বাংলা শব্দের উৎস ও উৎপত্তি: বাংলায় কোন কোন দেশের শব্দ আছে, বাংলায় বিদেশি শব্দ কয়টি

বাংলা শব্দের উৎস ও উৎপত্তি: বাংলায় কোন কোন দেশের শব্দ আছে, বাংলায় বিদেশি শব্দ কয়টি

ড. মোহাম্মদ আমীন

বাংলা শব্দের উৎস উৎপত্তি

উৎস বা উৎপত্তি বা অবস্থান অনুসারে বাংলা ভাষার শব্দসমূহকে  ৮ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:  () তৎসম, () অর্ধতৎসম, () তদ্ভব, () খাঁটি বাংলা, () দেশি,  () বিদেশি, () মিশ্র  এবং () বাংলা

. তৎসম শব্দ: বৈয়াকরণগণ  বাংলায় এমন কিছু শব্দ চিহ্নিত করেছেন,  যা তাঁদের ধারণামতে,  সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহৃত হতো এবং এখন কোনো পরিবর্তন না হয়ে অবিকল বাংলা ভাষায় বাংলার নিজস্ব শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সে সব শব্দকে বলা হয় তৎসম শব্দ। যেমন: চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম,পাত্র, মনুষ্য, নীর, মুমূর্ষু, দীন, হীন প্রভৃতি। ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের মতো, বাংলায় তৎসম শব্দের সংখ্যা ২৫%। বর্তমানে অভিধানভুক্ত মোট শব্দ ,৬০,০০০ ধরলে বাংলায় ব্যবহৃত তৎসম শব্দের মোট সংখ্যা হয় ৪০ হাজার।

. অর্ধতৎসম শব্দ বৈয়াকরণগণ বাংলায় এমন কিছু শব্দ চিহ্নিত করেছেন,  যা তাঁদের ধারণামতে বা আন্দাজি উৎস হতে গৃহীত তথ্যানুযায়ী সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহৃত হতো। এখন  আংশিক পরিবর্তন হয়ে  বাংলা ভাষায় বাংলার নিজস্ব শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদেরভাষায় সেসব অর্ধতৎসম। যেমন: জ্যোৎস্না>জ্যোছনা, শ্রাদ্ধ>ছেরাদ্দ, গৃহিণী>গিন্নী, বৈষ্ণব>বোষ্টম, কুৎসিত>কুচ্ছিত, মন্ত্র>মন্তর। অনেক মনে করেন, অর্ধ-তৎসম  বাংলা ভাষারই শব্দ। সংস্কৃত ভাষায় এই বাংলা শব্দগুলো কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে গৃহীত হয়েছে। বাংলা  শব্দভান্ডারের অর্ধ-তৎসম হিসেবে চিহ্নিত শব্দের সংখ্যা ৫%। অভিধানভুক্ত মোট শব্দ ,৬০,০০০ (২০০ মিশ্র শব্দসহ ,৬০,২০০) ধরলে বাংলায় ব্যবহৃত অর্ধতৎসম শব্দের সংখ্যা হয় হাজার।

. তদ্ভব শব্দ:  বৈয়াকরণগণের মতে, বাংলায় এমন কিছু সংস্কৃত শব্দ আছে, যা তাঁদের ধারণামতে বা আন্দাজি উৎস হতে গৃহীত তথ্যানুযায়ী সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহৃত হতো। যেগুলো  প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে পরিবর্তন হয়ে বাংলা ভাষায় নিজস্ব শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক মনে করেন, এগুলো আসলে বাংলা ভাষারই শব্দ। সংস্কৃত ভাষায় এই বাংলা শব্দগুলো পরিবর্তিত হয়ে গৃহীত হয়েছে। সংস্কৃত বৈয়াকরণগণ বাংলা শব্দগুলোকে সংস্কৃত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বৈয়াকরণদের ভাষায় এগুলো  তদ্ভব শব্দ। যেমন: সংস্কৃত ‘হস্ত’ শব্দটি প্রাকৃততে ‘হত্থ’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর বাংলায় এসে সেটা আরো সহজ হতে গিয়ে হয়ে গেছে ‘হাত’ চন্দ্র>চন্দ>চাঁদ, গ্রাম>গাও>গাঁ, দধি>দহি>দই। প্রকৃতপক্ষে অর্ধ-তৎসম আর তদ্ভব প্রায় অভিন্ন।  অভিন্ন না হলেও ভিন্ন করার সুযোগ কম। যা করা হচ্ছে তা আন্দাজে, কোনোরূপ উৎসপ্রমাণ ছাড়া। বাংলায় তদ্ভব হিসেবে চিহ্নিত শব্দের সংখ্যা প্রায় ৬০%।  অভিধানভুক্ত মোট শব্দ ,৬০,০০০ ধরলে বাংলায় ব্যবহৃত  তদ্ভব শব্দের সংখ্যা  প্রায়  ৯৬ হাজার।

. খাঁটি বাংলা শব্দ:  ওপরের ২ ও ৩ নম্বরে অনুচ্ছেদে বর্ণিত অর্ধতৎসম ও তদ্ভব শব্দকে একত্রে খাঁটি বাংলা শব্দ বলা হয়।

.দেশি শব্দ: বৈয়াকরণগণ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত এমন কিছু শব্দ চিহ্নিত করেছেন যেগুলো তাঁদের মতে, বাংলাভাষী অঞ্চলের আদিবাসীদের ভাষায় ব্যবহৃত হতো। তারা সেসব শব্দকে দেশি  শব্দ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন: কুড়ি (বিশ)- কোলভাষা, পেট (উদর)- তামিল ভাষা, চুলা (উনুন)- মুণ্ডারী ভাষা; কলু (সাঁওতালি) প্রভৃতি। এরূপ দেশি হিসেবে চিহ্নিত শব্দের সংখ্যা মোট শব্দের  ২%। বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারে মোট শব্দের সংখ্যা ১,৬০,০০০ ধরলে দেশি শব্দের সংখ্যা  ,২০০।

. বিদেশি শব্দ: প্রকৃতপক্ষে ‘বিদেশি শব্দ’ কথাটির ব্যবহার ভাষার জন্য যথার্থ মনে হয় না। এটি একটি অসার, বলা যায় অবৈজ্ঞানিক কথা। একটি ভাষা থেকে সব ভাষাগোষ্ঠী এবং ভাষাসমূহের সৃষ্টি। সুতরাং, কোনো ভাষার কোনো শব্দই বিদেশি নয়। অঞ্চল ও ভাষাভাষীভেদে সংগত ও অনিবার্য রূপান্তর মাত্র। তারপরও বৈয়কারণগণ ভাষা, শব্দ, ব্যাকরণ প্রভৃতি নিয়ে মূলত গবেষণা করার সুবিধার্থে বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারকে নানাভাবে ভাগ করেছেন। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে: উৎস বা উৎপত্তি অনুসারে শ্রেণিবিভাগ। প্রকৃতপক্ষে এই উৎপত্তি বা বিভাজন মনুষ্য ভাষার উদ্ভব বা সৃষ্টি বিবেচনায় হাস্যকর ও ভিত্তিহীন। তবু দীর্ঘদিন হতে  জেনে আসা বড়ো বড়ো বৈয়াকরণ বা ভাষাগদের (ভাষা গবেষক) আমরা অবহেলা করতে পারছি না।

সংস্কৃত এবং আদি হতে বঙ্গদেশে প্রচলিত থাকার কারণে দেশি হিসেবে  চিহ্নিত শব্দ ছাড়া বাংলায় ব্যবহৃত অন্যান্য  শব্দকে বিদেশি শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলায় মোট শব্দের ৮% শব্দকে বিদেশি  হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলায় অভিধানভুক্ত মোট শব্দ ১,৬০,০০০ ধরলে মোট বিদেশি শব্দ প্রায় ১২,৮০০। বিদেশি হিসেবে আখ্যায়িত এই ১২,৮০০ শব্দকে ৪৩টি ভিন্ন ভাষা হতে আগত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলায় চিহ্নিত এই ৮% বিদেশি ভাষা যে ৪৩টি দেশ হতে এসেছে বলা হচ্ছে সে ভাষাসমূহের  নাম নিচে দেওয়া হলো:

অহমিয়া,                 আরবি,                    আইরিশ,      আফ্রিকান,     আবৈশ,

 

ইতালিয়ান,             ইনুয়িটি (এস্কিমে),      ইংরেজি,       উর্দু               উড়িয়া,

 

ওলন্দাজ                গুজরাতি                   গ্রিক            চীনা              চেক

 

ভাষা                      জর্মন,                      জাপানি,       জুলু               ডেনিশ,

 

তামিল                   তিব্বতি                     তুর্কি,           তেলেগু          নেপালি

 

পঞ্জাবি                   পোর্তুগিজ                ফরাসি         ফারসি            ফ্লেমিশ,

 

বর্মি                        বাহ্‌সা মালয়েশিয়া    মরাঠি         মালয়ি            মালয়ালম

 

যবদ্বীপ                 রুশ                           লাতিন        লাপ্পিশ          সিংহলি

 

স্ক্যান্ডেনেভিয়ান,     স্প্যানিশ                   হিন্দি। (মোট ৪৩)

 

আবৈশ: আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক শব্দাবলি।

ফ্লেমিশ: ফ্লেমিশ ভাষা উত্তর বেলজিয়ামের ঐতিহাসিক ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলে প্রচলিত ভাষা। এটি ওলন্দাজ ভাষার একটি স্থানীয় রূপ। বেলজিয়ামের বাইরে নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণাংশে এবং উত্তর ফ্রান্সের কিছু এলাকাতে ভাষাটি প্রচলিত। বেলজিয়াম নেদারল্যান্ডসের সরকার ভাষাটিকে সরকারিভাবে ওলন্দাজ ভাষা হিসেবে গণ্য করে।

লাপ্পিশ: ফিনল্যান্ডীয়

যবদ্বীপ: জাভা; যবদ্বীপের অধিবাসীর ভাষা।

. মিশ্র শব্দ: একাধিক ভিন্ন উৎসের শব্দ নিয়ে গঠিত শব্দকে  মিশ্র শব্দ বলা হয়। যেমন: খ্রিষ্টাব্দ (ইংরেজি+তৎসম), রাজা-বাদশা (তৎসম+ফারসি), হাট-বাজার (বাংলা+ফারসি), হেড-মৌলভি (ইংরেজি+ফারসি), হেড-পণ্ডিত (ইংরেজি+তৎসম),  ডাক্তারখানা (ইংরেজি+ফারসি), পকেটমার (ইংরেজি+বাংলা) প্রভৃতি।  মিশ্র শব্দের সংখ্যা অসংখ্য হতে পারে। তবে দুইয়ের অধিক ভাষা হতে আগত শব্দ সমন্বয়ে গঠিত শব্দের সংখ্যা প্রায় ২০০। এগুলোকে বাকি অন্যান্য উৎসের শব্দ হতে বাইরে  রেখে হিসাব করা হয়েছে।

. বাংলা শব্দ:  বাংলা শব্দ আসলে ওপরে বর্ণিত সবগুলো উৎস হতে প্রাপ্ত শব্দের মিলন। পূর্বে বলা হয়েছে,   একটি ভাষা থেকে সব ভাষার সৃষ্টি। বৈয়াকরণগণ উৎস অনুসারে ভাষার যে বিভক্তি দেখান তা স্বল্প সময় পরিধির একটি অনুমান। বাংলায় ব্যবহৃত সব শব্দই বাংলা। যে উৎসের শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করা হোক না, বাংলায় ব্যবহৃত এবং  বাংলাভাষী জনগণের কাছে সাধারণ বিবেচনায়  যে রূপে আর যে অর্থে পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত তাকে বাংলা শব্দ বলা হয়। উপরে বর্ণিত উৎসমূহের প্রত্যেকটি শব্দ বাংলা শব্দ। যেমন: চেয়ার, টেবিল, দৌলত, আনারস, কার্তুজ, খদ্দর, চাহিদা, চাকর, চা, ফুঙ্গি, রিকশা, ইন্টারনেট, কী-বোর্ড প্রভৃতি। এসব শব্দের প্রতিশব্দ বা পরিভাষাও থাকতে পারে। বিভিন্ন গবেষকগণ বাংলা ভাষায় শব্দের সংখ্যা সম্পর্কে ভিন্ন মত প্রদান করেছেন।  সবচেয়ে গ্রাহ্য মত হচ্ছে বাংলা শব্দ ভান্ডারে মোট শব্দ সংখ্যা: ১,৬০,০০০ এবং ২০০ মিশ্র শব্দ-সহ ১৬০,২০০০। তবে ড.  এনামুল হকের মতো, অভিধানভুক্ত শব্দ ১,২০,০০০। তিনি যখন হিসেব দিয়েছিলেন তখন, অভিধানে ওই পরিমাণই শব্দ ছিল। এখনও আরো বেড়েছে।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page


Casibom