অংশীদারত্ব ও অংশীদারিত্ব কোনটি সঠিক

ড. মোহাম্মদ আমীন

অংশীদারত্ব ও অংশীদারিত্ব কোনটি সঠিক

অংশ থেকে অংশী, ‘অংশী’ থেকে ‘অংশীদার’, ‘অংশীদার’ থেকে ‘অংশীদারি’ ও ‘অংশীদারত্ব’ এবং বলা হয় ‘অংশীদারি’ থেকে ‘অংশীদারিত্ব’। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে ‘অংশীদারি’ শব্দের অর্থই অংশীদারত্ব, সেখানে ‘অংশীদরিত্ব’ শব্দটি কি বাহুল্য নয়?  এবার দেখা যাক শব্দগুলোর অর্থ, ব্যুৎপত্তি এবং প্রায়োগিক উপযোগিতা।

বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত অংশ (√অন্‌শ্‌+অ) শব্দের অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। তবে আলোচ্য প্রবন্ধের জন্য প্রযোজ্য অর্থসমূহ হচ্ছে ভাগ, অঞ্চল,

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

মালিকানা প্রভৃতি। বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত অংশী (অন্‌শ্‌+ইন্) শব্দের অর্থ: অংশ আছে এমন, অংশবিশিষ্ট প্রভৃতি।‘অংশ’ এবং ‘অংশী’ সংস্কৃত হলেও ‘অংশীদার’ ও ‘অংশীদারি’ সংস্কৃত নয়। কারণ ‘অংশী’ শব্দের সঙ্গে যথাক্রমে ফারসি ‘দার’ ও ‘দারি’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘অংশীদার’ ও ‘অংশীদারি’ শব্দ দুটি গঠিত হয়েছে।

বাংলা একডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ফারসি অংশীদার শব্দের অর্থ সম্পত্তি বা ব্যবসায়ে যার অংশ আছে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘partner’। কোনো অংশে বা বিষয়ে যার ভাগ আছে তিনিই অংশীদার বা পার্টনার এবং অংশীদারের পদ, মর্যাদা, কাজ বা গুণ কিংবা মালিকানা অর্জনের হেতৃত্ব প্রভৃতিই হচ্ছে অংশীদারত্ব। অন্যদিকে বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত ফারসি অংশীদারি শব্দের অর্থ মালিকানা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘partnership’। মালিকানা বা পার্টনারশিপ নিজেই অংশীদারের একটি কাজ বা গুণ তথা অংশীদারত্ব। সুতরাং এর সঙ্গে পুনরায় ত্ব যুক্ত করা অনাবশ্যক।

এ বিষয়ে প্রচলিত অভিধান কী বলে তা দেখা যাক। ভারত থেকে প্রকাশিত ‘আকাদেমি বানান অভিধান (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, চতুর্থ সংস্করণ, ২০০৩)’ এবং অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘সংসদ বানান অভিধান [পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ ২০০৯-এর তৃতীয় মুদ্রণ ২০১৩]’- দুটি অভিধানেই কেবল অংশীদারিত্ব শব্দটি পাওয়া যায়, কিন্তু ‘অংশীদারত্ব’ শব্দটি ওই দুটি অভিধানে রাখা হয়নি।

 অন্যদিকে, ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণের বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান [প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ১৯৯২] বা ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণের বাংলা একাডেমি বাঙলা উচ্চারণ অভিধান [পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৯৯)] বা ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণের বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান [দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯২-এর পরিমার্জিত সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০০] বা ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণের বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধান [পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৮] বা ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের সংস্করণের বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান [প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৬; পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ: এপ্রিল ২০১৬]- এই অভিধানগুলোর  কোনোটাতে- ‘অংশীদারত্ব’ বা ‘অংশীদারিত্ব’ শব্দ পাওয়া যায় না। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসও তাঁর অভিধানে শব্দদুটোর একটিকেও স্থান দেননি। রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’তেও শব্দদুটো পাওয়া যায়নি।

আমরা সাধারণত বাংলা একাডেমির অভিধান অনুসরণ করি, কিন্তুে একাডেমির বাংলা অভিধানসমূহে অংশীদারত্বআংশীদারিত্ব শব্দ নেই। সে হিসেবে ধরে নিতে হয়, অংশীদারত্ব এবং অংশীদারিত্ব উভয় শব্দই অপ্রমিত বা ভুল বা অস্তিত্বহীন। কিন্তু তা নয়, অভিধানে কোনো শব্দ না-থাকলে তা নেই বা ভুল কিংবা অস্তিত্বহীন ধরে নেওয়া সমীচীন নয়। অভিধান একটি দোকানের মতো। একটি দোকানে সব পণ্য রাখা, থাকা বা পাওয়া অসম্ভব। কোনো একটি দোকানে একটি পণ্য নেই- তার মানে এই নয় যে, পণ্যটি অস্তিত্বহীন। মনে রাখতে হবে, বাংলায় চার লাখের অধিক শব্দ আছে, কিন্তু এ পর্যন্ত কেবল চুয়াত্তর হাজারের মতো শব্দ অভিধানভুক্ত করা হয়েছে বা অভিধানে পাওয়া যায়।

বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবাকো), সংস্কার, গবেষণা ও আইন অনুবিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা “সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলা (ব্যবহারিক শব্দকোষ)” নামের একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। এই পুস্তিকায় ‘অংশীদারিত্ব’ শব্দটি রায়েছে। এখানে এই শব্দটির উপস্থিতি যেমন হাস্যকর তেমনি উদ্ভট। কেননা, এই পুস্তিকার শিরোনামের নিম্নে প্রথম বন্ধনী দিয়ে লেখা হয়েছে, বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুসরণে পুস্তিকাটি সংকলিত। আমার দেখলাম, বাংলা একাডেমির সর্বশেষ অভিধানেও অংশীদারিত্ব শব্দটি নেই। তাহলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাবাকো এটি কোথায় পেল? তাদের জন্য কি বাংলা একাডেমি নতুন আইন করেছে? এটি বাবাকোর অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়।  বাবাকোর কোনো পুস্তিকা আমি পড়ি না। কেননা, বইপুস্তক রচনায় তাদের সৃজনশীলতা নকলনবিশের মতো। তাই ওদের সংকলিত পুস্তকে শুদ্ধ কিছু থাকলেও আমার ভুল মনে হয়।

উৎস: কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

#subach

 

Leave a Comment

You cannot copy content of this page