ড্রাইভিং, ড্রাইভিং-লাইসেন্স: ড্রাইভিং-লাইসেন্স সনদ নয় কেন

ড. মোহাম্মদ আমীন

ড্রাইভিং, ড্রাইভিং-লাইসেন্স: ড্রাইভিং-লাইসেন্স সনদ নয় কেন

শঙ্কাবহুল সড়ক ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলনকালীন কিছু কিছু শিক্ষার্থীর লাইসেন্স-চেক, তাদের একাজে জনগণের বাহবা-প্রদান দেখে মনে হয়েছে, লাইসেন্সই যেন দক্ষতার একমাত্র নিয়ামক এবং লাইসেন্স যাদের আছে তারা সবাই দক্ষ চালক। ড্রাইভারের জন্য লাইসেন্স প্রয়োজন কিন্তু ড্রাইভ করার জন্য প্রয়োজন নেই। কেবল লাইসেন্স থাকলে গাড়ি ড্রাইভ যায় না, ড্রাইভিং জানা আবশ্যক। ড্রাইভিং জানলে লাইসেন্স ছাড়াও গাড়ি চালানো যায়। এ ড্রাইভিংকে বলা হয় অবৈধ ড্রাইভিং এবং চালককে বলা হয় অবৈধ ড্রাইভার। লাইসেন্সের আগে আরো অনেক গুরুত্ববহুল বিষয় আছে।গাছ রোপন করা সন্তোষজনক ফল পাওয়ার একমাত্র পূর্বশর্ত নয়।তাকে যথানিয়মে পরিচর্যায় নিয়ে আসতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়কে বাদ দিয়ে নিরাপদ সড়ক দাবি হঠাৎ করে ‘শঙ্কামুক্ত সড়ক চাই’ থেকে ‘ কাগুজে লাইসেন্স চাই’ ( কালাচা) দাবিতে পরিণত হলো। কেবল সনদ যেমন ঋদ্ধতার পূর্বশর্ত নয়, তেমনি কেবল লাইসেন্সও গাড়িচালানো-সংক্রান্ত দক্ষতার পূর্বশর্ত নয়। যত ভালো সনদই থাকুক না কেন, অভিজ্ঞতা না-থাকলে কাউকে প্রথম দিনে প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় না, রাতারাতি অফিসের কর্তা বানিয়ে দেওয়া হয় না। সনদ কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে ব্যক্তিবিশেষর আইনগত বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রমাণক।

লাইসেন্স, শঙ্কামুক্ত সড়ক প্রতিষ্ঠায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। যদিও এটা শিক্ষণের একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রমাণ কিন্তু আমাদের দেশের বিদ্যমান ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান ব্যবস্থায় না শিখেও এটি সংগ্রহ করা যায়, বাজারে নকল লাইসেন্সের ছড়াছড়ি; নকল লাইসেন্সধারী ড্রাইভারগণ কিন্তু নকল গাড়ি চালান না, যান্ত্রিক গাড়ি চালান। অতএব লাইসেন্স দক্ষতার পূর্বশর্ত নয়। যে কেউ লাইসেন্স রাখতে পারেন, লাইসেন্সের অধিকারী হতে পারেন কিন্তু গাড়ি চালাতে হলে প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। লাইসেন্স কাউকে দক্ষতা দিতে পারে না। লাইসেন্স আইনগত অধিকার দিতে পারে কিন্তু দক্ষতা অর্জন করতে হলে প্রয়োজন কার্যকর অনুশীলন। অনুশীলনে দক্ষত অর্জনে আইনগত অধিকার প্রয়োজন নেই। বন্দুকের লাইসেন্স অনেকের আছে কিন্তু চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। বৈধ লাইসেন্সধারীর চেয়ে অবৈধ বন্দুকধারীরা ভালো বন্দুক চালাতে পারে। সুতরাং লাইসেন্স অধিকার দিলেও দক্ষতা দেয় না।

ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যক্তির গাড়ি চালানোর আইনগত অধিকারের প্রমাণক, দক্ষতার প্রমাণক নয়। অতএব লাইসেন্স দিয়ে সড়কে নিরাপত্তা আনা যাবে না। সড়ক নিরাপত্তার জন্য আরো অনেক বিষয়ের সুষ্ঠু সমন্বয় প্রয়োজন। এমন অনেককে জানি যারা ড্রাইভিং জানেন না বলেই চলে কিন্তু তাদের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। আবার এমন অনেক লোক আছেন, যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কিন্তু কখনো ড্রাইভ করেননি।

দেশেবিদেশে বাংলাদেশি চল্লিশ লাখ চালক আছে। তাদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা খুবই কম। দেশে চালক প্রযোজন প্রায় ত্রিশ লাখ। কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। লাইসেন্স দেয় বিআরটিএ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ড্রাইভার নিজে নিজের তাগিদে, নানাভাবে। বিআরটিএ শুধু সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাইসেন্স নামের একটি কাগজ দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে, কিন্তু ড্রাইভিং শেখানো কিংবা পরবর্তীকালে তাদের প্রশিক্ষণের অবস্থা সম্পর্কে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা বিআরটিএ বা সরকারের নেই। বিআরটিএ-র কাজ শুধু লাইসেন্স দেওয়া। কিন্তু যাদের লাইসেন্স দেওয়া হলো তাদের কে শেখালো কোন পরিবেশে এবং কীভাবে শিখল; অতঃপর তাদের কী অবস্থা হলো এসব কেউ দেখে না। এটি একটা উদ্ভট বিষয়, আপনি কাজ শিখলেন এক জায়গায় আর আপনাকে সনদ দিচ্ছে আর একজন।তাহলে যারা মাস্টার্স পাস করেন, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হন তাদের ক্ষেত্রেও ড্রাইভারের মতো শিক্ষণ ও সনদ রীতি চালু করা যায়। তারা কারো কাছে শিখবেন এবং একদিন গিয়ে কোনো ইউনিভার্সিটি থেকে ড্রাইভারের মতো সনদ নিয়ে নেবেন।

আকাশে পাইলট, জলে ক্যাপ্টেন এবং সড়কে ড্রাইভার- তিন জনই জীবনমরণ পেশায় নিয়োজিত। পেশা হিসেবে ড্রাইভিং মানুষ-সহ সকল জীবন ও সম্পদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাটিতে ড্রাইভিং পেশার চেয়ে জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক, কৌশলনির্ভর এবং তাৎক্ষণিক স্পর্শকাতর পেশা আর নেই। তাদের ওপর একটি জাতির পুরো পরিবহণ ও সড়ক যোগাব্যবস্থার কার্যকর সাবলীলতা নির্ভরশীল। তারা দেশের আর্থ-সামাজিক-পরিবহণ ব্যবস্থায় এতই গুরুত্বপূর্ণ, যেমন দেহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রক্তপ্রবাহক। শিরাউপশিরা যেন সড়ক। তা যদি ঠিক না হয় তাহলে শুধু প্রবাহক কীভাবে কার্যকরভাবে রক্তরাশি দেহেরে বিভিন্ন অংশে পৌঁছে দেবে? বিষয়টা আমার এড়িয়ে যাই। শুধু দোষ দিই ড্রাইভারদের উপর কিন্তু সড়কের দিকে খেয়াল দিই না।

সম্প্রতি দুই শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হবার পর আন্দোলন শুরু হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রীর হাসি পেয়ে আন্দোলন বেগবতী হয়ে ওঠে। দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে ড্রাইভার, লাইসেন্স দিয়েছে বিআরটিএ, রাস্তা নির্মাণ করেছে সওজ, ফুটপাত নির্মাণ করেছে সিটি কর্পোরেশন- এসব কাজের কোথাও পুলিশের সংশ্লিষ্টতা ছিল না, পুলিশ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধাও দেয়নি। প্রথম কয়েক দিন আন্দোলনকারীদের ওপর কোনো নির্যাতনও করেনি। তারপরও হঠাৎ শিক্ষার্থীরা পুলিশের বিরুদ্ধে অশালীন ভাষায় লেখা প্ল্যাকার্ড বহন শুরু করল। তাদের কালাচা আন্দোলন পুবি (পুলিশ বিরোধী) আন্দোলনে পরিণত হলো। এমন পরিকল্পনাবিহীন আন্দোলন দেশের জন্য ক্ষতিকর। যাই হোক, আবার আগের কথায় ফিরে আসি।

ড্রাইভিং শুধু অতি স্পর্শকাতর এবং কৌশলভিত্তিক পেশা মাত্র নয়। এদের কাজ ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারের চেয়েও স্পর্শকাতর এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াবহুল। ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তারদের সনদ দেওয়া হয়, নার্স, প্যারামেডিক্সদেরও সনদ দেওয়া হয়; কিন্তু ড্রাইভারদের লাইসেন্সকে সনদ বলা হয় না, বলা হয় লাইসেন্স। ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক্স প্রভৃতি বানানোর জন্য দেশে অনেকগুলো আদর্শ মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে সরকার নানাভাবে ভর্তূতি দিয়ে থাকে। কিন্তু ড্রাইভারদের জন্য এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। অথচ এর চেয়ে কম ঝুুঁকিপূর্ণ পেশা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইতিহাস পড়লেও সনদ মেলে কিন্তু ড্রাইভিং শিখলে লাইসেন্স।এটি ড্রাইভারদের প্রতি এবং তাদের পেশার একপ্রকার অবহেলা বলা যায়।

প্রথম আলোর একটা খবরে দেখা যায়, দেশে চার লাখ ঊনত্রিশ হাজার ড্রাইভার গাড়ি চালান কিন্তু লাইসেন্স মাত্র বারো লাখ। এককভাবে বিআরটিএ-র পক্ষে এতগুলো ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া সম্ভব নয়। লাইসেন্স নিতে কী পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয় তা ভুক্তভোগীমাত্রই অবগত। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, বিআরটিএ যে পদ্ধতিতে লাইসেন্স দিয়ে থাকে, তা আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় অকার্যকর, ধীর এবং অনিরাপদ। বিদ্যমান ব্যবস্থায় কিছু টাকা খরচ করলে যে কেউ লাইসেন্স পেয়ে যেতে পারে।

ড্রাইভিং ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ারের মাতো এক ধরনের শিক্ষা। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ করবে? দেশের সব ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার সনদ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত নির্ধারিত সময় ও পাঠ্যসূচির আলোকে প্রদান করা হয়। ড্রাইভিং-এর ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা পরিচালনা করা আবশ্যক। জেলায় জেলায় ড্রাইভিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করা তেমন ব্যয়বহুল কিছু নয়। এজন্য প্রথমে ড্রাইভিংকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষামন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। তাদের শিক্ষণ-প্রমাণকের নাম লাইসেন্স- এর পরিবর্তে সনদ নামে আখ্যায়িত করা প্রয়োজন। তাহলে তারা নিজেদেয়ে মর্যাদাশীল মনে করবেন, বৃদ্ধি পারে সচেতনতা। ড্রাইভিং পেশায় শৃঙ্খলা ও আদর্শ মান প্রতিষ্ঠিত হবে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থাও তেমন ভালো না। তবু মন্দের ভালো হিসেবে এটি করা উচিত। তাই প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসেবে ড্রাইভিংকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় হতে সরিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা উত্তম। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অন্যান বিশেষায়িত বিষয়ের মতো ড্রাইভিং সনদ দেওয়ার জন্য উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে। কিংবা পলিটেকনিক প্রতিষ্ঠানসমূহে ড্রাইভিং শাখা খুলে নিয়মিত অধ্যয়নপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে ড্রাইভিং সনদকে অন্যান্য শিক্ষাসনদের মর্যাদায় উপনীত করবে। অন্যান্য শিক্ষা বা পেশার মতো ড্রাইভারদেরও একটি সনদ থাকবে। অথবা, ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মতো একটি ড্রাইভিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়।

ড্রাইভারের কারণে কেউ মারা গেলে তার মৃত্যুদণ্ড দাবি করা হয় কিন্তু তাদের কীভাবে দক্ষ করে তোলা যায়, তা নিয়ে কেউ উচ্চাবচ্য করে না। বলা হয়, লাইসেন্স নেই কিন্তু যাদের লাইসেন্স আছে তারা কীভাবে লাইসেন্স নিয়েছেন, দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণ নিয়ে বিশ্লেষণ নেই। আমরা ড্রাইভারদের সনদ দিই না, লাইসেন্স দিই। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার দুর্ঘটনা ঘটালে তাদের প্রকৃতপক্ষে কোনো দণ্ডই দেওয়া হয় না। প্রতিবছর আট হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এতে কারা কত দায়ী সে বিতর্কে যাচ্ছি না। শুধু এটাই বলতে চাইছি, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের অবহেলায় এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা যায়, অথচ তাদের আছে মর্যাদকর সনদ আছে। আছে, সরকারি ভর্তূকিতে প্রাপ্ত দীর্ঘ প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন ও সনদ। ড্রাইভারের কর্মপ্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক এবং সরাসরি বলে তা আমাদের এমন উত্তেজিত করে তোলে। অন্যদিকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মপ্রতিক্রিয়া পরোক্ষ বলে তাদের বিরুদ্ধে অত সোচ্চার হওয়ার হেতু খুঁজে পাই না।

ড্রাইভারের কাছ থেকে আমরা শতভাগ পেশাগত দক্ষতা আশা করি। কিন্তু তাদের দক্ষতাকে শতভাগ কার্যকর করে তোলার জন্য যে উপযুক্ত সড়ক, জন সচেতনতা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, শিক্ষা প্রভৃতিও অনিবার্য তা সচেতন বা অবচেতনভাবে এড়িয়ে যাই। অধিকন্তু ড্রাইভারদের মর্যাদাও সন্তোষজনক নয়। তাদের কাজ থেকে যে পরিমাণ দক্ষতা আশা করা হয়, তাদের দক্ষ করে তুলতে তার সহস্রাংশ প্রয়াসও দেখা যায় না। কাউকে দক্ষ করে তোলার জন্য আবশ্যক উপাদানে ভূষিত না করে তার কাছ থেকে দক্ষতা আশা করো সমীচীন নয়। আমাদের উচিত ড্রাইভারদের কাছ থেকে দক্ষতা আশা করার আগে তাদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য অন্যান্য পেশার মতো একটি কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ড্রাইভিং শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

চোখ মারা, পকেট মারা এবং গণপিটুনি

চার: চার সংখ্যার জাদু, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে চার সংখ্যার প্রভাব

#subach

You cannot copy content of this page