হুঁকা হুঁকো, হুঁকাবরদার, হুঁকারি, ধর্মনিরপেক্ষতা, নায়ের বাদাম, যতি বনাম ছেদ, বাজুবন্ধ, দুঃখ বনাম দুখ, গীতিকার বনাম গায়ক
ড. মোহাম্মদ আমীন
হুঁকা হুঁকো হুঁকাবরদার হুঁকারি
হুঁকা আরবি উৎসের শব্দ। অর্থ (বিশেষ্যে) কলকেয় রাখা জ্বলন্ত তামাকের ধোঁয়া (ধাতবপাত্রের সঞ্চিত জলের মধ্যে দিয়ে শোধিত) সেবনের জন্য ব্যবহৃত দীর্ঘ নলযুক্ত সরঞ্জাম, আলবোলা, ফরসি। ২. নারকেলের খোলে সঞ্চিত জলে শোধিত করে কলকেয় রাখা তামাকের ধোঁয়া সেবনের সরঞ্জামবিশেষ, ডাবা। মুগল যুগে এদেশে ব্যবসারত ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয়রা হুঁকাকে বলত ‘হাবল-বাবল’ (hubble-bubble)। ধূমপানের সময় হুঁকা থেকে বুদ্বুদ শব্দে ধোঁয়া নির্গত হতো বলে এমন নামকরণ করা হয়। ‘হুঁকো’ হলো ‘হুঁকা’-র কথ্য রূপ।
হুঁকাবরদার: আরবি উৎসের ‘হুঁকা’ ও ফারসি উৎসের ‘বরদার’ মিলে হুঁকাবরদার। হুঁকার রক্ষণাবেক্ষণ এবং তামাক পরিবেশণের দায়িত্বে নিয়োজিত বেতনভুক কর্মী। হুঁকাবরদারের কাজ ছিল প্রভুর ধূমপানের ছিলিমকে সবসময় জ্বালিয়ে রাখা। এদেশীয় রাজন্যবর্গ ও অভিজাতদের অনুকরণে ইউরোপীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও ধূমপানের জন্য হুঁকা ব্যবহার করত। হুঁকাবরদারের এতই গুরুত্ব ছিল যে, বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস একসময় এরকম নির্দেশ দেন যে, তাঁর ভোজসভায় আমন্ত্রিত অতিথিরা যেন হুঁকাবরদার ব্যতীত অন্য কোনো ভৃত্য সঙ্গে না-আনেন।
হুঁকারি: হুঁকারি আরবি উৎসের শব্দ। অর্থ (বিশেষণে) হুঁকায় আসক্ত, তামাকখোর।
ধর্মনিরপেক্ষতা
ধর্মনিরপেক্ষতা: অভিধানমতে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় পক্ষপাতহীনতার নীতিকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে। তৎসম ধর্মনিরপেক্ষতা (ধর্ম+নিরপেক্ষ+তা) শব্দটি বাক্যে সাধারণত বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ধর্মনিরপেক্ষ: তৎসম ধর্মনিরপেক্ষ (ধর্ম+নিরপেক্ষ) অর্থ বিশেষণে (যে রাষ্ট্রের নীতি) ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় এমন; ধর্মীয় বিষয়ে পক্ষপাতহীন।
নিরপেক্ষ: তৎসম নিরপেক্ষ (নির্+অপেক্ষা) অর্থ বিশেষণে পক্ষপাতদুষ্ট নয় এমন (নিরপেক্ষ বিচার, নিরপেক্ষ তদন্ত); স্বতন্ত্র (দলনিরপেক্ষ ); উদাসীন (বিষয়নিরপেক্ষ); শর্তাধীন নয় এমন (নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত)।
নায়ের বাদাম
“নায়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাও চইলা”—গানটিতে বর্ণিত ‘বাদাম’ শব্দের অর্থ কী? গানটিতে বর্ণিত ‘বাদাম’ শব্দের অর্থ পাল। ‘নায়ের বাদাম’ অর্থ নৌকার পাল। বাতাসের সাহায্যে চালানোর জন্য নৌকার মাস্তুলে টাঙানো বস্ত্রকে এককথায় ‘বাদাম’ বলে। যার সমার্থক পাল (নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে জসীমউদ্দীন)। ‘বাদাম’ ফারসি উৎসের শব্দ। উচ্চারণ /বাদাম্/। “নায়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাও চইলা”— গানটির রচয়িতা ছড়াকার রফিকুল হক (৮ই জানুয়ারি ১৯৩৭— ১০ই অক্টোবর ২০২১)। তিনি দাদুভাই নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকায় ‘চাঁদের হাট’ নামের শিশুদের পাতা সম্পাদনা করতেন। সেই সুবাদে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠান ‘চাঁদের হাট’ প্রতিষ্ঠা করেন। অভিধানে আরেকটি ‘বাদাম’ আছে। এটি শস্যবীজ। মাটির নিচে জাত দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের কঠিন কোলসাবৃত (তেল প্রোটিন ও ভিটামিন বি এবং ই সমৃদ্ধ) শক্ত বীজবিশেষ; ইংরেজিতে যাকে বলা হয় nut। এই বাদাম’-এর উৎসও ফারসি।
যতি বনাম ছেদ
অভিধানে ‘যতি’ শব্দের তিনটি পৃথক ভুক্তি রয়েছে। সবকটি ‘যতি’-র উচ্চারণ ‘জোতি’। তবে অর্থ ও প্রয়োগ ভিন্ন। যেমন:
- তৎসম ‘যতি (√যত্+ই)’ অর্থ (বিশেষ্যে) ১. যিনি তপস্যা করেন, সন্ন্যাসী। ২. ভিক্ষু। ৩. পরিব্রাজক।
- তৎসম ‘যতি (√যম্+তি)’ অর্থ (বিশেষ্যে) যে নারীর স্বামী প্রয়াত, বিধবা (যতি হওয়ার পর নীলিমার দুঃখের গতি বেড়ে গেছে)।
- তৎসম ‘যতি (√যম্+তি)’ অর্থ (বিশেষ্যে) যেসব চিহ্ন লিখিত পাঠের অর্থ স্পষ্ট করে বা কোনো বাক্যের উপাদানসমূহের বিরতি ও সুরের ওঠানামা নির্দেশ করে, রচনার মধ্যকার দাঁড়ি কমা সেমিকোলোন প্রভৃতি বিরামচিহ্ন (বাক্যে ঠিকমতো যতি না দিলে অর্থবিভ্রাট হতে পারে)।
ছেদ: তৎসম ‘ছেদ (√ছেদ্+অ)’ অর্থ (বিশেষ্যে) ১. কর্তন, ছেদন (মুণ্ডচ্ছেদ)। ২. বিরাম (বৃষ্টির ছেদ)। ৩. ভাগ, অধ্যায় (পরিচ্ছেদ)। ৪. যতিচিহ্ন (পূর্ণচ্ছেদ)।
বাক্য বা রচনার মধ্যে ব্যবহৃত বিরামচিহ্ন অর্থে যদি ও ছেদ সমার্থক।
বাজুবন্ধ
কাজী নজরুল লিখেছেন, বেহুঁশ হো কর্ গির্ পড়ি হাথ মে বাজুবন্ধ মে বস্ গয়ি।” জানতে চাই ‘বাজুবন্ধ’ অর্থ কী? অধ্যাপক পি. আচার্যের ‘শব্দসন্ধান: শব্দাভিধান’ বলছে, বাজুবন্ধ হলো ‘তাগাজাতীয় স্ত্রীলোকের বাহুতে পরিহিত অলংকার। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাজুবন্ধ অর্থ (বিশেষ্যে) বাহুর অলংকার, হাতের ওপরের অংশে পরিহিত অলংকার। বাজুবন্ধ ফারসি উৎসের শব্দ। উচ্চারণ /বাজুবন্ধ্/।
দুঃখ বনাম দুখ
‘দুঃখ’ না ‘দুখ’ কোনটি সঠিক? ‘দুঃখ’ ও ‘দুখ’ উভয় ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ
- দুঃখ: ‘দুঃখ (দুঃ+√খন্+অ)’ তৎসম শব্দ। উচ্চারণ /দুক্খো/।
‘‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ, জ্বেলে দিবস— রবীন্দ্রনাথ।
“মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ, আছে শুধু প্রাণ। আনন্ত আনন্দ হাসি অফুরান।”— নজরুল।
- দুখ: ‘দুখ’ তৎসম ‘দুঃখ’ থেকে উদ্ভূত খাঁটি বাংলা শব্দ এবং ‘দুঃখ’-এর কোমল রূপ। উচ্চারণ /দুখ্/। ‘‘দুখের কথা তোমায় বলিব না”— রবীন্দ্রনাথ। “দিনরাত যার লাগি সুখ দুখ না করিনু জ্ঞান।”— রবীন্দ্রনাথ।
উভয়ের অর্থ (বিশেষ্যে) ১. মনস্তাপ (দুঃখ/দুখ মনকে ভেঙে দেয়)। ২. খেদ (দুঃখ/দুখ করা)। ৩. দুর্দশা (দুঃখে/দুখে পড়া)।
গীতিকার বনাম গায়ক
গীতিকার ও গায়কের মধ্য্যে পার্থক্য কী? যিনি কোনো গান বাণীবদ্ধ বা রচনা করেন তিনি গীতিকার। অর্থাৎ গানের রচয়িতাই হলেন গীতিকার। যেমন: রবীন্দ্রসংগীতের গীতিকার বা রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসংগীত বা নজরুলগীতির রচয়িতা নজরুল ইসলাম। যিনি কোনো গানে কণ্ঠ দেন বা গান তিনি ওই গানের গায়ক বা কণ্ঠশিল্পী। কোনো গান যদি রচয়িতার কণ্ঠে গীতি হয়, তাহলে ওই গানের গীতিকার ও গায়ক একজন। একটি গানের গায়ক অসংখ্য হতে পারে, কিন্তু গীতিকার হয় কেবল একজন। যেমন: আমাদের জাতীয় সংগীতের গীতিকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আর কেউ নন। তবে সংগীতটি অসংখ্য কণ্ঠে গীত হয়েছে, হয় এবং হবে।