আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ
ড. মোহাম্মদ আমীন
সংস্কৃত আমন্ত্রণ (আ+√মন্ত্র্+অন) শব্দের আভিধানিক অর্থ আহ্ববান, নিমন্ত্রণ ও সম্বোধন এবং সংস্কৃত নিমন্ত্রণ (নি+ √মন্ত্র্+অন) শব্দের আভিধানিক অর্থ দাওয়াত, ভোজনের আহ্বান, কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আহ্বান বা আমন্ত্রণ। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বঙ্গীয় শব্দার্থকোষেও উভয় শব্দের উৎস অভিন্ন ক্রিয়মূল (মন্) নির্দেশ করা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, অভিধানে নিমন্ত্রণ ও আমন্ত্রণ শব্দের অর্থগত কোনো পার্থক্য নেই। তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অনির্ধারিত কিছু সুক্ষ্ণ পার্থক্য রয়েছে। অনেকে মনে করেন, যে সকল দাওয়াত বা আহ্বানে আহ্বানকারীর পক্ষ থেকে ভূরি-ভোজের ব্যবস্থা থাকে তাকে নিমন্ত্রণ এবং যেখানে আহ্বানকারীর পক্ষ থেকে সাধারণত ভোজের ব্যবস্থা থাকে না বা মাঝে মাঝে থাকলেও তা ভূরিভোজ নয়- তাকে আমন্ত্রণ বলে। এ ব্যাখ্যা কিয়দংশ ঠিক হলেও পুরোপুরি ঠিক নয়।
সাধারণত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে ছোটখাটো সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা অন্যান্য বিশেষ উৎসবসমূহে অভ্যাগতদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে নিমন্ত্রণ শব্দটির অধিক ব্যবহার দেখা যায়। এ সকল দাওয়াতে সধারণত ভূরিভোজের ব্যবস্থা থাকে। অন্যদিকে
বড়ো আকারের রাজনীতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াতের বেলায় আমন্ত্রণ শব্দটির অধিক ব্যবহার লক্ষণীয়। তবে এখানেও অনেক সময় ভূরিভোজের ব্যবস্থা না হলেও হালকা ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনেক আমন্ত্রণে ভূরিভোজের ব্যবস্থা থাকে। নিমন্ত্রণের আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অভ্যাগতরা সাধারণত বিভিন্ন রকমের উপহার সামগ্রী নিয়ে আসেন, কিন্তু আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে সাধারণত উপহার আনার রেওয়াজ নেই। আনা হলেও তাতে ব্যক্তি উদ্যোগের চেয়ে সমষ্টিগত বা আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ অধিক পরিলক্ষিত। নিমন্ত্রিত অতিথিদের আমন্ত্রিত অতিথিও বলা যায়। আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেক সময় উপহার সামগ্রী দেওয়া হয়, কিন্তু নিমন্ত্রিত অতিথিদের ক্ষেত্রে তা সাধারণত দেখা যায় না। যেমন : অনেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বিশেষ অতিথিগণকে উপহারসামগ্রী প্রদান করা হয়। আমার এ ব্যাখ্যা সাধারণের জন্য, বিশেষজ্ঞদের জন্য আরো কিছু রয়েছে।

আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ বিষয়ে কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী লিখেছেন, “আজকাল ইংরেজির প্রভাবে প্রতীকী (লোগো-সেন্ট্রিক) প্রথায় ‘আমন্ত্রণ’=Invitation, এবং নিমন্ত্রণ=Invitation; অর্থাৎ দুটো বাংলা শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে । অথচ “বর্ণভিত্তিক-ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি” অনুযায়ী এই শব্দ-দুটিরই অর্থভেদ ছিল । ইংরেজির প্রভাবে আমরা এই শব্দদুটির বাকি অর্থগুলো ফেলে দিয়ে শুধু Invitation (‘ভোজনার্থ আহ্বান)-এ পরিণত করেছি ।আগে তা ছিল না । ‘মন্ত্রণা’ করার জন্য ডাকলে সে-ডাককে বলা হত ‘আমন্ত্রণ’ এবং ‘মন্ত্র’ দেওয়ার জন্য ডাকলে, তেমন ডাককে বলা হত ‘নিমন্ত্রণ’ । ‘আমন্ত্রণে’ ‘মন্ত্রের’ আয়োজন ছিল, ‘নিমন্ত্রণে’ মন্ত্রের নিয়োজন ছিল । একালের মতো করে বললে বলতে হয় – মন্ত্রী যখন জেলায় জেলায় বন্যা-পরিস্থিতি বিষয়ে ‘মন্ত্রণা’ করার জন্য জেলাশাসকদের ডেকে পাঠান, সেটি ‘আমন্ত্রণ’ । কিন্তু যখন বন্যা-মোকাবিলার উপায় বা ‘মন্ত্র’ তিনি নিজেই ঠিক করে রেখেছেন, শুধু সেটি রূপায়ণের উদ্দেশ্যে জেলাশাসকদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যদি তিনি তাঁদের ডেকে পাঠান, সেটি ‘নিমন্ত্রণ’ ।
আর যখন তিনি (১) মন্ত্রণা করার জন্য ডেকে পাঠান এবং অবশেষে একটা মন্ত্রে উপনীত হয়ে, (২) সেই মন্ত্র রূপায়ণ করার নির্দেশও দান করেন (অর্থাৎ দুটো কাজই একসঙ্গে পালন করেন) ফেরত পাঠালে, তাকে ‘আমন্ত্রণ’ ও ‘নিমন্ত্রণ’ দুইই বলা যায় । আর ‘মন্ত্রী’ তো ‘মন্ত্রণা’ করবেনই । কেননা, ‘মন’-কে ত্রাণ করে যে তাকেই তো ‘মন্ত্র’ বলে । এবং সেই ‘মন্ত্রের ধারক ও বিকাশসাধনকারী’কেই তো ‘মন্ত্রী’ বলে । মন, মন্ত্র, মন্ত্রী, আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ এই সব শব্দের ক্রিয়ামূল হলো ‘মন্’ ।”
শুভাশীষ চিরকল্যাণ পাত্রের ভাষায়, “ আমন্ত্রণে মন্ত্র আসে, নিমন্ত্রণে মন্ত্র নির্গত হয়। এই দিক থেকে বিচার করলে ওরা পরস্পরের বিপরীত শব্দ। উভয় ক্ষেত্রে মন্ত্রনাই আসল, খাওয়া-দাওয়া গৌণ। তবে কথা হলো, খালি পেটে মন্ত্র ভালো কাজ করে না। আমার এক শিক্ষক মহাশয় বলতেন, ”Without eating there is no meeting.” সুতরাং আমন্ত্রণ আর নিমন্ত্রণ যাই হোক, সঙ্গে খাওয়াদাওয়াও হয়। যারা মন্ত্র নেওয়া বা দেওয়ার কথা ভুলে গিয়ে খাওয়াটাকেই বেশি গুরুত্ত্ব দেন, তারা আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণকে সমার্থক শব্দ বলেও বিবেচনা করতে পারেন। তবে আমি বলব মন্ত্রের ব্যাপারটি ভুল গেলে চলবে না। আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ শব্দে খাওয়ার ব্যাপারটিই বরং নেই, উভয় ক্ষেত্রে আ ও নি উপসর্গের সঙ্গে মন্ত্রণ শব্দটিই আছে। সুতরাং এখানে মন্ত্রকে ভুলে গেলে চলবে না। কেউ তা করলে ব্যাকরণবিদদের মন খারাপ হয়।”
প্রয়োগ : (১) আলোচন শেষ হওয়ার পর মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিমন্ত্রিত অতিথিবর্গকে চা পানের আমন্ত্রণ জানালেন। (২) রশিদ সাহেবের মেয়ের বিয়েতে তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। (৩) শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। (৪) আমন্ত্রিত প্রধান অতিথিকে সম্মানস্বরূপ এক সেট গ্রন্থ প্রদান করা হয়েছে।
এ নিয়ে আরও আলোচনা করা যায়। আপাতত এটুক লিখলাম। পরে পোস্ট হিসেবে আরও বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। ভুল হলে সংশোধন করে দেবেন।
———————————————————-