ভাষা, ব্যাকরণ, ও ভাষার বিবিধ বিষয় নিয়ে ড. মোহাম্মদ আমীনের রচনার পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষার বাগ্বিধি; শব্দের বানান; শব্দের প্রয়োগ, অপপ্রয়োগ ও বাক্যে প্রয়োগ-সহ ভাষার নানান খুটিনাটি বিষয়ে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থের মান এবং সংখ্যার পরিমাণ যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য হলেও এ অবধি এ ভাষার লেখ্য রীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
আলোচ্য বিষয় ‘যতিচিহ্ন’ বা ‘বিরামচিহ্ন’ কিংবা ‘ছেদচিহ্ন’ বিষয়ে তাঁর আলাদা কোনো পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ছিল না। ‘ছিল না’ লিখবার কারণ এই— অতি সম্প্রতি পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. থেকে প্রকাশিত প্রায় দশ ফর্মায় রচিত ‘যতিচিহ্নের গতি-প্রকৃতি’ গ্রন্থটি তাঁর বহুমুখী রচনাজগতের এই অপূর্ণতাটিও ঘুচিয়ে দিয়েছে।
.
‘যতিচিহ্নের গতি-প্রকৃতি’ নামটির মধ্যেই বইটির বিষয়বস্তু স্পষ্টরূপে প্রতিফলিত— যতিচিহ্নের স্বভাব যেরকম, এবং এসব চিহ্ন যেভাবে বাক্যের গতি ও প্রকৃতিকে পরিচালিত করে। বাংলা ভাষার লেখ্য রূপের বয়স হাজার পেরোলেও এ ভাষায় রচিত গদ্য-পদ্যে যতিচিহ্নের ঠিক বিধিবদ্ধ প্রয়োগ পাওয়া যায় না। বাংলায় যতিচিহ্নের প্রয়োগ যতটা-না বিধিনির্ভর, তারচেয়ে অনেক বেশি নির্ভর লেখকের ইচ্ছে ও শৈলীর ওপর, এবং এ বইয়ের আলোচনা বিস্তৃত করবার পূর্বে ড. মোহাম্মদ আমীনও এই কথাটি স্বীকার করে নিয়েই তাঁর পরবর্তী পাঠ সাজিয়েছেন।
বাংলা ভাষায় কোন যতিচিহ্ন প্রথম কখন ব্যবহৃত হয়, কে ব্যবহার করেন, কোথায় ব্যবহার করেন, বাক্যে কীরূপ গতি দিতে ব্যবহার করেন, এখন কোথায় কীভাবে ব্যবহার করা উচিত—এসব প্রশ্নের জবাবের ভিতে রচিত ড. মোহাম্মদ আমীনের ‘যতিচিহ্নের গতি-প্রকৃতি’ গ্রন্থটি বাংলা যতিচিহ্নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং প্রয়োগবিধির এক চমৎকার সমন্বয়। ইংরেজি ‘punctuation mark’ পদবন্ধের পরিভাষা হিসেবে ‘যতিচিহ্ন’ শব্দটি ঠিক কী অর্থ ধারণ করে, পরিভাষাটির সংজ্ঞার্থ, এবং বাংলা ভাষার প্রয়োগে যতিচিহ্নের ইতিহাস দিয়ে শুরু করা এই গ্রন্থের মূল নিবন্ধগুলোর শৈলী বিশ্লেষণ করলে অধিকাংশ নিবন্ধের ক্ষেত্রে তিনটি করে ভাগ বা পর্ব লক্ষণীয়। বাংলা লেখ্য রূপকে সরল, সংক্ষিপ্ত ও দ্ব্যর্থতাহীন করতে কিংবা বিশেষিত ও দ্ব্যর্থক বানাতে ব্যবহৃত সকল চিহ্নের একটি মোটামুটি তালিকা নিরূপণের চেষ্টা করে পরবর্তী পরিচ্ছেদসমূহে সেসবের বর্ণনায় লেখক প্রথমভাগে আলোচ্য যতিচিহ্নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস উল্লেখ করে দ্বিতীয়ভাগে চিরায়ত বাংলা সাহিত্য থেকে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।
.
শেষ ভাগে গিয়ে অনুসরণীয় প্রয়োগবিধি উল্লেখ করে যথাসম্ভব প্রয়োগোদাহরণ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যতিচিহ্নের প্রয়োগ-প্রয়োজনীয়তার আলোচনা তো আছেই। শেষের কাজ দুটি মোটামুটি সহজ হলেও প্রথম দুটি কাজ সহজ মোটেও নয়। এমনটি করতে গিয়ে লেখককে হাতড়ে বেড়াতে হয়েছে বাংলা সাহিত্যে চিরায়ত আধুনিক রূপের সম্ভার থেকে শুরু করে প্রাচীনতম লিখিত রূপের আধার ‘চর্যাপদ’ অবধি। সমুদ্র সেচে মুক্তো খুঁজে আনার মতো অত্যন্ত ধৈর্য ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উলটে বের করে আনতে হয়েছে এসব মূল্যবান টুকরো তথ্য। পরে সুতোয় মুক্তো গেঁথে মালা বানানোর মতোই বিধিবদ্ধ নিয়মের সঙ্গে সেসব টুকরো তথ্যের সমন্বয়ে রচেছেন এই চমৎকার গ্রন্থখানি, যা শিক্ষানবিশ পাঠককে শেখাবে— থামার জন্যে থামা নয়, থামার প্রয়োজনে থামা উচিত, এবং তা যখন যখন উচিত— যে-কথা তিনি এ গ্রন্থের উৎসর্গসূচনেই আউড়েছেন। বোদ্ধা পাঠকের যথাযথ মূল্যায়নই লেখকের এ পরিশ্রম সার্থক প্রমাণ করতে পারে।
আলোচ্য গ্রন্থ: যতিচিহ্নের গতি-প্রকৃতি
লেখক: ড. মোহাম্মদ আমীন
প্রকাশনী: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
মূল্য: ৩৫০ টাকা।