পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ও শ্রুতিমধুর ভাষা, বিশ্বের প্রথম ভাষা সৈনিক, হায়রে আমার বাংলা মা, বাংলা খুব কঠিন ভাষা

ড. মোহাম্মদ আমীন

পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি বা শ্রুতিমধুর ভাষা কোনটি?
ভাষা কোনো অঙ্ক কিংবা পূর্ণাঙ্গ সংখ্যার যোগবিয়োগ বা গুণভাগ নয় যে, ফল সর্বত্র অভিন্ন হবে। কেবল একটি শর্ত দ্বারা কোনো ভাষার কোনো অবস্থান কোনোভাবে সর্বজনীন গ্রাহ্যতায় নির্ধারণ করা যায় না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাতৃভাষা, পরিবেশ, অনুভূত চেতনা, অভিজ্ঞতার প্রকৃতি, সান্নিধ্য, বিবেচনাবোধ ও মানসিক গ্রাহ্যতা-সহ অসংখ্য বিষয়ের ওপর

ড. মোহাম্মদ আমীন

ভাষার মিষ্টত্ব, শ্রুতিমাধুর্য কিংবা অন্যান্য বিষয়ের সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল। যে ভাষা একজনের কাছে মিষ্টতা বিবেচনায় এক নম্বর, তা অন্য কারো কাছে এক নম্বর নাও হতে পারে। হয়ে যেতে পারে দশ নম্বর। কিংবা ওই ভাষা তার অপরিচিতও থেকে যেতে পারে। আবার ঈর্ষা কিংবা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ দ্বারাও এটি তাড়িত হতে পারে। তাই প্রশ্নটির উত্তর একটি আপেক্ষিক ধারণা মাত্র। —- —- – — এজন্য “পৃথিবীর মিষ্টিতম ভাষা কোনটি?” — – — — প্রশ্নের গবেষণায় ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যময় উত্তর দেখা যায়। দেখা যায় সাংঘর্ষিক ফল। দেখুন নিচে কয়েটি জরিপ/প্রতিবেদন—

নিচের সংযোগে পাবেন।
বাংলা– পৃথিবীর মিষ্টিতম ভাষা (Bengali– the sweetest language in the world) শিরোনামের প্রতিবেদনে (মূল লেখায় সংযোগ/লিংক দেওয়া আছে) বলা হয়েছে:

“২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেসকো (UNESCO) পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ‘বাংলা’ বিশ্বের সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মিষ্টি ভাষা হচ্ছে যথাক্রমে ‘স্প্যানিশ’ ও ‘ডাচ’। বাংলা পৃথিবীর মিষ্টতম ভাষা (Bengali – The Sweetest Language in India) শিরোনামের প্রতিবেদনে যুক্তি-সহ বলা হয়েছে: বাংলা ভারতবর্ষের মিষ্টিতম ভাষা।

এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার দেখা আরও ৩৩টি প্রতিবেদন বলা হয়েছে, “ইউনেসকোর জরিপমতে, বাংলা পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।” ভারতভিত্তিক একটি ব্লগে (Sweetest language tag for Bengali?) দাবি করা হয়েছে, “ইউনেসকোর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে তারা এমন জরিপ পরিচালনা করেনি এবং কোন ঘোষণা দেয়নি।” প্রতিবেদনটি দেখে প্রশ্ন এসেছে: এই প্রতিবিদেনের ভিত্তি কী? যোগাযোগ করেছে – তারই বা ভিত্তি কী? ইউনেসকো কখনো বলেনি যে, প্রকাশিত প্রতিবেদন ভিত্তিহীন। পৃথিবীর মিষ্টিতম ভাষা কোনটি, এ বিষয়ে কে কী অভিমত ব্যক্ত করেছে কিংবা অভিমতের ভিত্তি, যুক্তি বা বৈশিষ্ট্য কী তা জানতে গিয়ে ৩১টি ভাষার ১২৩টি প্রতিবেদন দেখেছি। — – – — — প্রতিবেদনসমূহ দেখতে চাইলে গুগলে খোঁজ নিতে পারেন।

প্রতিবেদনসমূহে পৃথিবীর ১০টি মিষ্টিতম ভাষার তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। দশটি মিষ্টি ভাষার বিন্যাস ও অবস্থানে বৈচিত্র্য ও নানা বৈপরীত্য লক্ষণীয়। একেকটি লেখায় একেকটি ভাষাকে মিষ্টি ভাষা হিসেবে প্রথম স্থানে রাখা হয়েছে। অধিকাংশ প্রতিবেদনে পৃথিবীর সেরা ১০টি ভাষার মধ্যে বাংলার নাম বিদ্যমান।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশের প্রতিবেদনে সেরা দশের মধ্যে বাংলার স্থান রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারতীয়দের কয়েকটি প্রতিবেদেনে দেখা যায়: বাংলাকে মিষ্টি ভাষা হিসেবে সেরা দশের মধ্যে স্থানই দেয়নি। অথচ, তাদের জাতীয়সংগীতের ভাষা বাংলা। এসব প্রতিবেদন বিবেচনা করে বলা যায়, সামগ্রিক বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হলো বাংলা। ইউনেসকো কী বলল না-বলল তা বিষয় নয়। অনেক বাঙালি বলেন, বাংলা পৃথিবীর মিষ্টিতম ভাষা নয়। তাদের কাছে প্রশ্ন তাহলে আপনার মতে এটি কোনটি? আমার মা আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ।

বিশ্বের প্রথম ভাষা আন্দোলন ও প্রথম ভাষা সৈনিক
মহামতি গৌতম বুদ্ধ (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৩ বা ৪৮০ অব্দ—আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৩ বা ৪০০ অব্দ) বিশ্বের প্রথম ভাষা সৈনিক। বিশ্বে সর্বপ্রথম তাঁর হাতেই ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত সূচনা ঘটে। তৎকালে দেবভাষা হিসেবে পরিচিত সংস্কৃত ছাড়া অন্য-কোনো ভাষায় ধর্মকর্ম করা ছিল নিষিদ্ধ এবং মহা পাপের কাজ। সেকালে উত্তর ভারতে অঞ্চলভেদে প্রাকৃত-সহ বিভিন্ন নামে প্রায় কাছাকাছি প্রকৃতির অনেকগুলো আঞ্চলিক/ মৌখিক/কথ্য ভাষা প্রচলিত ছিল। তন্মধ্যে বহুল প্রচলিত ছিল প্রাকৃত ও পালি। এ ভাষাগুলোর বর্তমান রূপই হলো বাংলা। আধুনিক গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে— পালি ও প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব। অর্থাৎ পালি ও প্রাকৃতই হচ্ছে বাংলার আদি রূপ।
সংস্কৃত ছিল ধর্মগ্রন্থ, ব্রাহ্মণ, রাজকীয় প্রশাসন এবং অভিজাতদের ভাষা। সাধারণ লোকের কাছে সংস্কৃত ছিল রাজ দরবারের মতো অপ্রবেশ্য। সংস্কৃত ছাড়া অন্যভাষীদের বলা হতো— অসূর, রাক্ষস ও ছোটোজাত। তাদের ভাষাকে তুলনা করা হতো- মুখ থেকে বের হয়ে আসা বিকট দুর্গন্ধের সঙ্গে। অন্যসব গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও কেবল ভাষার জন্য প্রাকৃতভাষী জনগণ হয়ে পড়েছিল— অস্পৃশ্য, ঘৃণ্য আর পাপিষ্ঠ।
গৌতম বুদ্ধ সংস্কৃতভাষীর এমন অত্যাচারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেন সমন্বিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ। তিনি সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ করে সাধারণ মানুষ ও তাদের মুখের ভাষাকে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গৌতম বুদ্ধ ভাষা নির্ধারণের জন্য সমগ্র উত্তর ভারত পরিভ্রমণ করেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীর সর্বজন বোধ্যতা বিবেচনায় তিনি দেবভাষা বাদ দিয়ে অসূরের ভাষায় ধর্মগ্রন্থ রচনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ অবস্থায় গৌতমবুদ্ধ বাংলার পূর্বরূপ তথা পালি ভাষায় ধর্মগ্রন্থ রচনা করে পৃথিবীতে প্রথম ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটান। তিনিই বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি, যিনি আদি বাংলায় ধর্মগ্রন্থ রচনা করে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে স্বর্গীয় ভাষায় পরিণত করেছেন। তাঁর এই সূচনা বায়ান্নের আন্দোলনে ত্যাগের প্রেরণা হয়ে সার্থকতা দিয়েছে বিজয়ে, ছড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বে পৃথিবীর সবচেয়ে সুমিষ্ট ভাষা বাংলাকে।
হায়রে আমার বাংলা মা
“পৃথিবীর কঠিনতম ভাষা কী জানেন? – ‘বাংলা’। কারণ এই ভাষার ব্যাকরণ অন্যান্য ভাষার ব্যাকরণের চেয়ে কঠিন।”— জনাব Nazim Khan নামের এক শুবাচির অবিকল যযাতি।
নাজিম খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর ফেসবুক দেওয়ালে গিয়ে দেখলাম বেশ আকর্ষণীয়— বোদ্ধাময় লেখা, পরিষ্কার চিন্তা এবং পাণ্ডিতিক ধারণা। এমন একজন শিক্ষিত বাংলাভাষী যদি মাতৃভাষা নিয়ে এমন বিরূপ ধারণা পোষণ করতে পারেন, তাহলে বুঝতে আর বাকি থাকে না আমরা আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং আত্মমর্যাদাবোধে কত অনুর্বর। আমি জানি না, তিনি পৃথিবীর কয়টি ভাষার ব্যাকরণ পড়েছেন।
ভুল হতে পারে, কঠিনও মনে হতে পারে— তাই বলে মাতৃভাষা নিয়ে এমন অবজ্ঞা! আসলে, বাঙালির মতো এমন আত্মমর্যাদাহীন জাতি পৃথিবীতে আর নেই। তাই ষোড়শ শতকের কবি আবদুল হাকিমের উচ্চকিত ক্ষোভ —
“যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়,
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায়?
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি,
দেশি ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।”
বাংলা খুব কঠিন ভাষা
যে-লোক ইংরেজি বর্ণের সঙ্গেও ভালোভাবে পরিচিত না, সে লোক তার ছেলেমেয়ের বিয়ের দাওয়াতপত্র ছাপায় ইংরেজিতে; যে লোক ইংরেজিতে একটা শুদ্ধ বাক্যও বানাতে পারে না, সেও বলে, বাংলার মতো কঠিন এবং ইংরেজির মতো সহজ ও বোধগম্য ভাষা আর নেই। গতকাল একজন কথা প্রসঙ্গে বলল, “বাংলা খুব কঠিন ভাষা। ইংরেজি অনেক সহজ, অনেক কাছের মনে হয় ।” বাংলা যদি এত কঠিন হয় তো, আপনি বাংলা বলেন কেন?
যারা ইংরেজি জানে না, তারাই বলে- বাংলা কঠিন ভাষা। মাতৃভাষা মায়ের মতো; যার মা নেই, মা-থাকলেও তার সঙ্গে ভালো পরিচিতি নেই, বোঝাপড়া নেই, হৃদ্যতা নেই– তার জন্ম ও ঐতিহ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। যার মাতৃভাষা নেই, তার শিক্ষা সূচিত হবে কীভাবে? বাংলা ভাষায় যতটি বর্ণ ততটি অক্ষর, কিন্তু ইংরেজিতে অক্ষরের সংখ্যা বর্ণের প্রায় দ্বিগুণ। এমন ভাষা কীভাবে বাংলার চেয়ে মধুর হয়, সহজ হয়?
বার্ট্রান্ড রাসেল-সহ আরও অনেক ইংরেজ ভাষাবিদের মন্তব্য, “ English is an abnormal language”. তবু, মাতৃভাষা হিসেবে ইংরেজিই তাদের প্রিয় ভাষা।
প্রতিবন্ধী হলেও নিজের মা-ই শ্রেষ্ঠ। বিজাতীয় ভাষা কীভারে মাতৃভাষার চেয়ে সহজ, বোধগম্য ও কাছের হয়? কুলাঙ্গার না-হলে মায়ের বর্তমানে নিজের মায়ের চেয়ে অন্যের মা কীভাবে কাছের হয়? নিজের মাকে সবাই চেনে, কিন্তু সবাই ভালোবাসে না; অনেকে ধনী প্রেমিকার স্মার্ট মায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ঐতিহ্যহীন জাতির বিবেকহীন সন্তানগণ মাতৃভাষারূপী মায়ের সঙ্গে এমন আচরণ করে। আমি বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না, কিন্তু আগে মাতৃভাষা। সন্তান নিজের মাকে যেমন সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, তেমনি প্রত্যেকের উচিত মাতৃভাষাকে অন্য ভাষার চেয়ে বেশি ভালোবাসা।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page