মুরগির দুধ ও গোরুর ডিম, তেত্রিশ কোটি দেবতা, বাংলো, ডাকবাংলো ডাকবাংলা, নকিব, মৃধা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেননি

মুরগির দুধ ও গোরুর ডিম, তেত্রিশ কোটি দেবতা, বাংলো, ডাকবাংলো ডাকবাংলা, নকিব, মৃধা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেননি
ড. মোহাম্মদ আমীন

মুরগির দুধ ও গোরুর ডিম

“এখানে মুরগি ও গোরুর দুধ পাওয়া যায়।” অনেকে বলেন, বাক্যটি অশুদ্ধ, কারণ মুরগি দুধ দেয় না। মুরগির দুধের সঙ্গে বাক্যটির সম্পর্ক কী, তা আমার জানা নেই। বাক্যটিতে তো বলা হয়নি, “এখানে মুরগির দুধ ও গোরুর দুধ পাওয়া যায়।” “এখানে মুরগি ও গোরুর দুধ পাওয়া যায়।”- বাক্যটির সাধারণ অংশগুলো বাক্যের পৃথক বিশেষ্য থেকে আলাদা করে নিলে বাক্যটি হয় : এখানে [(মুরগি) ও (গোরুর দুধ)] পাওয়া যায়। বাক্যটির অর্থ :
(১) এখানে মুরগি পাওয়া যায়। (ও)
(২) এখানে গোরুর দুধ পাওয়া যায়। অর্থাৎ,
(৩) এখানে মুরগি ও গোরুর দুধ পাওয়া যায়।
মুরগি ও গোরুর দুধ– দুটি ভিন্ন বিশেষ্য। বাক্যের বাকি সাধারণ পদ বিবেচনায় এ দুটি বিশেষ্যকে ‘ও’ দ্বারা যুক্ত করে ৩ নম্বর বাক্য গঠন করা হয়েছে। অতএব, বাক্যটি অশুদ্ধ নয়। যেমন অশুদ্ধ নয়, ‘এখানে ছাগল ও ঘাস পাওয়া যায়’। অশুদ্ধ হতো যদি, বাক্যের গঠন বিবেচনায় বিশেষ্যের অনুগত অন্য কোনো সংশ্লিষ্ট সাধারণ পদ না-থাকত। তবে, চতুষ্পদ কিংবা গো-দেবতা বিবেচনায় গোরুকে আগে লেখার কোনো গো-বিধান যদি থেকে থাকে, তাহলে অন্য কথা। নতুবা, মুরুগি ও গোরুর দুধ কিংবা ‘গোরুর দুধ ও মুরগি’ আগে-পিছে লেখায় কোনো পার্থক্য নেই।
আর একটি বাক্য দেখুন : (৪) শ্রীকৃষ্ণ গোরু ও ছাগল চরাতেন। এ বাক্যটির সাধারণ অংশ কেবল ‘শ্রীকৃষ্ণ’। নামটিকে অনুগত পদ থেকে আলাদা করে নিলে পাওয়া যায় :
শ্রীকৃষ্ণ [( গোরু) ও (ছাগল চরাতেন)]। এক্ষেত্রে সাধারণ অংশের পরিপ্রেক্ষিতে বাক্যটির অর্থ হয়:
(৫) শ্রীকৃষ্ণ গোরু।
(৬) শ্রীকৃষ্ণ ছাগল চড়াতেন।
আসলে কি শ্রীকৃষ্ণ গোরু? না। তিনি আসলে, গোরু চরাতেন এবং ছাগল চরাতেন। মানে গোরু ও -ছাগল চড়াতেন।
অবশ্য, বাংলা বাক্য গঠনে এসব বিষয় বিবেচনা করা হয় না। নইলে শ্রীকৃষ্ণ গোরু ও ছাগল চরাতেন বাক্যের অর্থ অন্য রকম ধরা হতো। এ বাক্যের সঙ্গে ‘এখানে মুরগি ও গোরুর দুধ পাওয়া যায়’ বাক্য গুলিয়ে ফেলা সমীচীন হবে না। কিন্তু এখন যে যুগ পড়েছে, ‘এখানে মুরগির দুধ ও গোরুর ডিম পাওয়া যায়’ লিখলেও অবিশ্বাস্য মনে হয় না। বিজ্ঞান কী না-পারে?

তেত্রিশ কোটি দেবতা

‘তেত্রিশ কোটি দেবতা’ কথায় বর্ণিত ‘কোটি’ অর্থ ১০০ লাখ নয়। এই ‘কোটি’ শব্দের অর্থ হলো প্রকার, শ্রেণি, বিভাজন। ‘কটি’ হলো সংস্কৃত প্রকার বা শ্রেণি অর্থদ্যোতক ‘কটি’ শব্দের একাধিক অর্থের একটি অর্থ; বিকৃত/বঙ্গীকৃত রূপ। অর্থাৎ ‘তেত্রিশ কোটি দেবতা’ কথায় বর্ণিত কোটি= কটি; যার অর্থ প্রকার বা শ্রেণি। সুতরাং, ‘তেত্রিশ (৩৩) কোটি দেবতা’ অর্থ ৩৩ শ্রেণির দেবতা, ৩৩ প্রকার দেবতা, ৩৩ প্রকৃতির প্রাকৃতিক শক্তি। ‘দেব/দেবী’ অর্থ প্রাকৃতিক শক্তি। তেত্রিশ কোটি দেবতা অর্থ ৩৩ প্রকার প্রাকৃতিক শক্তি। হিন্দুশাস্ত্রে প্রাকৃতিক সমুদয় শক্তিকে ৩৩টি ভিন্ন ভাগে (কটি/কোটি) বিভক্ত করে দেখানো হয়েছে। ‘বেদ’ গ্রন্থে যে ৩৩ কোটি/৩৩ কটি/৩৩ প্রকার দেবতার কথা বলা হয়েছে, তা হলো ৩৩ প্রকার প্রাকৃতিক শক্তি; যা দেব/দেবী রূপে পরিচিহ্নিত। এই ৩৩ প্রকার দেবতা হলেন: অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য; এক ইন্দ্র, এক প্রজাপতি। আবার অনেক বর্ণনায় ইন্দ্র ও প্রজাপতির স্থলে দুই অশ্বিনীকুমার উল্লেখ আছে। এই তেত্রিশ প্রকার দেবতা কে কে”  ” অষ্টৌ বসব একাদশ রুদ্রা দ্বাদশদিত্যাস্ত একত্রিংশদিন্দ্রশ্চৈব প্রজাপতিশ্চ ত্রয়ত্রিংশা চিতি” [বৃহ০ উপ০ ৩।৯।২] অর্থাৎ অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য এই কয় জন মিলে একত্রিশ এবং ইন্দ্র ও প্রজাপতি মিলে তেত্রিশ দেব।
★ অষ্ট বসুঃ [অগ্নিশ্চ পৃথিবীশ্চ বায়শ্চান্তিরিক্ষং চাদিত্যশ্চ দ্যৌশ্চ চন্দ্রমাশ্চ নক্ষত্রাণি চৈত্রে বসব ; বৃহ০ উপ০ ৩।৯।৩। ] অর্থাৎ অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য, দ্যুলোক, চন্দ্র, নক্ষত্রপুঞ্জ এই অষ্ট বসু। কারণ মহাবিশ্বের সকল পদার্থ এদের মধ্যেই নিহিত আছে। সেই জন্য এদের নাম বসু।
★ একাদশ রুদ্রঃ [দশমে পুরুষো প্রাণা আত্মৈকাদশন্তে ; বৃহ০ উপ০ ৩।৯।৪] অর্থাৎ পঞ্চ প্রাণ এবং পঞ্চ উপপ্রাণ এই দশ এবং জীবাত্মা মিলে একাদশ রুদ্র। এই এগারো দেহান্তকালে রোদন করায়, বলে এদের রুদ্র বলা হয়। এগুলো হচ্ছে – পঞ্চ প্রাণঃ প্রাণ, উদান, সমান, ব্যান, অপান। উপ প্রাণঃ নাগ, কুর্ম, কৃকল, দেব, ধনঞ্জয় এবং জীবাত্মা।
★ দ্বাদশ আদিত্যঃ [দ্বাদশ বৈ মাসা ; বৃহঃ উপঃ ৩।৯।৬] সম্বৎসরে যে বারো মাস আছে, তারাই আদিত্য। কারণ এই সমস্তকে আদান করে যান। যেহেতু এই সমস্তকে আদান করে যান, অতএব তারা আদিত্য। দ্বাদশ আদিত্য হচ্ছে – চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবন, ভাদ্রপদ, আশ্বিন, কার্তিক, মার্গশীর্ষ, পৌষ, মাঘ এবং ফাল্গুন।
★ ইন্দ্রঃ [স্তনযিত্নুরেবেন্দ্রো ; বৃহ০ উপ০ ৬।১।৬] অর্থাৎ বিদ্যুৎ হচ্ছে ইন্দ্র । কারণ তা ঐশ্বর্যের সাধন। বিদ্যুৎ হতে গতি শক্তি, প্রকাশ, সমৃদ্ধি এবং সুখের সাধন প্রাপ্তি হয়।
★ প্রজাপতিঃ [যজ্ঞঃ প্রজাপতিরিতি ; বৃহ০ উপ০ ৬।১।৬] যজ্ঞ হচ্ছে প্রজাপতি। কারণ এর দ্বারা বর্ষা হয়, প্রাণিদের সুখ মেলে। গীতা ৩।১৪ মধ্যে বলা হয়েছে – প্রাণী অন্ন থেকে, অন্ন বৃষ্টি থেকে এবং বৃষ্টি যজ্ঞ দ্বারা উৎপন্ন হয়। এই প্রকারে যজ্ঞ প্রাণীদের জীবন ও সুখের আধার।

বাংলো নামের উদ্ভব; ডাকবাংলো ডাকবাংলা 

`বাংলো’ শব্দটি ইংলিশ অভিধানে ‘bungalow’ বানানেভুক্ত একটি কৃতঋণ শব্দ। তবে ইংলিশ অভিধানে ভুক্ত বাংলো (bungalow) শব্দটির উৎস দেখানো হয়েছে হিন্দি। হয়তো ইংরেজগণ হিন্দি হতে শব্দটি পেয়েছে বা নিয়েছে। ইংলিশ অভিধানে শব্দটির উৎস যাই দেখানো হোক না, ‘বাংলা’ হতে ‘বাংলো’ শব্দের উদ্ভব। সুতরাং, হিন্দি ‘বাংলোর’ উৎসও বাংলা। ‘বাংলো’ অর্থ বাংলার বা বাংলার অন্তর্গত, বাংলার অন্তর্গত কুটির। বাংলোগুলো ছিল মূলত এই অঞ্চলে কর্মরত ইউরোপীয় অফিসার বা আগত ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের জন্য নির্মিত কুটির (cottage)। ‘বাংলো’ নামের কুটিরে ইংরেজরা বাস করত বা সাময়িক অবস্থান করত। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি তাদের মূল বাড়ির অদূরে ইংরেজ বা ক্ষমতাবান বা জমিদার শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের ভ্রমণ/পরিদর্শনকালীন সাময়িক অবস্থানের জন্য এমন কুটির নির্মাণ করত।
ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ অফিসারেরা কোনো থানা বা প্রশাসনিক এলাকা পরিদর্শনে গেলে যে কুটিরে অবস্থান করত তাকে ‘ডাকবাংলো’ বলা হতো। এজন্য ‘বাংলো’ নামের কুটিরগুলো ছিল প্রভাব, ক্ষমতা, মর্যাদা আর আভিজাত্যের প্রতীক। তাই দেশিরাও মূল বাড়ির বাইরে কোনো উদ্দেশ্যে কোনো বাড়ি তৈরি করলে, তাতে ইংরেজরা বাস করুক বা না করুক; বাংলো বলতে তৃপ্তি পেত। ‘বাংলো’ শব্দটি কুটিরবিশেষ অর্থে ‘বাংলাঘর’ নামেও পরিচিত। অনুরূপভাবে ‘ডাকবাংলো’ শব্দটি ‘ডাকবাংলা’ নামেও পরিচিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেননি

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সাক্ষাৎকার বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জলিল সাহেবের প্রশ্ন: বলো তো, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখন মৃত্যুবরণ করেছেন?
মেধাবী প্রার্থী রহমত বললেন, রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ করেননি। বিশ্বকবির ওপর এমন বিদঘুটে দোষারোপ উচিত নয়। তিনি বাঁচার জন্য কত চেষ্টা-তদ্‌বির করেছেন, কত চিকিৎসা করিয়েছেন— তা আমরা সবাই জানি।তাঁর মতো লোক অযথা কেন আত্মহত্যা করতে যাবেন?
জলিল সাহেব বললেন, ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেছেন। সামান্য একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছ না। তুমি তো লেখাপড়া কিছুই জান না। তো, পরীক্ষায় এত ভালো ফল করলে কীভাবে?
রহমত বললেন: স্যার, পরীক্ষায় আমি জ্ঞানের কিছু লিখিনি, যা লিখলে পরীক্ষক ভালো নাম্বার দেবেন কেবল তাই লিখেছি। ইতিহাস বলছে— রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ করেননি। তিনি নিজেও মৃত্যবরণের কথা কখনো স্বীকার করেননি।অযথা তাঁর বদনাম করা হচ্ছে।
জলিল সাহেব বললেন: রবীন্দ্রনাথ কি এখনো জীবিত আছেন? কী আবোল-তাবোল বলছ? তুমি কী রহমত পাগল হয়ে গেছ?
রহমত: স্যার, ‘বরণ’ শব্দের অর্থ কী?
জলিল সাহেব অভিধান খুলে বললেন,‘বরণ’ শব্দের অর্থ দেখা যাচ্ছে— সাদরে গ্রহণ, সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা, মান্য ব্যক্তিকে অভ্যর্থনা (জামাইবরণ), স্বেচ্ছায় স্বীকার বা ভোগ (কারাবরণ), প্রার্থনা, মনোনয়ন, নির্বাচন প্রভৃতি।
রহমত: স্যার, ‘বরণ’ শব্দের অর্থরাজির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকে ‘বরণ’ বলার মতো কিছু কি আছে?
হতাশ গলায় জলিল সাহেব বললেন, এমন কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না।
রহমত: রবীন্দ্রনাথ কি মৃত্যুকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন— যেমন তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন, নোবেল পুরস্কার এবং নাইট উপাধি? তিনি কি মৃত্যুকে এমনভাবে বরণ করেছিলেন— যেমনি তাঁকে বরণ করা হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সভায় – – -?

                           

    নকিব ও মৃধা 

‘নকিব’ আরবি উৎসের শব্দ। অর্থ (বিশেষ্যে) ১. ঘোষক। ২. প্রভু বা আগন্তুকের পরিচয়দাতা। ৩. পেয়াদা; সংবাদদাতা। রাজার এবং আগন্তুকের পরিচয় ইত্যাদি যে ঘোষণা করে তাকে নকিব বলে।
‘মৃধ’ থেকে ‘মৃধা’। তৎসম ‘মৃধ [মৃ+ধ (ধক্‌)-ধি]’ অর্থ ১. যুদ্ধ, সমর। ২. যা শোণিতার্দ্র হয়। ৩. যাতে মরে। ৪. হত বা আহত হবার কারণে যা শোণিতলিপ্ত হয়। সে হিসেবে ‘মৃধা’ কথার শাব্দিক অর্থ যোদ্ধা। তবে অভিধানমতে, ‘মৃধা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ লাঠিয়াল, দশজন গদাধারী পদাতিক সৈন্যের প্রধান, জমিদারি আমলে পাইক বা লাঠিয়ালের কিয়দংশের সর্দার; বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের পদবিবিশেষ। যারা লাঠিয়ালের দায়িত্ব পালন করত, নিয়োগকর্তার পক্ষে যুদ্ধ করত তাদেরও ‘মৃধা’ বলা হতো। শব্দটি উত্তর পুরুষগণও পদবি হিসেবে ব্যবহার করত। স্মর্তব্য, তখন পূর্বপুরুষের বা নিজের পেশা বা পদবি নামের সঙ্গে যোগ করার রেওয়াজ ছিল। এই হিসেবে এটি বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের একটি পদবি হয়ে যায়। যেমন: জিয়াউল হক মৃধা, দেবাশীষ মৃধা।

You cannot copy content of this page


CasibomCasibom