অরণ্য বন ও জঙ্গল: নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা

ড. মোহাম্মদ আমীন

অরণ্য বন ও জঙ্গল: নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘অরণ্য’ শব্দের অর্থ গাছপালায় ঢাকা জায়গা যেখানে বন্য পশু বিচরণ করে, বন, জঙ্গল প্রভৃতি।বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত  ‘জঙ্গল’ শব্দের অর্থ বন, অরণ্য, ঝোপঝাড়পূর্ণ স্থান, নির্জনস্থান প্রভৃতি। অন্যদিকে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘বন’ শব্দের অর্থ অরণ্য, জঙ্গল, কানন, কুঞ্জ, গহন, বিপিন। আভিধানিক অর্থ বিবেচনায় অরণ্য, বন ও জঙ্গল – তিনটি শব্দই সমার্থক মনে হয়। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কোনো শব্দই সমার্থক হতে পারে না। কেননা, আর্থিক আর প্রায়োগিক পার্থক্যের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন থেকে সমার্থক শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। কোনো ব্যক্তি, বিষয় বা বস্তু অন্য কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয়ের মতো হওয়া মানে অভিন্ন হওয়া নয়। অভিধানে যেটি শব্দ, বাক্যে তা শব্দ থাকে না, পদ হয়ে যায়। শব্দার্থ একাধিক হতে পারে, কিন্তু পদার্থ বাক্যবিশেষে সুনির্দিষ্ট। যেমন : কেউ যদি প্রশ্ন করে, “ বলঅর্থ কী?” প্রশ্নের উত্তর হতে পারে শক্তি, খেলার বল, say প্রভৃতি। কিন্তু শব্দটি যখন বাক্যে বসে তখন তার অর্থ একদম সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। যেমন : বল শাহিন, শুধু বল দিয়ে কি বল খেলা যায়? প্রথম ‘বল’এর অর্থ say, দ্বিতীয় ‘বল’ এর অর্থ শক্তি এবং তৃতীয় বল এর অর্থ ফুটবল।

এবার বন-জঙ্গলে চলে যাই। অরমমান শব্দ থেকে অরণ্য শব্দের উৎপত্তি। প্রাচীন ভারতে অনেকে গুরুগৃহে শিক্ষাগ্রহণ সমাপ্ত করে বাড়ি ফিরতেন না। তাঁরা চিরকুমার-ব্রহ্মচারী হয়ে সংসার ও নারীসঙ্গ বর্জন করে অধ্যাত্মবিদ্যার অনুশীলন করতেন। অনেকে অধ্যাত্ম সাধনার জন্য বনে বসবাস করতেন। তাদের অরমমান বলা হতো। সাধারণ্যে, অরমমানগণ অরণ নামে পরিচিত ছিল। মূলত এ অরণ শব্দ থেকে অরণ্য শব্দের উৎপত্তি। অরণ হতে হলে এমন স্থানে বাস করতে হতো, যেটি ছিল খুবই দুর্গম এবং শ্বাপদসংকুল। ফলে সেখানে মনুষ্যবসত গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল। সে অর্থে অরণ্য হচ্ছে ঘন গাছাপালায় গভীরভাবে ঢাকা বন্যপশুর অভয়াশ্রম যেখানে সংগত কারণে স্বাভাবিক মনুষ্যবসতি সম্ভব নয়। অরণ্যে মানুষজন থাকত না বলে সেখানে রোদন করলেও  করলেও সাহায্যের কেউ থাকে না। সব আবেদন নিষ্ফল হয়ে যেত। যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে বাংলা বাগ্‌ধারা অরণ্যে রোদন, মানে নিষ্ফল আবেদন।

সুতরাং, কোনো স্থানকে অরণ্য হতে হলে ওই স্থানকে শুধু গাছপালায় আবৃত থাকলে হবে না, বন্য পশুর অবাদ বিচরণ থাকতে হবে এবং মনুষ্যবসতির অনুকূল পরিবেশও থাকতে পারবে না। যদিও বর্তমান বিশ্বে এমন স্থান ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। তাই অভিধানে এখন অরণ্যের সেই উৎপত্তিগত অর্থ কিছুটা বিস্তৃত হয়েছে। বন্য পশু বিচরণ করে গভীর জঙ্গল বা গভীর বনে। অতএব, উৎস-ঘটনা বিবেচনায় অর‌ণ্য শব্দের কার্যকর অর্থ হতে পারে ঘন গাছপালায় ঢাকা বন্যপ্রাণী অধ্যুষিত এবং মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত শ্বাপদসংকুল স্থান।

এবার বনে চলে আসা যাক। অরণ্য, বন ও জঙ্গল এ তিনটি শব্দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ ‘বন’। অভিধান ও প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রে রয়েছে তার অবাধ বিবচরণ। আলোচ্য তিন শব্দের মধ্যে কেবল বনেই ভোজন করা যায়, বেড়ানো হয়, আনন্দ করাযায়। বন নিয়েই রচিত হয়েছে আবেগঘন কবিতা, গান। শহরেও ঢুকে গেছে বোন : বনানী, বনশ্রী। সাহিত্যিকের নামও অলংকৃত করেছে বন : যেমন – বনফুল, বনবিহারী। বন নিয়ে গঠিত হয়েছে অনেক শব্দ। যেমন : বনকন্দ, বনকপোত, বনকর, নবকুক্কুট, বনচর, বনচাঁড়াল, বনচারী, বনজঙ্গল, বনজাত, বনতিক্ত, বনতুলসী, বনদেবতা, বনদেবী, বননিবাসিনী, বনপথ, বনপাল, বনফুল, বনবাদাড়, বনবাস, বনবিড়াল, বনবিহারী, বনভোজ, বনভোজন, বনমানুষ, বনমালী, বনমোরগ, বনরাজি, বনলক্ষ্মী, বনশ্রী, বসম্পদ, বনসাই, বনস্পতি প্রভৃতি। বন বলতে ফুলের বাগানও বোঝায়, যেমন : ফুলবন। হেমন্ত গেয়েছেন: “ সেদিনো বলেছিলে এই সে ফুলবনে – – -।” শচীন দেব বর্মণ গেয়েছেন, “নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা, নিশিতে যাইও ফুলবন। “ হেমন্ত-শচীনের বন আসলে অভিধানের জঙ্গল নয়। এটি অভিধানের কানন ও কুঞ্জ। অর্থাৎ বন হচ্ছে এমন একটি স্থান, যেটি অরণ্য নয়, আবার জঙ্গলও নয়।

জঙ্গল শব্দের অর্থ অভিধানে যাই থাকুক না কেন, বাক্য এবং কথায় শব্দটি সাধারণত ঝোপঝাড়পূর্ণ স্থান, নির্জনস্থান প্রভৃতি অর্থ প্রকাশে অধিক ব্যবহৃত হয়। বন বা অরণ্য যদি বাঘ হয়, তাহলে জঙ্গল হচ্ছে বিড়াল এবং বন হচ্ছে চিতাবাঘ। চিতাবাঘমুক্ত স্থান জঙ্গল। তাই অরণ্য বা বনকে জঙ্গল বললে এদের অপমান করা হয়, কিন্তু জঙ্গলকে বন বা অরণ্য বললে জঙ্গল পুলকিত হয়, যদিও তা সঠিক নয়। অর্থাৎ সকল জঙ্গল, অরণ্য বা বন নয়; তবে প্রত্যেক অরণ্য বা বনে কিছু না কিছু জঙ্গল থাকেই।

উপর্যুক্ত আলোচনা হতে বলা যায়, অরণ্য হচ্ছে মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত ও পশুপাখির নিরাপদ পরিবেশমণ্ডিত ঘন গাছপালা-বেষ্ঠিত স্থান। বন হচ্ছে এমন অরণ্য যেখানে অরণ্যপশুর সঙ্গে মানুষের বসতিও কিছুটা রয়েছে। আর জঙ্গল হচ্ছে ছোটো বন। অতএব দেখা যায়, অধুনা খুব কম অরণ্যই অভিধানে বর্ণিত বিশুদ্ধ অরণ্য-চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে পারছে। আমাজান অরণ্যের গভীরে যাই হোক, ইতস্তত রয়েছে মানুষের বাস, ফুলের বাগান। তাই আমাজানের মতো গভীর অর‌ণ্যকেও বলা হচ্ছে, আমাজান বন। অবশ্য ইংরেজিতে এসব কাহিনি খুব কম।তারা ফরেস্ট দিয়েই সব কাজ সেরে ফেলে।

 

Leave a Comment

You cannot copy content of this page