সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা, কুলাঙ্গারের ভাষাবোধ, প্রমিত ভাষা কী, জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলা ভাষা

সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা, কুলাঙ্গারের ভাষাবোধ, প্রমিত ভাষা কী, জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলা ভাষা

ড. মোহাম্মদ আমীন

বাংলাদেশে বাংলা ভাষা

গডউইন স্পিল্ট এবং ল্যামিনা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্য বাংলাদেশের মানুষ আর তাদের মানসিকতা নিয়ে গবেষণা করেছেন ছয় মাস। আমি তাঁদের সাময়িক সহায়ক হিসেবে ছিলাম। আজ বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন তারা।
বিদায়কালে জানতে চাইলাম, কী পেলে তোমরা?
ল্যামিনা বলল, অধিক হাসাকে বাংলাদেশে অপরিপক্কতা মনে করা হয়। তাই বাংলাদেশের মানুষ সহজে হাসে না। সম্ভবত এ দেশের জনগণই সবচেয়ে কম হাসে। অবশ্য এর সঙ্গে আর্থিক সংকটও জড়িত।পেটে ভাত না থাকলে মুখে হাসি আসে না। কম হাসলেও তারা বেশ অমায়িক এবং বন্ধুসুলভ। বিশেষ করে বিদেশিদের প্রতি খুব আন্তরিক।
স্পিল্ট বলল, বাংলাদেশের রিক্সাসমূহ প্রতিদিন গড়ে ২,৯০,০০,০০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। যা লন্ডন-আন্ডারগ্রাউন্ডে চলাচলরত সকল প্রকার যানবাহনের অতিক্রান্ত দূরত্বের দুইগুণেরও বেশি। সবচেয়ে অবাক বিষয় কী জানো?
কী? আমি জানতে চাইলাম।
স্পিল্ট বলল, মাতৃভাষার জন্য বাঙালিরা জীবন দিলেও শুদ্ধ মাতৃভাষা লেখায় শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত সর্বশ্রেণির বাঙালির চরম অবহেলা ও অজ্ঞতা দেখেছি। পৃথিবীর আর কোনো জাতি মাতৃভাষার প্রতি এমন অবহেলা দেখায় না।
ল্যামিনা বলল, সত্যি অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশে প্রায় ২০০০ সাময়িকী এবং দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। অথচ সংবাদপত্র পাঠকের হার মোট জনসংখ্যার ১৫%।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা 
ভাষীর সংখ্যা, বোধগম্যতা, ব্যবহার, মাতৃভাষা, সাহিত্যকর্ম, সৃজনশীলতা, বিশ্ববিস্তৃতি, শিক্ষার মাধ্যম, জনপ্রিয়তা, রাষ্ট্রীয় ও দাপ্তরিক কাজে প্রয়োগ, বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা, আর্থ-সামাজিক মূল্যায়ন — যেদিক দিয়ে বিবেচনা করা হোক না, বর্তমানে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা ইংরেজি।
মাতৃভাষা-সহ সামগ্রিকভাবে ভাষীর সংখ্যা বিবেচনায় নিচে শ্রেষ্ঠ দশটি ভাষার তালিকা নিচে দেওয়া হলো—
1 ইংরেজি (English) ভাষী ১,৪০ কোটি
2 ম্যান্ডারিন (Mandarin Chinese) ১,৩০ কোটি
3 হিন্দি (Hindi) ৬৫ কোটি।
4 স্প্যানিশ (Spanish) ৫৩.৫ কোটি
5 ফরাসি (French) ৩১.১ কোটি
6 মান আরবি ( Standard Arabic) ৩০ কোটি
বাংলা (Bengali) ২৯ কোটি।
8 রুশ (Russian) ২৬ কোটি
9 পোর্তুগিজ (Portuguese) ২৩.৫ কোটি
10 ইন্দোনেশিয়ান/জাভানীয় (Indonesian) ২০.৩ কোটি
উপর্যুক্ত ১০টি ভাষার মধ্যে ইংরেজি, হিন্দি, স্প্যানিশ, ফরাসি, বাংলা, রাশিয়ান ও পোর্তুগিজ ভাষার উৎস ইন্দোইউরোপীয়ান। ম্যান্ডারিন ভাষার উৎস চায়নো-তিব্বতি, আরবি ভাষার উৎস অ্যাফ্রো-এশিয়াটিক এবং ইন্দোনেশিয়ান ভাষার উৎস অস্ট্রোনেশিয়ান।
একান্তভাবে মাতৃভাষীর সংখ্যানুসারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দশটি ভাষা হলো—
  1. ম্যান্ডারিন চায়নিজ; (১২৮.৪০ কোটি)
  2. স্প্যানিশ; (৪৩.৭০ কোটি)
  3. ইংরেজি; (৩৭.২০ কোটি)
  4. আরবি; (২৯.৫০ কোটি)
  5. বাংলা; (২৮.৫০ কোটি)
  6. পোর্তুগিজ; (২১.৯০ কোটি)
  7. রুশ; (১৬.৪০ কোটি)
  8. জাপানিজ; (১২.৮০ কোটি)
  9. লাহান্দা (পাকিস্তান/পঞ্জাব); (১১.৯০ কোটি)
  10. জাভানীয় (ইন্দোনেশিয়া); (১১.০০ কোটি)
এর পরের অবস্থানে যথাক্রমে কোরীয়, জর্মান, ফরাসি, তেলেগু, মারাঠি, তুর্কি প্রভৃতি। এসব ভাষার মাতৃভাষীর সংখ্যা কমবেশি ৭ কোটির ওপরে কিন্তু ৮ কোটির নিচে।
এটি আমার তৈরি কোনো তালিকা নয়। বিভিন্ন গবেষণায় প্রদত্ত বিবরণ ও তালিকা বিশ্লেষণ করে গৃহীত। ভাষীর সংখ্যা বিভিন্ন গবেষণা তালিকায় বিভিন্ন রকম দেখা গেলেও ক্রমপঞ্জিতে তা প্রভাব ফেলে না। আপনি যদি এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে চান তাহলে গুগলে খোঁজ নিতে পারেন।
কুলাঙ্গারের ভাষাবোধ
আধুনিকতা, সহজকরণ আর পরিবর্তনের অজুহাতে যারা যুক্তাক্ষর পরিত্যাগ এবং ‘প্রায় সমোচ্চারিত’ বর্ণ বিলোপের কথা বলে— তারা কেন নিজের দু-চোখের এক চোখ, দু-কানের এক কান কিংবা শরীরের অতিরিক্ত অংশ ফেলে দেয় না?
যারা সহজকরণ আর আধুনিকতার দোহাই দিয়ে মাতৃভাষার স্বকীয়তা বিপর্যস্ত করার কথা বলে, তারা যেন নিজের মাকে প্যারিসের রাস্তায় অর্ধ উলঙ্গ করে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। এ দুটোর মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না।
মাতৃভাষা মায়ের ভাষা বলেই মাতৃভাষাকে অন্য ভাষার চেয়ে বেশি অধ্যয়ন করা আবশ্যক। নিবিড় সহচর্য, পর্যাপ্ত অধ্যয়ন ও ভালোবাসার অভাব এবং দূরত্ব আর যোগাযোগহীনতা খুব কাছের মানুষকেও অপরিচিত এবং জানা বিষয়কেও কঠিন করে তোলে। যে ব্যক্তি নিজের মাতৃভাষাকে কঠিন বলে— সে নিশ্চয় কুলাঙ্গার সন্তানের মতো দীর্ঘ দিন জন্মদাত্রীকে অযত্ন-অবহেলায় পিষ্ট করেছে।
মধুসূদন বাংলাকে অবহেলা করে ইংরেজ হওয়ার জন্য দেশ ছাড়ার সংকল্প নিলে, মাতৃভাষারূপী বাংলা জননী মধুকে বলেছিল —
“যাস নে, বাবা। রাখব তোকে অরূপ যতন সাদরে।”
“কে বুড়ি ভিক্ষুক, জড়িয়ে আমায় শ্রীহীন এমন আদরে?” [মধুর জবাব]
“আমি তোর মা”,
জবাব দিল মধু— “চিনি না বুড়ি, হাত ছাড়্‌।”
“দিলাম ছেড়ে, চলে যা তুই— হারামজাদা কুলাঙ্গার,
ভিক্ষুক হয়ে আমার কোলে;
আসতেই হবে ফিরে—
একবার নয়, বারবার এবং বারবার ।”
জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলা পৃথিবীর চতুর্থতম ভাষা। বাইশ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষায় কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেই বিবেচনায় বাংলা ভাষার সীমাবদ্ধতা বলা যায় অতি নগণ্য। পৃথিবীতে প্রতবছর ৭ টি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যার বিলুপ্তি ভাষা – বিলুপ্তির প্রধান কারণ। সে হিসাবে বাংলা ভাষার অবস্থান পতনের দিকে নয়, উত্থানের দিকে।
পৃথিবীতে চারটি ভাষাও যদি টিকে থাকে তন্মধ্যে একটি হবে বাংলা। তবে, আমরা যারা বাংলা ভাষায় লিখি এবং বলি, বিশেষ করে শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত হিসাবে পরিচিত – তাঁদের অনেকের কার্যকলাপ বাংলা ভাষাকে ক্রমশ বিপন্নতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পণ্ডিতদের লেখা – লেখি বাংলা বানান ও উচ্চারণ রীতির বিরাট প্রতিবন্ধক। তাঁদের লেখা ও বানানে পারস্পরিক ভিন্নতা সাধারণ পাঠকদের বাংলা বানান ও শব্দচয়নে সাংঘাতিকভাবে স্বেচ্ছাচারী করে তুলছে। ভাষার আভ্যন্তরীণ রীতি-নীতির তুঘলকি সিদ্ধান্ত ও দায়-বোধহীন চিন্তা -চেতনা বাংলা ভাষাকে ক্ষয় রোগের মতো পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পণ্ডিতবর্গের বানান বিষয়ক মতানৈক্য বাংলা ভাষার বিদ্যমান জটিলতার মূল কারণ। মাছের মায়ের বাচ্চা খাওয়ার মতো আমাদের ভাষাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা বাংলা ভাষাকে আস্তে-আস্তে যেন খেয়ে ফেলছেন। একবিংশ শতকে এসেও বুদ্ধিজীবীরা বাংলার মতো একটি সুসমৃদ্ধ ভাষাকে সমতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারছেন না। এ ব্যর্থতার দায় তাঁরা কীভাবে এড়াবেন?
প্রমিত শব্দের মানে কী? প্রমিত ভাষা কী?
সংস্কৃত প্রমিত (প্র+√মা+ত) অর্থ— (বিশেষণে) জ্ঞাত, নির্দিষ্ট মানসম্মত, পরিমিত, প্রমাণিত। ইংরেজিতে, standard। প্রমিত ভাষা হলো ভাষার নির্দিষ্ট মানসম্মত একটি আদর্শ রূপ। যাতে পরিমিত বোধ বা সর্ববোধ্য রূপ বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। নির্দিষ্ট মান বজায় রেখে এর রূপ প্রণয়ন করা হয়। তাই এটি মান ভাষা নামেও পরিচিত। কোনো ভাষার নির্দিষ্ট কোনো রূপকে যথাসম্ভব সর্বজনীন বা আদর্শ মানে উপনীত করা হলে তাকে প্রমিত ভাষা বলা যায়। ভাষার গঠন বা রূপ নিয়ে নানাজনের নানা মত থাকে, থাকতে পারে। এর মধ্যে মোটামুটি সর্বাধিকের গ্রহণীয় রূপটি প্রমিত ভাষা বা মান ভাষা। প্রমিত ভাষার সংজ্ঞার্থ নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে। আগ্রহ ও সদিচ্ছা থাকলে ভিন্নমতের সমন্বিত মতসমূহের মাধ্যমে বিদ্যমান প্রমিত ভাষাকে ক্রমান্বয়ে আরও প্রমিত এবং আরও সর্বজনীন করার কাজে ব্যবহার করা যায়।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page


CasibomCasibom