নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে

ড. মোহাম্মদ আমীন

নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে

নিথুয়া শব্দের অর্থ কী? শব্দের অর্থ বলা কঠিন। কেননা, বাক্যে বসে কোনো শব্দ পদে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত তার অর্থ নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কেননা, বাক্যই শব্দের প্রায়োগিক রূপ তথা পদের অর্থকে পদার্থে গিয়ে সুনির্দিষ্ট করে দেয়। সর্ববোধ্য ও বহুল প্রচলিত ‘বলি’ শব্দ দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া যায় : “বুড়ো বলীর বলি দেখে বলি/ জীবনটা বলি ছেড়া, সময়ের বলি।”

ছড়ার লাইন দুটোয় একটি ‘বলী’ ও চারটি ‘বলি’ আছে। এবার দেখুন এদের অর্থ- প্রথম বলী শব্দের অর্থ: বলবান বা শক্তিশালী; দ্বিতীয় বলি শব্দের অর্থ: চামড়ার

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

কুঞ্চন রেখা; তৃতীয় বলি শব্দের অর্থ; বলা, উচ্চারণ করা; চতুর্থ বলি শব্দের অর্থ: কানের মাকড়ি বা অলঙ্কার এবং পঞ্চম বলি শব্দের অর্থ: যজ্ঞাদিতে নিবেদনযোগ্য বস্তু বা হত্যাযোগ্য জন্তু। সুতরাং, কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে ‘বলি’ অর্থ কী, তো আমি কী জবাব দেব? সেক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য সবগুলো অর্থ বলে যেতে হবে। অতএব, একটা বিষয় পরিষ্কার যে, শব্দের সুনির্দিষ্ট অর্থ জানতে হলে তা বাক্যসহ উপস্থাপন বাঞ্ছনীয়। কারণ পদের অর্থ সুনিদিষ্ট, শব্দের অর্থ নয়। একটি শব্দ বাক্যে বসে অনেক অর্থে দ্যোতিত হতে পারে। শব্দকে একটি ধাতু (যেমন লোহা) হিসেবে কল্পনা করুন। একটি ধাতু দিয়ে অনেক বস্তু তৈরি করা যায়; কিন্তু পদ হচ্ছে ওই ধাতু দিয়ে তৈরি নির্দিষ্ট কোনো বস্তু। এবার নিথুয়া শব্দের প্রয়োগ-সাপেক্ষে অর্থ কী দেখা যাক। কবি লিখেছেন এবং গায়ক গেয়েছেন:

“নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে
ধর বন্ধু আমার কেহ নাই
তোল বন্ধু আমার কেহ নাই
চিকনো ধুতিখানি পরিতে না জানি
না জানি বান্ধিতে কেশ,
অল্প বয়সে পিরীতি করিয়া
হয়ে গেল জীবনেরও শেষ
প্রেমেরও মুরলি বাজাতে নাহি জানি
না পারি বান্ধিতে সুর।”

এবার এই গানে বর্ণিত ‘নিথুয়া’ শব্দের অর্থ কী দেখে নিই। ‘’নিথুয়া শব্দটি বাংলা একাডেমির কোনো অভিধানে নেই। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থেও পাইনি। বিশ্বনাথ জোয়ারদারের ‘অচলন্তিকা’তেও  দেখলাম না। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলা একাডেমী বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান গ্রন্থেও শব্দটি স্থান পায়নি। অথচ, এটি তত অপরিচিত শব্দ নয়। ধারণা করা হয় ‘নিথুয়া’ একটি বহুল প্রচলিত আঞ্চলিক শব্দ, কালক্রমে যার ব্যবহার বিরল হয়ে গিয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সংগ্রামমুখর জীবনে অথই, নিথুই, নিথুয়া, নিদয়, নিধুয়া শব্দসমূহ লোকগীতি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছেও বহুল পরিচিত ছিল। ‘নিথুয়া’ শব্দটি এসব শব্দেরই প্রতিনিধি।

অনেকগুলো প্রাচীন অভিধান ও গ্রন্থ  ঘেঁটে আমি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, তা হচ্ছে – “থুয়ে (থুয়ে : অক্রি রেখে) থেকে থুয়া শব্দের উদ্ভব। এ থুয়া শব্দের সঙ্গে ‘নি-’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে নিথুয়া (নি+থই+আ>নিথুয়া ) নিতুয়া বা নিধুয়া শব্দ গঠিত হয়েছে। এর সম্প্রসারিত এবং প্রায়োগিক অর্থ : যে কোনো কিছু থুয়ে (রেখে) যায় না, যার পেটে পতিত হলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে না, বিশাল নির্জন প্রান্তর, নিষ্ঠুর, সর্বনাশা, যার ক্ষুধার অন্ত নেই, ভয়ের স্থান প্রভৃতি। আবার এও মনে করা হয়, নিষ্ঠুর অর্থে ব্যবহৃত আঞ্চলিক ‘নিদয়’ শব্দ থেকে ‘নিথয়/নিতয়/’ এবং তা থেকে ‘নিথুয়া/নিতুয়া, নিধুয়া’ শব্দের উদ্ভব। যার অর্থও নিথুয়া শব্দের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। আর একটি উৎস হতে পাওয়া যায়, ‘থই’ শব্দের সঙ্গে ‘নি-’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে ‘নিথই’ এবং তা থেকে ‘নিথুয়া/নিধুয়া’ শব্দের উদ্ভব। সেক্ষেত্রে ‘নিথুয়া’ শব্দের অর্থ হয় অথই, তলহীন, অতল প্রভৃতি। দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় দেখতে পাই, ‘নিথুয়া’ শব্দের অর্থ নেই থই যার এবং প্রথম ব্যাখ্যায় পাই ‘নিথুয়া’ অর্থ থুয়ে না যাওয়া। অনেকে মনে করেন, শব্দটির বানান ‘নিতুয়া’, যেটিই হোক- অর্থ কিন্তু অভিন্ন। এবার গানের কথার সঙ্গে এবার অর্থগুলো মিলিয়ে নিতে পারি:

নিথুয়া পাথারে, নেমেছি বন্ধুরে
ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই।
তোল বন্ধু আমার কেহ নাই।
অর্থাৎ আমি অথই/ নিষ্ঠুর/তলহীন সাগরে/ জনমানবহীন প্রান্তরে নেমেছি/পড়েছি, বন্ধু আমাকে ধরো, সাহায্য করো আমার কেউ নেই, বন্ধু আমাকে তোলো (আমি ডুবে যাচ্ছি/ আমি হারিয়ে যাচ্ছি), আমার একমাত্র ভরসা তুমি, আমার ( একমাত্র তুমি ছাড়া) কেউ নেই।

উৎস: বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।

#subach

Leave a Comment

You cannot copy content of this page