শহিদ শহীদ ও শহিদ মিনার বনাম শহীদ মিনার
ড. মোহাম্মদ আমীন
শহিদ শব্দের অর্থ
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘শহিদ’ শব্দের তিনটি অর্থ দেওয়া আছে। যথা: (১) ন্যায়সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রাণ উৎসর্গকারী ব্যক্তি (ভাষা শহিদ), (২) দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী যোদ্ধা এবং (৩) সত্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে নিহত। অতএব এই অভিধানমতে, ‘শহিদ’ শব্দটি বা এর অর্থ কেবল কোনো ধর্মীয় বিষয় কিংবা ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে জড়িত নয়। বিষয়বস্তু যাই হোক না, ‘শহিদ’ শব্দটির কার্যকরণ, অর্থ নির্দেশনা এবং প্রয়োগ কেবল ন্যায়সংগত অধিকার আর সত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে প্রদত্ত অর্থ হতে বলা যায়— জাতি-ধর্ম, নারী-পুরুষ এবং বর্ণনির্বিশেষে আইনসংগত অধিকার ও সত্য প্রতিষ্ঠায় প্রাণ উৎসর্গকারী সবাই ‘শহিদ’। অবশ্য, ন্যায়সংগত অধিকার এবং সত্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টি পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটা বিষয়ের মতো অনেকটা আপেক্ষিক। সেটি অন্য কথা এবং এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। ‘শহিদ’ বিদেশি (অতৎসম) শব্দ। তাই বানানে ঈ-কার পরিহার্য।
শহিদ মিনার
শহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নির্মিত মিনার বা শহিদগণের নিমিত্ত মিনার বা শহিদবৃন্দের স্মরণে মিনার— প্রভৃতি অর্থ প্রকাশের জন্য ‘শহিদমিনার’ বা ‘শহিদ মিনার’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। অনেকে বলেন— সমাসবদ্ধ শব্দে ফাঁক রাখা যায় না। তাই ‘শহিদ মিনার’ কথাটি শুদ্ধ নয়। শুদ্ধ হবে ‘শহিদমিনার’ বা ‘শহিদ–মিনার’। তাই তারা মনে করেন ‘শহিদ মিনার’ অশুদ্ধ। আসলে কি অশুদ্ধ? না, ‘শহিদ মিনার’ কথাটি অশুদ্ধ নয়, বরং ব্যাকরণগতভাবে সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও প্রমিত। এবার দেখা যাক তার কারণ: সমাসবদ্ধ পদ একসঙ্গে লিখতে হয়, এটি সত্য— তবে সবসময় নয়? কখন? “উচ্চারণ, অর্থদ্যোতকতা ও শ্রুতিমাধুর্য বিবেচনায় যখন সুবিধা মনে হয়, তখন। নতুবা, ফাঁক রেখে লেখাই বিধেয়, এটিই বাংলার বৈশিষ্ট্য।” বাংলা ব্যাকরণে অসংলগ্ন সমাস বলে একটি কথা আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “সমাসবদ্ধ পদ অসংলগ্নভাবেও লেখা যায়। অসংলগ্নভাবে লেখা হলেও তা সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে গণ্য হয়।” বাংলায় সমাসের প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে ইচ্ছা-নির্ভর বিষয়। ‘জয় বাংলা’ কথাটিকে অভিধান যতই সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে ‘জয়বাংলা’ বলুক না কেন—, ‘জয় বাংলা’ লিখলে ব্যাকরণগতভাবে কিংবা অর্থ ও শ্রুতিমাধুর্য প্রকাশে কোনো বিঘ্ন হয় না, বরং শ্রতিমাধুর্য বৃদ্ধি পায়। ‘বিজয়দিবস’ আর ‘বিজয় দিবস’, উভয় ধারাই শুদ্ধ ও ব্যাকরণসম্মত। প্রথমটি— ‘সংলগ্ন সমাস’ এবং দ্বিতীয়টি ‘অসংলগ্ন সমাস’। তেমনি শুদ্ধ- নিখিল বাংলা চিরন্তন আকালি যুব সংহতি সমিতি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম সমিতি প্রভৃতি। সুতরাং, ‘শহিদ মিনার’ ও ‘শহিদমিনার’ দুটোই শুদ্ধ, প্রমিত এবং ব্যাকরণসম্মত। অধিকন্তু, প্রচলন ও জনপ্রিয়তার দিকে এগিয়ে আছে ‘শহিদ মিনার’। অতএব, নির্দ্বিধচিত্তে লিখুন— ‘শহিদ মিনার’। যেহেতু, শহিদ ও মিনার উভয় অতৎসম শব্দ। তাই বানানে ঈ-কার পরিহার্য।
উৎস: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।