ভূরিভোজ নয়- তাকে আমন্ত্রণ বলে। এ ব্যাখ্যা কিয়দংশ ঠিক হলেও পুরোপুরি ঠিক নয়।

সাধারণত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে ছোটখাটো সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা অন্যান্য বিশেষ উৎসবসমূহে অভ্যাগতদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে নিমন্ত্রণ

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

শব্দটির অধিক ব্যবহার দেখা যায়। এ সকল দাওয়াতে সধারণত ভূরিভোজের ব্যবস্থা থাকে। অন্যদিকে বড়ো আকারের রাজনীতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াতের বেলায় আমন্ত্রণ শব্দটির অধিক ব্যবহার লক্ষণীয়। তবে এখানেও অনেক সময় ভূরিভোজের ব্যবস্থা না হলেও হালকা ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনেক আমন্ত্রণে ভূরিভোজের ব্যবস্থা থাকে। নিমন্ত্রণের আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অভ্যাগতরা সাধারণত বিভিন্ন রকমের উপহার সামগ্রী নিয়ে আসেন, কিন্তু আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে সাধারণত উপহার আনার রেওয়াজ নেই। আনা হলেও তাতে ব্যক্তি উদ্যোগের চেয়ে সমষ্টিগত বা আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ অধিক পরিলক্ষিত। নিমন্ত্রিত অতিথিদের আমন্ত্রিত অতিথিও বলা যায়। আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেক সময় উপহার সামগ্রী দেওয়া হয়, কিন্তু নিমন্ত্রিত অতিথিদের ক্ষেত্রে তা সাধারণত দেখা যায় না। যেমন : অনেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথিগণকে উপহারসামগ্রী প্রদান করা হয়। আমার এ ব্যাখ্যা সাধারণের জন্য, বিশেষজ্ঞদের জন্য আরো কিছু রয়েছে।

আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ বিষয়ে কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী লিখেছেন, “আজকাল ইংরেজির প্রভাবে প্রতীকী (লোগো-সেন্ট্রিক) প্রথায় ‘আমন্ত্রণ’=Invitation, এবং নিমন্ত্রণ=Invitation; অর্থাৎ দুটো বাংলা শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে । অথচ “বর্ণভিত্তিক-ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি” অনুযায়ী এই শব্দ-দুটিরই অর্থভেদ ছিল । ইংরেজির প্রভাবে আমরা এই শব্দদুটির বাকি অর্থগুলো ফেলে দিয়ে শুধু Invitation (‘ভোজনার্থ আহ্বান)-এ পরিণত করেছি ।আগে তা ছিল না । ‘মন্ত্রণা’ করার জন্য ডাকলে সে-ডাককে বলা হত ‘আমন্ত্রণ’ এবং ‘মন্ত্র’ দেওয়ার জন্য ডাকলে, তেমন ডাককে বলা হত ‘নিমন্ত্রণ’ । ‘আমন্ত্রণে’ ‘মন্ত্রের’ আয়োজন ছিল, ‘নিমন্ত্রণে’ মন্ত্রের নিয়োজন ছিল । একালের মতো করে বললে বলতে হয় – মন্ত্রী যখন জেলায় জেলায় বন্যা-পরিস্থিতি বিষয়ে ‘মন্ত্রণা’ করার জন্য জেলাশাসকদের ডেকে পাঠান, সেটি ‘আমন্ত্রণ’ । কিন্তু যখন বন্যা-মোকাবিলার উপায় বা ‘মন্ত্র’ তিনি নিজেই ঠিক করে রেখেছেন, শুধু সেটি রূপায়ণের উদ্দেশ্যে জেলাশাসকদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যদি তিনি তাঁদের ডেকে পাঠান, সেটি ‘নিমন্ত্রণ’ । আর যখন তিনি (১) মন্ত্রণা করার জন্য ডেকে পাঠান এবং অবশেষে একটা মন্ত্রে উপনীত হয়ে, (২) সেই মন্ত্র রূপায়ণ করার নির্দেশও দান করেন (অর্থাৎ দুটো কাজই একসঙ্গে পালন করেন) ফেরত পাঠালে, তাকে ‘আমন্ত্রণ’ ও ‘নিমন্ত্রণ’ দুইই বলা যায় । আর ‘মন্ত্রী’ তো ‘মন্ত্রণা’ করবেনই । কেননা, ‘মন’-কে ত্রাণ করে যে তাকেই তো ‘মন্ত্র’ বলে । এবং সেই ‘মন্ত্রের ধারক ও বিকাশসাধনকারী’কেই তো ‘মন্ত্রী’ বলে । মন, মন্ত্র, মন্ত্রী, আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ এই সব শব্দের ক্রিয়ামূল হলো ‘মন্‌’ ।”

শুভাশীষ চিরকল্যাণ পাত্রের ভাষায়, “ আমন্ত্রণে মন্ত্র আসে, নিমন্ত্রণে মন্ত্র নির্গত হয়। এই দিক থেকে বিচার করলে ওরা পরস্পরের বিপরীত শব্দ। উভয় ক্ষেত্রে মন্ত্রনাই আসল, খাওয়া-দাওয়া গৌণ। তবে কথা হলো, খালি পেটে মন্ত্র ভালো কাজ করে না। আমার এক শিক্ষক মহাশয় বলতেন, ”Without eating there is no meeting.” সুতরাং আমন্ত্রণ আর নিমন্ত্রণ যাই হোক, সঙ্গে খাওয়াদাওয়াও হয়। যারা মন্ত্র নেওয়া বা দেওয়ার কথা ভুলে গিয়ে খাওয়াটাকেই বেশি গুরুত্ত্ব দেন, তারা আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণকে সমার্থক শব্দ বলেও বিবেচনা করতে পারেন। তবে আমি বলব মন্ত্রের ব্যাপারটি ভুল গেলে চলবে না। আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ শব্দে খাওয়ার ব্যাপারটিই বরং নেই, উভয় ক্ষেত্রে আ ও নি উপসর্গের সঙ্গে মন্ত্রণ শব্দটিই আছে। সুতরাং এখানে মন্ত্রকে ভুলে গেলে চলবে না। কেউ তা করলে ব্যাকরণবিদদের মন খারাপ হয়।”

প্রয়োগ : (১) আলোচন শেষ হওয়ার পর মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিমন্ত্রিত অতিথিবর্গকে চা পানের আমন্ত্রণ জানালেন। (২) রশিদ সাহেবের মেয়ের বিয়েতে তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। (৩) শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। (৪) আমন্ত্রিত প্রধান অতিথিকে সম্মানস্বরূপ এক সেট গ্রন্থ প্রদান করা হয়েছে।

 

 

 

Leave a Comment

বাংলা বাঙালা বাঙ্গালা

. মোহাম্মদ আমীন

বাংলা বাঙালা বাঙ্গালা

বৈয়াকরণদের বিশ্লেষণে জানা যায়, ‘বঙ্গ’ শব্দ থেকে বাঙ্গালা ও বাঙালি শব্দের উদ্ভব। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণেও অভিন্ন বিষয় ওঠ আসে। অনেক বছর আগে, মূলত ভাষা ও জাতি অর্থে ‘বাঙ্গালা’ এবং ‘বাঙ্গালি’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়। কালক্রমে তা হয়ে দাঁড়ায় বাঙলা, বাঙালি এবং আরও পরে বাংলা শব্দে এসে স্থিতি লাভ করে। আ-কার থাকায় জাতি অর্থ প্রকাশে অনুস্বার বাদ দিয়ে ‘বাংলা’ শব্দটিকে ‘বাঙালি’ লেখা হয়। কারণ, অনুস্বারে স্বরচিহ্ন যুক্ত করার নিয়ম নেই। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অনুস্বার (ং) অনুমোদন করেননি। তিনি নিজে বিভিন্ন সময়ে বাঙ্গালা, বাঙ্গলা ও বাঙ্লা লিখেছেন। কখনো ‘বাংলা’ লেখেননি। তিনি বলেছেন, “সঙ্গতি রাখিবার জন্য অনুস্বার দিয়া বাংলা না লিখিয়া চলতি ভাষায় বাঙলা (বাঙ্‌লা) লেখাই ভাল।”

বঙ্গ শব্দের উদ্ভব ঘটেছে বঙ্গা থেকে। বঙ্গা অর্থ সূর্য। আর্য তো দূরের কথা দ্রাবিঢ়দেরও পূর্বে এদেশের মানুষ বঙ্গাকে দেবতা হিসেবে মান্য করত। তখন কোনো

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

ধর্ম বা ধর্মীয় বিধি-বিধানের সৃষ্টিও হয়নি। সূর্যকে অনেক দেশে দেবতা হিসেবে গ্রহণ করলেও তাদের বহু পূর্বে এদেশের মানুষ বিশ্বের মধ্যে প্রথম বঙ্গা অর্থাৎ সূর্যকে দেবতারূপে স্বীকার করেছে। এজন্য গবেষকেদের ধারণা বঙ্গা থেকে দেশের নাম হিসেবে বঙ্গ শব্দের উদ্ভব। এতদ্‌ঞ্চলের আদি ভাষা ছিল প্রাকৃত। তাকে সংস্কার করে হয়েছে সংস্কৃত। সুতরাং সংস্কৃত আলাদা কোনো ভাষা নয়। বাংলা ভাষারই একটি পণ্ডিতি রূপ মাত্র। প্রাকৃত তথা বাংলা থেকে সৃষ্ট সংস্কৃত ভাষাটি পণ্ডিতদের দখলে থাকায় সাধারণ মানুষ তাকে প্রত্যাখান করেছে। সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য বর্জন করে দেশি-বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটানোর রেওয়াজ শুরু করেন। ভাষা যেহেতু গণমানুষের তাই তাদের প্রয়োগরীতিকে অস্বীকার করা যায় না। তাই ভাষায় পরিবর্ত অনিবার্য। বাংলা সেই অনিবার্যতার একটি মনোরম ও সর্বজনীন রূপ। প্রসঙ্গক্রমে সুভাষ ভট্টাচার্য এই অভিমতন ব্যক্ত করেছেন যে, এই সংগতি অনিবার্য নয়। বাংলায় এমন বহু শব্দ আছে, যা বর্তমানে অনুস্বার দিয়ে লেখা হলেও, আ-কার, এ-কার প্রভৃতি যোগ হলে ‘ঙ’ এসে যায়। যেমন : রং থেকে রঙের, ব্যাং থেকে ব্যাঙাচি; বাংলা ও বাঙালির ক্ষেত্রেও তেমন ঘটলে তাতে আপত্তির কারণ নেই।”

বাংলা শব্দটি শুধু ভাষা বা জতি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। অনেকে উপাধি হিসেবেও ব্যবহার করে থাকেন। আমার এক বন্ধুর নাম হিরু বাঙালি। বাংলাদেশের অনেক গ্রামের নাম আছে বাংলাগ্রাম,বাংলাপাড়া ইত্যদি। আর্মেনিয়ার মালাতিয়া সেবাস্তিয়া জেলার একটি ছোটো এলাকার নাম বাংলাদেশ। আর্মেনীয়রা যখন এ দেশে খুব প্রভাবশালী ছিল সেই সপ্তদশ শতকে অনেক বাঙালি তাদের আর্মেনীয় বসের কারণে যাতায়াতের সুবাদে ওখানে বসতি গড়ে তুলেছিল। তাই এলাকটির নাম হয় বাংলাদেশে। অনেকে মনে করেন, এটি বিশ্বের প্রথম বাংলাদেশ নাম। রং শব্দের বানান একসময় রঙ্গ (রঙ) লেখা হতো। অনেক শব্দের ‘ঙ্গ’ পরবর্তী কালে ‘ঙ’ হয়ে গিয়েছে। যেমন : কাঙ্গাল কাঙাল, সঙ্গিন সঙিন, রঙ্গিন রঙিন, ভাঙ্গা ভাঙা, ডাঙ্গা ডাঙা প্রভৃতি। ‘সং’ বানান সম্পর্কে অনেকের আপত্তি থাকলেও সঙ, রঙ, ঢঙ প্রভৃতি অপেক্ষা সং রং এবং ঢং এখন অধিক প্রচলিত ও জনপ্রিয়। সুনীতিকুমার এবং মুহম্মদ আবদুল হাই অনুস্বারের প্রধান বিরোধী ছিলেন। আবদুল হাই লিখেছেন, “হরফ সংস্কারের সময় অনুস্বারকে বর্জন করা উচিত। অনুস্বারের সব প্রয়োজন ঙ মেটাতে পারে। ঙ-এর প্রয়োজন অনুস্বার মেটাতে পারে না।”

আবদুল হাই সাহেবের মন্তব্যের প্রতিমন্তব্যে সুভাষ ভট্টাচার্য লিখেছেন, “কিন্তু আবদুল হাইয়ের এই মন্তব্য সত্ত্বে বর্তমান ঝোঁক অনুস্বারের দিকেই।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম দিকে ‘বাঙ্গালা’ লিখতেন। পরে ‘বাঙলা’ এবং আরও পরে বিনা দ্বিধায় ‘বাংলা’ লিখেছেন। মণীন্দ্রকুমার ঘোষ লেখেন ‘বাংলা’। ‘বাংলা বানান’ নামের তাঁর একটি গ্রন্থও রয়েছে। চিন্তাহরণ চক্রবর্তীও লিখেছেন বাংলা। রাজশেখর বসু ‘বাংলা’ ও ‘বাঙলা’ দুইই লিখেছেন। এখন বাংলা সাহিত্যের খ্যাত-অখ্যাত সব সাহিত্যিকই ‘বাংলা’ লেখেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেও ‘বাংলা’ লেখা হয়েছে। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানেও বাংলা বানানকে প্রমিত নির্দেশ করা হয়েছে। সর্বোপরি, আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। বাঙলাদেশ নয়। সব প্রয়োজন মেটাতে পারে না বলে কোনো অক্ষরকে বাদ দেওয়ার জন্য হাই সাহেবের মন্তব্যকে অনেক বুদ্ধিজীবী হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ কোনো বর্ণ দিয়ে সব প্রয়োজ মেটানো যায় না।

বর্তমানে বাংলা শব্দটি এতই জনপ্রিয়, প্রচলিত এবং লেখ্যবান্ধব যে সুনীতিকুমারের আপত্তি অগ্রাহ্য হয়ে গিয়েছে। আবদুল হাই সাহেবের কথা হয়ে গেছে অপাঙ্‌ক্তেয়। বাংলা শব্দের কাছে বাঙ্গালা, বাংলা, বাঙ্গলা সবকটি শব্দ পরাজিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে ‘বাংলা’। আগে কী লেখা হতো সেটা গবেষণার বিষয় হতে পারে, প্রায়োগিক কিছু নয়। তা হলে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিমানে চড়ে আমাদের আটলান্টিক পাড়ি দিতে হবে। ভাষা জীবন্ত প্রকৃতির মতো। এর পরিবর্তন অনিবার্য। তাই পরিবর্তনকে গ্রহণ করাই জীবন্ত ভাষার বৈশিষ্ট্য। অতএব আমরা ‘বাংলা’র পক্ষে। 

#subach

Leave a Comment

ভিআইপি কথার অর্থ: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি; অত্যন্ত নপংসুক ব্যক্তি

ভিআইপি কথার অর্থ

ড. মোহাম্মদ আমীন

ভিআইপি (VIP) শব্দের পূর্ণরূপ কী? প্রশ্ন করেছিলেন, গাছবাড়ীয়া নি. গৌ. উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রী অমরনাথ ভট্টাচার্য। স্যারের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম, “Very Impotent Person”. সে অনেক দিন আগের কথা। তবে, এখনো মনে আছে। উত্তর শুনে অমরনাথ স্যার, চোখমুখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বাঘের মতো গর্জন করে আবার জানতে চেয়েছিলেন, পিচ্চি, কী বললি তুই? আমি আগের মতো শব্দে, কিন্তু সংশিত গলায় বলেছিলাম, “Very Impotent Person”, স্যার। “কে বলেছে?” স্যারের দ্বিতীয় প্রশ্ন। ‘‘বাবা।’’ আমার সহজ-সত্য উত্তর।

‘বাবা’ শুনে অমরনাথ স্যারের চোখ মগডালে। তিনি নিশ্চিত, আমার বাবা অমন কথা বলতে পারেন না। আমি মিথ্যা বলেছি, নয়তো ভুল বলেছি। এরপর অমরনাথ স্যার, ক্লাসে আর কখনো এই প্রশ্নটি কাউকে করেননি। তখন বুঝতে পারিনি, কেন করেননি। তবে, স্যারের চোখমুখ দেখে বুঝেছিলাম, উত্তরটা তাঁর মনঃপুত হয়নি, কিন্তু উত্তরটা শুদ্ধ ছিল কি না, তাও বলেননি। অবশ্য আমার উচ্চারণের শুদ্ধতা নিয়ে আমার নিজেরই যথেষ্ট সন্দেহ ছিল এবং এখনো আছে। ‘ভাত খাব’ বাক্যটাকে উচ্চারণ করি, “বাত খাব”। ছেলেমেয়ে হেসে বলে, কাব্বি, ‘ভাত’ কিন্তু ‘বাত’ নয়।

আমার ডান পাশে বসা সহপাঠী রঞ্জন কানে কানে বলেছিল, “আমীন, ভিআইপি মানে “Very Idiot Person”, তুমি ভুল বলেছ।” রঞ্জনের ব্যাখ্যা শুনে সংশয়টা আরো জোরালো হয়ে উঠেছিল। তাই মনে হলো, আমার উত্তরটা ভুল। এজন্যই স্যার বাঘের মতো গর্জন করেছেন, কিন্তু বাবা যে বললেন–মনে মনে ভাবতে থাকি অনুশোচনায়। বাম পাশে বসা কাদের যখন বলল, “ভিআইপি শব্দের পূর্ণরূপ, “Very Isolated Person”, ওই যে, অ্যাবনরমালগণ যেমন আইসোলেটেড থাকতে চান।” তখন সন্দেহটা আরো প্রবল হলো। 

চুপে চুপে বলছি, ছাত্র হিসেবে আমি ছিলাম তৃতীয় স্তরের। কখনো ভালো ছাত্র ছিলাম না। কুমকুম স্যার ছাড়া সব শিক্ষক মনে করতেন, আমি বড়ো হয়ে বড়োজোর সদাগরি অফিসের পিয়ন হতে পারব। তারপরও নিজের উত্তর থেকে নড়িনি। Impotent বলেই তারা প্রতিবন্ধী এবং প্রতিবন্ধী বলেই সাধারণ ও স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনধারণ করতে পারে না। তাই আগেভাগে রাস্তা পরিষ্কার করে রাখতে হয়, তারা উলটো পথে চলে, তাদের জন্য ফেরিকেও থেমে থাকতে হয়। রঞ্জন এখনো বলে, VIP কথার পূর্ণরূপ, Very Idiot Person, তা না হলে কি VIP- দের জন্য সাধারণ মানুষকে এত ভোগান্তিতে পড়তে হয়? বোকাদের জন্যই তো সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়, না কি? তাই তো! তাহলে, কাদেরের কথাও সত্য। ভিআইপিগণ মানসিক রোগির মতো সর্বদা আইসোলেটেড থাকতে চায়।

আমার এক চাচা বলতেন, ‘Important; অর্থ গুরুত্বপূর্ণ আর `Impotent’ অর্থ নপুংসক। যারা গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে কিংবা স্টিকার পরিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক গর্দভের মতো উলটো বা ভুল পাশে (wrong side) গাড়ি চালিয়ে সাধারণ জনগণের সাবলীল চলাচলকে দুর্বিষহ করে দিলেও পথশৃঙ্খলারক্ষাবাহিনীর বাধার সম্মখুীন হতে হয় না তাঁদের ভিআইপি বা VIP বা অত্যন্ত নপুংসক ব্যক্তি (Very Impotent Person) বলা হয়। একদিন দেখি চাকুরিসূত্রে আমার নামের সঙ্গেও ভিআইপি লেগে গেছে। হায়, হায়! আমি কী Impotent হয়ে গেলাম? না। তখন এর পূর্ণরূপ দিলাম, Very Important Person. অধুনা, চারিদিকে লাখ লাখ ভিআইপি-মানুষ এবং হাজার হাজার গাড়ি-ভিআইপি দেখে মনে হয়, পুরো দেশটাই বুঝি ভিআইপি হয়ে যাবে। তাদের কাণ্ড দেখে মনে হয়, ভিআইপি অর্থ “Very Impotent Person”। ভিআইপি লাখ লাখ হলেও এরা প্রকারন্তরে সংখ্যালঘু। এদের আচরণ দয়া বা সহানুভূতির অধিকার রাখে না, করুণা আর ঘৃণাই এদের পাওনা।

অমিতাভ বচ্চন ট্রাম্প এবং বাংলাদেশের মদন

#subach

Leave a Comment

হাইপাতিয়া: ধর্মের কারণে গণপিটুনিতে নিহত বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ; ধর্মমৃত্যু, ধর্মের মৃত্যু: ধর্মের কারণে মৃত্যু

হাইপাতিয়া: ধর্মের কারণে গণপিটুনিতে নিহত বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ; ধর্মমৃত্যু, ধর্মের মৃত্যু: ধর্মের কারণে মৃত্যু

ড. মোহাম্মদ আমীন

প্যাগান ধর্মানুসারী বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ এবং গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক-বক্তা হাইপাতিয়া বিশ্বের প্রথম মহিলা গণিতজ্ঞ, যার কার্যাবলি সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়। হাইপাতিয়া ৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের অর্ন্তগত মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।হাইপাতিয়ার বাবা তিয়ন; তিনিও ছিলেন গণিতজ্ঞ । তিয়ন ইউক্লিডের “ইলামেন্টস (Elements) গ্রন্থের টীকা-ভাষ্যকার ও সম্পাদনার কাজ করেছিলেন। দর্শন, বিজ্ঞান ও গণিতের উপর হাইপাতিয়ার প্রবল দখল ছিল। এসব বিষয় তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন। ত্রয়োদশ খণ্ডে রচিত দায়োফান্তাস ( Diophantus)-এর আর্থমেটিকা (Arithmetica) গ্রন্থের যথার্থ মন্তব্য ও টীকা লেখক হিসেবে হাইপাতিয়া আধুনিক গণিত জগতেও খ্যাত। এখনো পরম শ্রদ্ধায় স্মরিত হন তিনি। উল্লখ্য, টলেমির (Ptolemy) আলগেমিস্ট (Almagest) গ্রন্থের ভাষ্যকার হিসেবেও হাইপাতিয়া খ্যাত। অ্যাস্ট্রোবেল এবং হাইড্রোমিটার-এর উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। বর্তমানে ব্যবহৃত হাইড্রোমিটার হাইপাতিয়ার হাতে এমন উন্নত হওয়ার পথ খুঁজে পায়।

হাইপাতিয়া ছিলেন তৎকালীন রোমান সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ এবং অবিসংবাদিত দার্শনিক বক্তা। মাতবাদিক দ্বন্দ্বে বির্যস্ত মানুষকে নারী-পুরুষ এবং জাতি ও ধর্মনির্বিশেষে পরস্পর সহানুভূতিশীল করে তোলাই ছিল তার দর্শনের মূল। তিনি মনে করতেন, এটি নিশ্চিত করা গেলে বিশ্বশান্তি বহুলাংশে নিশ্চিত হয়ে যাবে। এসব নিয়ে তিনি বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন। তাই তাকে প্রথম মহিলা দার্শনিক বক্তা বলা হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সর্বধর্মের প্রতি সৌহার্দ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করার কাজ করতেন। বিদ্যমান কোনো ধর্মবিশ্বাসের প্রতি তার কোনো অশ্রদ্ধা ছিল না। সবার প্রতি তাঁর মমতা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ৪১৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্য ভাগের এক দিনের কথা। প্রতিদিনের মতো ওই দিনও হাইপাতিয়া ধর্মীয় সহিষ্ণুতার উপযোগ নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। এসময় স্থানীয় সিটি বিশপ সেন্ট ক্যারিলের নির্দেশে এক পাদ্রির নেতৃত্বে এক দল খ্রিষ্টান এসে তাকে ধরে টেনে হিচড়ে গির্জার ভিতর নিয়ে যায়। হাইপাতিয়া এমন জঘন্য আচরণের কারণ জানতে চাইলেন।

মূর্খ ধর্মবাজ বিশপ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, বিজ্ঞান ধর্মবিরুদ্ধ, বিজ্ঞানী ধর্মনাশক, অধিকন্তু তুমি নারী। নারী হয়েও তুমি ধর্মবিরুদ্ধ কাজ করে যাচ্ছ। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখলে যিশু কষ্ট পাবেন।পবিত্র তিন আত্মার নির্দেশ এসেছে তোমাকে হত্যা করার। আমি তোমাকে পবিত্র আত্মার নির্দেশে মৃত্যুদণ্ড দিলাম। এরপর এক ঝাঁক ধর্মবাজ হাইপাতিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এক দিন পর তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে রোমান সম্রাট দুঃখ প্রকাশ করে হাইপাতিয়াকে “দর্শনের জন্য শহিদ” আখ্যায়িত করেন। বর্তমানে হাইপাতিয়া নারীজাগরন আন্দোলনের বিশ্বপথিকৃৎ।

#subach

Leave a Comment

ধর্ষণ অবহেলিত একটি কারণ: ধর্ষণ কেন করে

ধর্ষণ অবহেলিত একটি কারণ: ধর্ষণ কেন করে

ড. মোহাম্মদ আমীন

‘ধর্ষণ’ এক ধরনের যৌন আক্রমণ।  বাংলাদেশে ইদানীং এই আক্রমণটা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে, বেড়ে গেছে ধর্ষণের সঙ্গে হত্যা। ধর্ষনের প্রকৃতিও নিষ্ঠুর, ছাত্র ধর্ষণ করছে শিক্ষার্থীদের। ধর্ষণের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর হচ্ছে শিশুধর্ষণ। বাংলাদেশের গত  এক বছরে এমন একটা দিন যাইনি, যেদিন এক বা একাধিক শিশু ধর্ষিত হয়নি। নারীদের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশের ১৪টি দৈনিক পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে বলছে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ১০৫০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগের বছর সংখ্যাটা ছিল আরো বেশি। তবে, পত্রিকায় আসেনি এমন ধর্ষণের সংখ্যা আরো বেশি। কারণ, ধর্ষণের বিষয়টি অধিকাংশ লোকই সামাজিক কারণে গোপন রাখতে চায়। প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে মোট ১ হাজার ২৫১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তন্মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২২৪ জন নারী ও শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৮ জনকে।  ধর্ষণসহ অন্যান্য নির্যাতনের মোট ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ২৩৫টি।

একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি করে ধর্ষণ হচ্ছে। সে হিসেবে প্রতিঘণ্টায় ১২ জন, প্রতিদিন ২৮৮ জন এবং প্রতিবছর ১০ লাখ ৫৩ হাজার ৭৯২ জন ধর্ষিত হচ্ছে। ধর্ষণ শুধু ধর্ষিতকে নয়,  একই সঙ্গে তার আত্মীয়-স্বজনের জীবনেও নানা মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।  প্রতিধর্ষণের সঙ্গে ধর্ষিতের পরিবার-পরিজন এবং আত্মীয়-স্বজন মিলে গড়ে ৬৭ জন আত্মীয় নানাভাবে নানা প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হন। সে হিসেবে বছরে ৭ কোটি ৬ লাখ ৪ হাজার ৬৪ ব্যক্তিকে একটি ধর্ষণের জন্য লজ্জিত, আক্রান্ত, অপদস্থ বা সামাজিক হয়রানির শিকার হতে হয়। সুতরাং, ধর্ষণ যে, সমাজের জন্য একটি অত্যন্ত মারাত্মক হুমকি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বড়ো আজব বিষয় হলো, ধর্ষণ-অপরাধে ধর্ষিতা নিরপরাধ হলেও তাকে এমনভাবে থাকতে হয়, যেন সেই অপরাধী। কোনো মেয়ে ধর্ষিত হলে পুরুষের চেয়ে মেয়েটাকে  বেশি লজ্জায় পড়তে হয়। এ এক উদ্ভট সমাজ, উদ্ভট ব্যবস্থা। ধর্ষণের অনেকগুলো কারণ আছে, তবে  যে কারণটি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে, সেটিই নানা কারণে উপেক্ষিত। এটি ধর্ষণ-অপরাধ বিস্তারের অন্যতম কারণ।

যেসব দেশে বৈধ যৌনালয় নেই বা প্রয়োজনের তুলনায় কম সেসব দেশে ধর্ষণ বেশি হয়। মধ্যপ্রাচ্যেও এখন প্রচুর বৈধ যৌনালয় আছে। যে জনপদে পায়খানা থাকে না, সেই জনপদ পুরোটাই মলে মলে মলে ভরে যায়। অসহনীয় হয়ে উঠে মানুষের জীবন। তাই যৌন ব্যবসায় পৃথিবীর আদিম ব্যবসায় হিসেবে গড়ে উঠেছিল। যে লোক যৌনালয়-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়, দেখা গেছে- সেই প্রথম এর প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়। যৌন-তাড়না অনেক সময় মল-ত্যাগের তাড়নার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠে। বৈধ ও নির্দিষ্ট যৌনালয়ের অভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে এখন অসংখ্য বাসাবাড়ি যৌনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত, বাড়ছে যৌনাপরাধ।যৌন অপরাধকে কমিয়ে আনার লক্ষে  বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন ব্যবস্থার প্রচলন আছে। এ প্রসঙ্গে  মুতাহ বিবাহের কথা উল্লেখ করা যায়। 

মানুষ নিশ্চিত মনে পবিত্র হয়ে প্রার্থনা গৃহে যায়। তাই প্রার্থনা গৃহ নির্মাণের আগে প্রযোজন পায়খানা গৃহ এবং ধৌতস্থান নির্মাণ। সাধারণত এটিই করা হয়ে থাকে।  নিবিষ্ট প্রার্থনার জন্য প্রত্যেককে মলের চাপমুক্ত হয়ে প্রার্থনা গৃহে ঢুকতে হয়। নইলে নিজের সঙ্গে সঙ্গে অন্যের প্রার্থনায়, এমনকি প্রার্থনাগৃহও অপবিত্র হয়ে যাওয়া আশঙ্কা থাকে। যৌন আবেগ প্রবল হয়ে গেলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে যায়, ঠিক যেমন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে  পেটে প্রকৃতির ডাক পড়লে।  এসময় উপযুক্ত জায়গা না-থাকলে হিতাহিত মানুষ যত্রতত্র মল ত্যাগ করতে পারে। তখন দূষিত হয়ে পড়ে পরিবেশ।  বিষয়টি আমাদের খুব গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

#subach

Leave a Comment

ডেঙ্গু শব্দের অর্থ: ডেঙ্গু কী এবং কেন: ব্যুৎপত্তি, উৎপত্তি

ডেঙ্গু শব্দের অর্থ: ডেঙ্গু কী এবং কেন: ব্যুৎপত্তি, উৎপত্তি

ড. মোহাম্মদ আমীন

 “ডেঙ্গু” শব্দের আদি উৎস সম্পর্কে গবেষকগণ নিশ্চিত নন, যদিও রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বলা হয়, শব্দটির উৎস সোয়াহিলি(Swahili)। সোয়াহিলি শব্দবন্ধ “কা-ডিঙ্গা পেপো” থেকে ‘ডেঙ্গা’ শব্দের উদ্ভব। প্রসঙ্গত, “কা-ডিঙ্গা পেপো” শব্দবন্ধের অর্থ, দুষ্ট আত্মার কারণে সৃষ্ট রোগ। আফ্রিকান লোকজন মনে করত, এই রোগটি দুষ্ট আত্মারা ছড়ায়। অনেকের মতে, শব্দটির অর্থ “জলীয় বিষ” এবং ‘হাড়ভাঙ্গা’। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ‘ডিঙ্গা’ এসেছে স্পেনীয় শব্দ Dengue থেকে। যার অর্থ ছিল, খুঁতখুঁতে, সবাধানি, স্পর্শকাতর প্রভৃতি। এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগিরা সাধারণত খুঁতখুঁতে বা অতি সাবধানি হয়ে পড়ত। তাই রোগটির নাম হয় Dengue। তবে, জাতিভেদে রোগটির লক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন দেখা যেত। যেমন, ওয়েস্টইন্ডিজের ক্রীতদাসরা এ রোগে আক্রান্ত হলে ভঙ্গিমা ও চলন ডান্ডি বা নৌকার মতো হয়ে যেত। তাই রোগটি “ডান্ডি জ্বর” নামেও পরিচিত ছিল।

অনেকের মতে, ডেঙ্গু শব্দের অর্থ, “break-bone”। সুতরাং, ডেঙ্গু জর অর্থ “break-bone fever”। পেশী ও হাড়ে যন্ত্রণা এ জ্বরের অন্যতম লক্ষণ বলে রোগটির নাম হয় “break-bone fever”। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দের ফিলাডেলফিয়ার মহামারীর উপর লিখিত ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিবেদনে পদার্থবিদ বেঞ্জামিন রাশ প্রথম “break-bone fever” কথাটি ব্যবহার করেন। ডেঙ্গুর জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য শব্দের মধ্যে “ব্রেকহার্ট ফিভার” এবং “লা ডেঙ্গু” উল্লেখযোগ্য। প্রবল রোগের জন্য ব্যবহৃত শব্দের মধ্যে “ইনফেকচুয়াস থ্রম্বোসাইটোপেনিক পার্পারা”, “ফিলিপাইন”, “থাই হেমোরেজিক ফিভার” এবং “সিঙ্গাপুর হেমোরেজিক ফিভার” অন্যতম।তবে, যেসব দেশে এ রোগটি প্রথম দেখে ছড়িয়ে পড়ছিল সেসব দেশে রোগটি ‘ডেঙ্গু’ নামে অভিহিত হতো। তাই নানা নামের মধ্যে ডেঙ্গু নামটিই মুখ্য হয়ে উঠে। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের পর ডেঙ্গু জ্বর শব্দটির ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়।

প্রসঙ্গত, সম্ভাব্য ডেঙ্গু জ্বরের ঘটনার প্রথম বিবরণ পাওয়া চীনে। জিন বংশের (২৬৫-৪২০ খ্রিষ্টাব্দ) আমলে এক চীনা মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়ায় “জলীয় বিষ” নামের একটি নতুন রোগের কথা বলা হয়, যা উড়ন্ত পতঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ রোগটি উড়ন্ত পতাকা হতে সৃষ্ট, কিন্তু তা যে মশা সেটি নিশ্চিত ছিল না। মূলত, ওই রোগটিই ছিল আধুনিক ডেঙ্গু। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে “এডিস ইজিপ্তাই” মশার পরিবাহিতা নিশ্চিত হয়।

#subach

Leave a Comment