ইউসুফ খান
plagiarism
যে বউয়ের বাচ্চা দেবার ক্ষমতা নেই, দিনরাত শাশুড়ির গঞ্জনা খাচ্ছে, সে হাসপাতাল থেকে অন্যের ছেলে চুরি করে নিয়ে এসে নিজের বাচ্চা বলে চালাতে চাইছে, এমন খবর মাঝে মাঝে খবরের কাগজে আসে। একে বলে ছেলে চুরি। প্লেজারিজ়ম plagiarism

এর আক্ষরিক মানে ছেলে চুরি করা। কারও সন্তান-তুল্য লিখিত সৃষ্টি চুরি করাকে প্লেজারিজ়ম বলা চালু হয়েছিলো রোমে, সেই প্রথম শতাব্দীতে। ইংরেজ সেটা বলতে শেখে সতেরো শতাব্দীতে। যার নিজের লেখার ক্ষমতা নেই সে অন্যের লেখা চুরি করে সেটাকে নিজের লেখা বলে পোস্ট করে দিচ্ছে এমন ঘটনা ফেসবুকে এখন প্রতি মিলিসেকেন্ডে হচ্ছে। এই চুরিতরঙ্গ রুধিবার কোনও উপায় আপাতত নেই। তবে থিওরেটিক্যালি উপায় বার করা সম্ভব, যাতে পোস্টিং এর সময়ই আটকে যায়।
কুম্ভিলক
লম্বাটে ঝোলা লাউ হচ্ছে কুম্ভ, আর গোল লাউ হচ্ছে তুম্ব। পরে চালানি গোলকুমড়োকেও বলা হতো তুম্ব। লম্বাটে লাউ শেপের কলসিও তাই কুম্ভ। গোদে ফোলা পা হচ্ছে কুম্ভ-পদ। গাঁট ফোলা কামলা মানে জন্ডিস রোগের নাম কুম্ভ-কামলা। আরও অনেক এরকম যৌগিক শব্দ আছে। অলমিতি বিস্তরেণ।
এই কলসি মানে কুম্ভের মতো যার মুখের খোঁদলটা সে কুম্ভিল, মানে আমাদের কুমির। এটার সংস্কৃত করা হয়েছে কুম্ভীর। কুমির জলে বা ডাঙায় প্রায় নট নড়ন চড়ন হয়ে ভেসে বা বসে থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে, খুব ধীরে ধীরে, শিকারের দিকে এগোতে থাকে চুপি চুপি ছুপি ছুপি। তারপর একসময় ঘাপ করে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ঘাড় মটকে নিয়ে জলের তলায় চলে যায়। কুম্ভিলের মতো মানে কুমিরের মতো যে ছুপি ছুপি মানে লুকিয়ে লুকিয়ে যায় সে কুম্ভিলক। কুম্ভিলক কথাটা ভীষণ প্রাচীন, মগধ থেকে শুরু করে পূর্বভারতেই কথাটা চলতো। খ্রিস্টপূর্ব যুগের নাট্যকার শূদ্রক তাঁর মৃচ্ছকটিকম্ নাটকে কুম্ভিলক বলে একটা চরিত্র রেখেছেন। নাটকের লোকেরা বলতে পারবেন কুম্ভিলক লুকিয়ে লুকিয়ে যাতায়াত করা চোর বা চর ছিলেন কি না। যে সব পুরুষ বা মহিলা পরকীয়া করতে যেতো লুকিয়ে লুকিয়ে তারাও কুম্ভীর। পরের দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে আসা সিঁধেল চোর বোঝাতেই কুম্ভিলক কথাটা দাঁড়িয়ে যায়।
কুম্ভিলকবৃত্তি
আগেকার দিনে নাট্যকার পুঁথিকাব্যের-কবি পদাবলীর-পদ্যকার কীর্তনের-কর্তা খুব কম লোকেই হতো। যে দু চারজন হতো তারা সবাই বিখ্যাত হতো। তাদের পদ লোকের মুখে মুখে ফিরতো। সেযুগে ক্যামেরা জ়েরক্স পিডিএফ ছিলো না বলে, লোকে মূল পুঁথি কয়েক মাসের জন্য ধার নিয়ে নিজে বা লিপিকর দিয়ে তালপাতার পুঁথিতে কপি করে নিতো। এই লিপিকররা কিছু কথা বুঝতে না পারলে, নিজের কথা বসিয়ে দিতো; সেখান থেকে আবার কপি হলে সেকেন্ড কপি আরো বদলে যেতো, এরকম চলতেই থাকতো। এটা বোঝাতেই একটা প্রবাদ আছে – সাত নকলে আসল খাস্তা। এর মধ্যে কিছু উৎসাহী লিপিকর দুচারটে পদ নিজেই লিখে ঢুকিয়ে দিতো। মানে চুপি চুপি ট্রোজ়ান হর্স ঢুকিয়ে দেওয়া। যাকে পণ্ডিতরা বলে প্রক্ষিপ্ত পদ। মূল লেখার সুরে সুর মিলিয়ে লেখা বলে সবাই ধরতে পারতো না। লিপিকর, তার লেখাটাকে লোকে আসল পদকর্তার লেখা বলে ভাবছে, তার মানে আমিও ওই লেভেলের লেখক, এই আনন্দে মশগুল হয়ে থাকতো। আর ততোধিক উৎসাহীরা সম্পূর্ণ পদাবলী লিখে তাতে নিজের নাম না দিয়ে বিখ্যাত পদকর্তার নামে চালিয়ে দিতো। যেমন, চণ্ডীদাস বিখ্যাত হলে আরও তিনজন নিজেদের লেখা পদ চণ্ডীদাসের নামে বাজারে ছেড়ে দেয়। তাতে তার নিজের নাম হচ্ছে না, কিন্তু তিনি যে চণ্ডীদাসের সমান মাপের লেখক এটা নিজের কাছে প্রমাণ করতে পেরে মনের সঙ্গোপনে খুশি হতেন। আজকাল সেই সব পদকর্তাদের ধরে বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস বলে দাগানো হয়েছে। সে যুগে বিখ্যাত লোকের লেখা সংখ্যায় এত কম এবং প্রচারে এত বেশি ছিল যে, তাদের লেখা টুকে নিজের বলে চালানো অসম্ভব ছিলো। তাই
এদেশে লুকিয়ে চুরিয়ে নিজের লেখা বিখ্যাত লোকের নামে চালানোর নাম ছিলো কুম্ভিলক-বৃত্তি আর বিদেশে লুকিয়ে চুরিয়ে বিখ্যাত লোকের লেখা নিজের নামে চালানোর নাম ছিলো প্লেজারিজ়ম। দুটো উল্টো ব্যাপার।
বিদেশি বদগুণ এখন আমরাও শিখেছি, তাই কুম্ভিলক বৃত্তি তার আসল মানে হারিয়ে এখন প্লেজারিজ়মই হয়ে গেছে।
ইউসুফ খান, কলকাতা, ২০২০ জুন ২৯
সূত্র: plagiarism কুম্ভিলক-বৃত্তি নয়, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ব্রত ব্রতী ব্রাত্য, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
সাপের হাঁচি, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
অসি ও মসি-র গল্প, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
না ঘরকা না ঘাটকা-র গল্প, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ঢাকাই বুলি: কলকাতার চিঠি, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
পদ্মাপারের পদবি, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ঈশ্বরচন্দ্র কেন শর্ম্মা, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ঘেটো লেটো নজরুল, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ঈশ্বরচন্দ্র কেন শর্ম্মা, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
বাঁকুড়া থেকে বগুড়া, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
বেশ্যারা প্রস্টিটিউট নয়, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ইত্যাদি প্রভৃতি প্রমুখ. ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
শুবাচ গ্রুপ এর লিংক: www.draminbd.com
All Links/2 শুবাচির পশ্ন থেকে উত্তর
বাংলা শব্দের পৌরাণিক উৎস, ড. মোহাম্মদ আমীন
মৌলবাদ ও মৌলবাদী শব্দের অর্থ কী জানতে চাই
বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পবিলেকশন্স লি.