অপরাধ দোষ ত্রুটি ও ভুল: পার্থক্য বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগ

ড. মোহাম্মদ আমীন

অপরাধ দোষ ত্রুটি ও ভুল: পার্থক্য বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগ

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, “বসে আছি পথ চেয়ে ফাগুনের গান গেয়ে/ যত ভাবি ভুলে যাব মন মানে না- –।” এই পঙ্‌ক্তিদ্বয়ে ‘ভুল’ শব্দের স্থলে কি অন্য শব্দ চলে? চলে না। নজরুল লিখেছেন, “ কেউ ভোলে না কেউ ভোলে, অতীত দিনের স্মৃতি—”। এই দুই ক্ষেত্রেই  নজরুল আর হেমন্ত- উভয়ের ‘ভুল’ অভিন্ন অর্থ বহন করে। কিন্তু , “ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি, ক্ষমিও সে অপরাধ।” নজরলের এই ভুলের অর্থ আগের দুই ভুলের মতো বিস্মৃতি নয়, দোষ, ভ্রান্তি প্রভৃতি। 

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অপরাধ, দোষ, ত্রুটি ও ভুল পরস্পর সমার্থক মনে হলেও, তা কদাচিৎ; প্রকৃতপক্ষে তারা, বিশেষ করে ‘অপরাধ’ ও বাকি তিনটি শব্দ  বিরল ক্ষেত্রে সমার্থক।  প্রত্যেকটির রয়েছে স্বকীয়তা, নিজস্ব অর্থ দ্যোতনা। দোষ ও ত্রুটি কখনও ভুল হতে পারে, না-ও হতে পারে; অপরাধের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। সৈয়দ আবদুল হাদী গেয়েছেন, “আমার দোষে দোষী আমি নিজের বিচার চাই, আমার ভুলের কোনো ক্ষমা নাই।”  এখানে ‘দোষে’ পদের অর্থ অপরাধে, ‘দোষী’ পদের অর্থ অপরাধী এবং ‘ভুলে’ পদের অর্থ বিস্মৃতি।

সংস্কৃত ‘অপরাধ’ শব্দের অর্থ গর্হিত কাজ, দোষ, ত্রুটি, পাপ, অধর্ম প্রভৃতি। বাক্যে শব্দটি সাধারণভাবে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরাধের সঙ্গে আইনগত বিষয় অধিক জড়িত। সাধারণত গর্হিত কাজ, পাপ, অধর্ম প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে ‘অপরাধ’ শব্দটি অধিক ব্যবহৃত হয়।  যেমন : “চৌর্যবৃত্তি একটি অপরাধ”। শব্দার্থ বিবেচনায় ‘অপরাধ’ শব্দটির একটি অর্থ ‘দোষ/ত্রুটি’ দেখা গেলেও পদার্থ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘দোষ’ ও ‘ত্রুটি’ প্রকাশে বাক্যে অপরাধ শব্দটি তেমন ব্যবহার হয় না। তবে মাঝে মাঝে অপরাধ শব্দটি ‘দোষ’ প্রকাশেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। নজরুল, কিন্তু সুন্দর প্রিয়তমার দিকে তাকানোকেও অপরাধ গণ্য হতে দেখেছেন : “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মার অপরাধ/ চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিনী বলে না তো কিছু চাঁদ”। নজরুলের এই গানে সাধারণভাবে ‘অপরাধ’ শব্দের অর্থে দোষ শব্দটিও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এখন মেয়েদের দিকে, বিশেষ করে সুন্দর মেয়েদের দিকে তাকানো দোষ নয়, তার চেয়ে মারাত্মক এবং সেটি হচ্ছে অপরাধ। এজন্য আপনি নারী উত্যক্ত করার অপরাধে দোষী হতে পারেন, মামলা হয়ে যেতে পারে ‘নারী নির্যাতন’ আইনে। 

সংস্কৃত ‘দোষ’ (বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত) শব্দের অর্থ অন্যায়, অপরাধ, অনৈতিক কাজ (দোষ করা), ত্রুটি, খুঁত (দোষ করা), কু-অভ্যাস (পানদোষ), ফের, কুপ্রভাব (গ্রহের দোষ), ক্ষতি, দ্বেষ, নিন্দা, পাপ, আয়ু (বায়ু পিত্ত কফ) ত্রিদোষ প্রভৃতি। যেমন : কী দোষ ছিল যে আমার, করছ আমায় তুমি পর–।দোষ যে করে সে দোষী। যেমন : দোষী করতে জানে বন্ধু খুশি করতে জানে না – – –। সংস্কৃত ‘ভ্রম’ থেকে উদ্ভূত ‘ভুল’ শব্দের অর্থ বিশেষ্যে ভ্রম, ভ্রান্তি, প্রমাদ (ভুলে ভরা), বিস্মৃতি (ভুলে যাওয়া), প্রলাপ (ভুল বকা); বিশেষণে শব্দটির অর্থ ভ্রান্ত, অসত্য (ভুল ধারণা) যথার্থ নয় এমন (ভুল ব্যাখ্যা)।  যেমন : “ওগো আবার নতুন করে ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না/হারানো স্বপন চোখে এঁকো না।” সংস্কৃত ‘ত্রুটি’ শব্দের অর্থ অপরাধ, দোষ (ত্রুটি মার্জনা, অভাব, ঘাটতি (চেষ্টার ত্রুটি নেই), ভ্রম, প্রমাদ (ত্রুটিবিচ্যুতি), ক্ষতি, হানি প্রভৃতি।এটিও বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন : আমার ত্রুটি ক্ষমা করুন।

শব্দার্থসমূহ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ‘দোষ’ শব্দের একটি অর্থ ত্রুটি/ ভুল ।  এ ছাড়া উভয় শব্দের অর্থে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এজন্য শব্দটি বিশেষ ক্ষেত্রে সমার্থক হলেও খুব কম ক্ষেত্রে সমপ্রায়োগিক। এই শব্দের প্রয়োগে আইনগত অপরাধ অধিক ব্যবহার করা অনুচিত। সাধারণত কোনো অন্যায়, অপরাধ,

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অনৈতিক কাজ, খারাপ অভ্যাস, পাপ প্রভৃতির ক্ষেত্রে দোষ শব্দটি অধিক ব্যবহৃত হয়। পদার্থে বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে : ১. তোমার এ দোষ (অপরাধ) ক্ষমা করা যায় না। ২. স্বজনপ্রীতি একটি বড়ো দোষ (অনৈতিক কাজ)। ৩. অতিরিক্ত মদ্যপান মারাত্মক দোষ (পানদোষ)। ৪. ত্রিদোষ (বায়ু পিত্ত কফ ) আয়ু কমিয়ে দেয়। ৫. গ্রহদোষ (কুপ্রভাব) সহজে ফেরানো যায় না। ৬. নরহত্যা মহা দোষ (পাপ)। ৭. কপালের ফের (দোষ), নইলে কী আর এমন হয়! ৮. নরহত্যা মহা দোষ (পাপ)। ৯. কোনো ভালো মানুষ পরের দোষ (নিন্দা) গায় না। ১০. ফণী এলো, ছাগলটা নিয়ে গেল আমার বড়ো দোষ (ক্ষতি) হয়ে গেল।

এসব বাক্যে ‘দোষ’ শব্দের স্থলে ‘ত্রুটি’ ব্যবহার করা হলে তা শোভন বা যথার্থ  হবে না; অধিকন্তু, বাক্যের অর্থও ভালোভাবে রক্ষিত হবে না। স্বজনপ্রীতি  একটি ‘দোষ’, ত্রুটি নয়। প্রতিদিন অফিসে দেরি করে আসা ‘ত্রুটি’ নয়, দোষ। কিছু কিছু দোষকে কখনও ত্রুটি বলা যায় না। যেমন : মুদ্রদোষ, বায়ুদোষ, স্বপ্নদোষ, স্বভাবদোষ,পানদোষ, চরিত্রদোষ প্রভৃতি। ‘ত্রুটি’ শব্দের একটি অর্থ অপরাধ হলেও সাধারণত ‘অপরাধ’ অর্থে ত্রুটি শব্দের ব্যবহার বিরল। সাধারণত মার্জনা, অভাব, ঘাটতি, ভ্রম, প্রমাদ, ক্ষতি, হানি প্রভৃতি অর্থে ত্রুটি শব্দটির অধিক ব্যবহার লক্ষণীয়। পদার্থে বিষয়টি দেখুন : ১১. শারীরিক ত্রুটি থাকলে সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়া যায় না। ১২. ত্রুটি (ভ্রম) হয়ে গেল, বানানটা দেখে নেওয়া উচিত ছিল। ১৩. শুদ্ধতা রক্ষায় চেষ্টার ত্রুটি (অভাব) ছিল না। ১৪. সর্বোচ্চ সতর্কতা সত্ত্বেও কিছু ত্রুটি (প্রমাদ, ত্রুটিবিচ্যুতি) রয়ে গেল। ১৫. অঙ্গত্রুটি( হানি) অপরাধ নয়।

এসব ক্ষেত্রে সাধারণত দোষ শব্দের চেয়ে ত্রুটি শব্দের ব্যবহার যৌক্তিক। আর একটি বাক্য দেখুন। ১৬. আমার ত্রুটি/দোষ মার্জনা করুন। এই বাক্যে ‘ত্রুটি’ ও ‘দোষ’ উভয় শব্দের ব্যবহার প্রথমদৃষ্টে যৌক্তিক মনে হলেও এই যোক্তিকতা নির্ভর করবে কাজের বা ঘটনার প্রকৃতির উপর। আইনগত অপরাধ সাধারণত ত্রুটি

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

হিসেবে গণ্য করা হয় না। আবার ঘাটতি বা অভাবজনিত ত্রুটিকে অপরাধ বলা সমীচীন নয়। ‘জন্মদোষ’ ও ‘জন্মত্রুটি’ বানানে অভিন্ন হলেও অর্থে ভিন্ন। প্রথমটি অপরাধজনক এবং দ্বিতীয় ঘাটতি বা খুঁতজনক।  ‘‘দোষ-ত্রুটি’ দেখিয়ে দেওয়া ভালো মানুষের কাজ নয় ” বাক্যে ‘ত্রুটিদোষ’ লিখলে কেমন হয়? ভালো হয় না। দোষ, ত্রুটির চেয়ে মারাত্মক। তাই সে জোর করে আগে থাকতে চায়। এজন্য দোষত্রুটি হয়, ত্রুটিদোষ হয় না।

অনেকে মনে করেন, ‘অপরাধ’ ‘দোষ’,‘ভুল ও ‘ত্রুটি সমার্থক। আসলে তা ঠিক নয়। যেমন : দোষ করতে জানে বন্ধু খুশি করতে জানে না।” এই বাক্যে দোষ শব্দের স্থলে ‘ত্রুটি’ চলবে না, অবশ্য ভুল চলবে। তারপরও তা যথার্থ হবে না। খুব সামান্য কিছু ক্ষেত্রে ‘ভুল’ ও ত্রুটি’ শব্দের অভিন্নার্থক প্রয়োগ করা যায়। যেমন :  মাতৃভাষায় বাক্যচয়নে এমন ভুল (ত্রুটি) ক্ষমার্হ নয়। অন্য সব ক্ষেত্রে শব্দদুটি প্রায় ভিন্নার্থক। যেমন : ১৭. ভুল হয়ে গেছে (ভ্রান্তি/ত্রুটি) ১৮. প্রশ্নপত্রে ভুলে ভরা (প্রমাদ) ১৯. কথাটি ভুলে (বিস্মৃতি) যেও না। ২০. মুমূর্ষু লোকটি ভুল (প্রলাপ) বকছে। ২১. এটি তোমার ভুল (অসত্য/ যথার্থ নয় এমন) ব্যখ্যা।

 ‘ভুল’ ও ‘ত্রুটি’ শব্দের মিলনে ‘ভুলত্রুটি’ শব্দ গঠিত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘ভুল’ ও ‘ত্রুটি’ সমার্থক নয়। যেমন : আমি তার নাম ভুলে গেছি, সার্থক বাক্য হলেও আমি তার নাম ‘ত্রুটে’ গেছি অর্থহীন। একই কাণ্ড ঘটবে নিচের পঙ্‌ক্তি দুটোয় ‘ভুলে’ পদের স্থলে দোষ বা ত্রুটি বা অপরাধ বসালে : “তোমাকে ভুলে যাওয়া হলো না আমার এই অপরাধ ক্ষমা করো/যত ভাবি ভুলে যাব, মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় বেশি আরো।” তারপরও একটি কথা থেকে যায়, ভুল; যতই করি না কেন, অপরাধ, দোষ, ত্রুটি বা ভুল কিছুই আমরা এড়াতে পারি না।

ভুল সবই ভুল এ জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সেই ভুল

ভুল সবই ভুল এই শ্রাবণে মোর ফাগুন যদি দেয় দেখা সে ভুল।” 

#subach

উৎস

  • কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
  •  ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
  • পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রমবিবর্তন, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

You cannot copy content of this page