স্ত্রীবাচক শব্দে পুরুষাধিপত্য

. মোহাম্মদ আমীন

স্ত্রীবাচক শব্দে পুরুষাধিপত্য

বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত তৎসম ‘আত্মোপজীবী’ শব্দের ব্যুৎপত্তি (আত্মন্‌+উপ+√জীব্‌+ইন)। এর অর্থ দৈহিক পরিশ্রম দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে এমন। অন্যদিকে, বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত তৎসম ‘আত্মোপজীবিনী’ শব্দের ব্যুৎপত্তি হচ্ছে (আত্মন্‌+উপ+√জীব্‌+ইন+ঈ)। শব্দটির অর্থ যৌনকর্মী। অভিন্ন ব্যুৎপত্তি, অভিন্ন গঠন, অভিন্ন বৈশিষ্ট্য। তারপরও শুধু স্ত্রীবাচক করে দিয়ে তৎকালীন বৈয়াকরণবৃন্দ একটি শব্দের অর্থকে নির্মম নীচতায় কদর্থে পরিণত করে দিয়েছে। আত্মোপজীবী শব্দটি লিঙ্গ পরিবর্তন করায় তাকে কামনার ঘৃণ্য লালসায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের আত্মকর্মকে কী হেয়ভাবে দেখা হতো শব্দটি তার একটি দৃষ্টান্ত। এরকম আরো অনেক শব্দ আছে। শব্দে পুরুষের এরূপ একপেশে আধিপত্য তাদের মানসিক দীনতার পরিচয় বহন করে।

পুরুষ-লিখিত শাস্ত্রমতে, ‘পুৎ’ নামক নরক থেকে উদ্ধার করে বলে ছেলে সন্তানকে পুত্র বলা হয়। এবার দেখা যাক, কন্যার ব্যুৎপত্তি কী? সে কাউকেই ত্রাণ বা

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

উদ্ধার করতে পারে না, বরং তার কাছ থেকে জন্মদাতা ত্রাণ চায়। আত্মোপজীবিনীর মতো কন্যা শব্দটিকেও কামনার রেশ দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মহাভারতে ব্যাসদেবের ব্যাখ্যা দেখলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে: সর্বান্ কাময়তে যস্মাৎ (৩.৩০৬.১৩)। এর অর্থ ‘কন্যা মানে ‘কাম্যা’। কন্ আর কম্ কুটুম্ব ধাতু। এখানে দেখা যায় কামনা।

‘ভগিনী’ শব্দটির অর্থ ভগাযুক্ত, অনেকে সরাসরি স্ত্রীচিহ্ন-ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করেন। আলংকারিক কবি দণ্ডী ‘ভগিনী’ শব্দকে জুগুপ্সাব্যাঞ্জক বলে অবিহিত করেছেন। তিনি সাহিত্যে শব্দটির ব্যবহার থেকে বিরত থাকার পরামর্শ বিধৃত করে বলেছেন – ভগিনী-ভগবত্যাদি গ্রাম্যকক্ষাং বিগাহতে। পুরুষের সমকক্ষ হয়েও কন্যা কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদের দাবিদার হবে তা ছিল কল্পনারও বাইরে। এ জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ, প্রেসিডেন্ট, চেয়ারম্যান, মন্ত্রী ইত্যাদি শব্দের স্ত্রীলিঙ্গের কথা ভাবাই হয়নি।

এবার স্ত্রী শব্দে চলে আসা যাক। ‘স্ত্রী’ শব্দে গর্ভধারণের বিষয়টাই ছিল মুখ্য। ‘স্তৈ’ ধাতুর মূলে, স্ত্যায়তে শুক্র শোণিতে য়ম্যাস্, যার অর্থ ‘শুক্রশোণিত যেখানে বা যাতে কাঠিন্য পায়’। স্ত্রীর একটি বহুল প্রচলিত প্রতিশব্দ ভার্যা। ‘ভার্যা’ নামটাই অবমাননাকর। বলা হয়েছে, “পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা”। অর্থাৎ স্ত্রী, পুত্র উৎপাদনের যন্ত্র। স্ত্ররি মতো অর্ধাঙ্গিনীর উপর যৌনতা আরোপিত হওয়ায় ‘ভার্যা’ যখন পুত্র উৎপাদনের যন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় তখন ভার্যার সন্তানদের মনে কি কষ্ট জাগে না? কত জঘন্য ছিল তৎকালীন সমাজপতি এবং শিক্ষিত জনরা।

অঙ্গনা, রমণী, কামিনী, ললনা, প্রমদা, যোযা, যোযিৎ, বনিতা এরূপ অসংখ্য নামেই নারীদের ডাকা হয়। কিন্তু কোনটায় ‘নারী’ হিসেবে নারীকে সম্মান এবং মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এটি নারীদের প্রতি প্রাচীন পুরুষ-শাসিত সমাজের নির্লজ্জ জুলুম ও চরম আধিপত্যবাদী মনোবৃত্তির পরিচায়ক। এখনও অনেকের মধ্যে এরূপ ঘৃণ্য আচরণ লক্ষণীয়।

‘অঙ্গনা’ শব্দে অঙ্গসৌষ্ঠবের আকর্ষণ লোলুপতাকে প্রকট করে তোলা হয়েছে। ‘রমণী’ শব্দটি যে রমণের ঈঙ্গিতবাহী তা সবার জানা। এ প্রসঙ্গে কবিকঙ্কণের একটি লাইন প্রাসঙ্গিক মনে হলো। তিনি বলেছেন, ‘রমণে রমণী মরে কোথাও না শুনি।’ ‘কামিনী’ শব্দ কম্ -ধাতুজ্। এর কামনারই ধন। শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অত্যন্ত কামুকী হিসেবে। কাশীরাম লিখেছেন, ‘কামিনী দেখিয়া কামে হইল বিভোর।’ ‘ললনা’ মানে বিলাসিনী। পুরুষকে যে নানাভাবে ছলাকলায় (লালয়িত পুমাংসম) লুব্ধ করে তাদের বলা হয়েছে ললনা। নারীর আর একটি প্রতিশব্দ ‘প্রমদা’। এই শব্দের ব্যাখ্যা বলা হয়েছে মাদকতার কথা। মাদক যেমন মত্ত করে দেয়, তেমনি প্রমাদারাও মত্ত করে দেয়। ‘যোযা’ ও যোযিৎ’ ললনার অর্থবাহী অর্থাৎ বিলাসিনী, পুরুষকে যে প্রলুব্ধ করে প্রভৃতি।

যে পুরুষ, স্ত্রীর একান্ত অনুগত, বউকে ভয় করে, শ্রদ্ধা বা সমীহ করে তাকে বলা হয় স্ত্রৈণ। শব্দটা সবসময় নেতিবাচক এবং নিকৃষ্টতা প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কোনো পুরুষ, স্ত্রীর অনুগত হলে সে আর পুরুষ আর উৎকৃষ্ট থাকে না; কাপুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে যায়। অতএব উৎকৃষ্ট পুরুষ কখনো স্ত্রৈণ হতে পারে না। সুতরাং উৎকৃষ্ট পুরুষ হতে হলে তাকে সবসময় তার স্ত্রীর অবাধ্য হতে হবে। যে নারী, স্বামীর একান্ত অনুগত এবং স্বামীকে ভয় করে, শ্রদ্ধা বা সমীহ করে করে তাকে বলা হয় পতিব্রতা। শব্দটি ইতিবাচক এবং উৎকৃষ্ট নারী প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ যে নারী স্বামীর একান্ত অনুগত সে উৎকৃষ্ট নারী এবং যে নারী স্বামীর অনুগত নয়, সে নারী নিকৃষ্ট নারী। অতএব অভিধানমতে, কোনো নারীকে উৎকৃষ্ট হতে হলে তাকে পতিব্রতা হতে হবে।তার স্বামীর সর্বাদেশ বিনাবাক্যে মেনে চলতে হবে।

স্ত্রৈণ যদি নেতিবাচক হয় তাহলে পতিব্রতা শব্দও নেতিবাচক হওয়াই ছিল সমীচীন। কিন্তু হয়নি, কারণ কর্তারাই এই কর্মটি করেছে। বস্তুত প্রাত্যহিক জীবনে নারীর ওপর নিজেদের আধিপত্য সৃষ্টির জন্য ধূর্ত পুরুষকর্তারা হীনম্মন্যতার সঙ্গে এমন নিকৃষ্ট-উৎকৃষ্ট অনেক অনেক শব্দ সৃষ্টি করে গেছেন। এই আলোচনা হতে বোঝা যায়, স্ত্রৈণ শব্দের লিঙ্গাত্বক বিপরীত শব্দ ‘পতিব্রতা’। প্রসঙ্গত, ‘স্ত্রীবশ্য’ এবং ‘স্বীয়া’ স্ত্রৈণ শব্দের দুটি সমার্থক শব্দ।

শুধু সংস্কৃত ভাষায় নয়, ইংরেজি ও ল্যাটিন ভাষাতেও নারীদের প্রতি এমন ন্যাক্কারজনক আচরণ করা হয়েছে। ল্যাটিন sator শব্দের সঙ্গে স্ত্রীর উচ্চারণ-সাম্য লক্ষণীয়। ল্যাটিন শব্দটির অর্থ begetter । অন্যদিকে, স্ত্রীবাচক ‘দার’ শব্দটির মূল অর্থ কৃষ্টভূমি। কর্ষণের জন্য নির্ধারিত ভূমি। নারীকে বলা হয়েছে ভূমিকল্পা, বীজ-বপনে সন্তান-শস্য উৎপাদিকা।

ইংরেজিতে , woman, mistress, madam প্রভৃতি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ইতিহাস নারী-পুরুষ সাম্য ও মর্যাদা বিবেচনায় শোভনীয় নয়। প্রকৃতপক্ষে woman শব্দটি এসেছে wifeman থেকে। যেখানে নারীর কোনো স্বতন্ত্র পরিচয় কিংবা আত্মবোধ বা মর্যাদা তুলে ধরা হয়নি। বরং পুরুষের লীলাসঙ্গী হিসেবে পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এখানেও নারীর পরিচয় কারো স্ত্রী হিসেবে। mistress শব্দের আদি অর্থ ছিল অবৈধ প্রেমিকা। শব্দটা বর্তমান গ্রহণযোগ্য অর্থে আসতে বেশ সময় নিয়েছে। madam (<ma dam = my lady) শব্দটি, আগে স্ত্রীলোকের প্রতি প্রণয় সম্বোধন প্রকাশে ব্যবহৃত হতো। চসার (Geoffrey Chaucer) এর সময়েও শব্দটির অর্থের অবনতি ঘটেনি। Restoration বা পুনরুদ্ধারকালীন ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শব্দটির অর্থের অবনতি ঘটে এবং অর্থ দাঁড়ায় বেশ্যাবাড়ির মালকিন। সাধারণভাবে যাকে আমরা মাসি বলে থাকে। এখন শব্দটির যথেষ্ট অর্থোৎকর্ষ ঘটেছে। বর্তমানে madam অসম্মানসূচক শব্দ নয়। অনেকে খ্যাতিমান মহিলাও শব্দটিকে মর্যাদাকর মনে করেন। তাই madam বর্তমানে সম্মানসূচক সম্বোধনে ব্যবহৃত একটি বহুল প্রচলিত মর্যাদাকর শব্দ।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা পূর্বকালে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে একটি জাতীয়তাবাদী শ্লোগান উঠেছিল- জিয়ে সিন্ধ। এটি উচ্চকিত হয়েছিল জয় বাংলার আগে। ঢাকায় তখন শ্লোগান উঠেছিল “বাঙালি – সিন্ধি ভাই ভাই!” বোনদের কথা ভাবা হয়নি। ধর্মীয় শিক্ষা অনুসারে আমরা বলি সকল মুসলমান ভাই ভাই। এখানেও বোনরা নেই।বাংলা ভাষায় একটি শব্দ আছে ‘পতিতা’। এর বিপরীত লিঙ্গে ‘পতিত’ হতে পারে। কিন্তু যে অর্থে আমরা ‘পতিতা’ ব্যবহার করি সেই অর্থে ‘পতিত’ ব্যবহার করি না। বেশ্যাবৃত্তি এখন আর কেবল দৈহিক অর্থেই ব্যবহার হয় না। কিন্তু তবু এর লিঙ্গান্তর হয় না।সাহস, শৌর্য, বীরত্ব এগুলোর লিঙ্গায়নও একচেটিয়া করা হয়েছে পুরুষের অনুকূলে। “সিংহ-পুরুষ আছে কিন্তু সিংহী নারী নেই।

প্রেসক্রিপশনে RX কেন লেখা হয়

#subach

Leave a Comment

You cannot copy content of this page


Casibom