বাংলামি বনাম ইতরামি: বাংলামি সমাচার: বাংলামি কথার অর্থ

বাংলামি বনাম ইতরামি: বাংলামি সমাচার: বাংলামি কথার অর্থ

ড. মোহাম্মদ আমীন 

শব্দার্থ পুরোই প্রচলন-নির্ভর। এটি রাতারাতি তৈরি করে ভাষাভাষীদের দিকে ছুড়ে দেওয়া কোনো বিষয় নয়। দীর্ঘকালের প্রচলন-প্রয়োগই শব্দের অর্থ নির্ধারণ করে। এইভাবে গড়ে উঠেছে ভাষা, ভাষার শব্দ, শব্দের অর্থ এবং বাক্য ও প্রয়োগ-বিধি। প্রচলনসমূহ ভাষাবিধি বা ব্যাকরণ বা অভিধানে ভুক্ত হলে তা ওই ভাষার জন্য আদর্শ বা প্রমিত বা সর্বজনীন বা বোধ্য হয়ে যায়। একটি শব্দ যে অর্থ প্রদান করে তা দীর্ঘকালের প্রয়োগ-ফসল বই কিছু নয়। ওই শব্দ বাক্যে ব্যবহৃত হলে দীর্ঘ প্রচলন হতে প্রাপ্ত মূর্ত-বিমূর্ত যে ধারণা আমাদের চেতনায় উদ্ভাসিত হয় তাই শব্দার্থ। কেউ যদি দীর্ঘ ব্যবহারে নির্ধারতি অর্থের ‘গিধড়’ নামে মূর্ত প্রাণীটিকে ‘বাঘ’ অর্থে ব্যবহার করতে চায় তা গ্রাহ্য হবে না, বরং অর্থহীন ও হাস্যকর হয়ে যাবে। ‘বাংলামি’ শব্দে এমনটি করা হয়েছে। ‘আমি’ প্রত্যয়টি বাংলা ব্যাকরণ ও প্রচলন/প্রয়োগে সাধারণভাবে নেতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ব্যতিক্রম উদাহরণ হতে পারে না। শুবাচি জনাব Hillol Kr Das লিখেছেন, “এদিকে (পশ্চিম বাংলায়) এই নতুন ‘বাংলামি’ শব্দটি একটি ইন্টারনেট স্ল্যাং হিসেবে চালু হবার উপক্রম। বাংলামির ব্যাসবাক্য হলো: বাংলা মদ খেয়ে মাতলামি।”
বাংলামি= বাংলা+আমি। এবার দেখা যাক ‘বাংলামি’ শব্দের ‘আমি’ কী। এখানে ‘আমি’ হলো একটি ‘বাংলা তদ্ধিত প্রত্যয়’। এটি ‘ভাব’ অর্থে নিষ্পন্ন শব্দবিশেষ। প্রত্যয়টি ভাব, কর্ম বা অনুকরণার্থে ব্যবহৃত হলেও ব্যতিক্রান্ত ক্ষেত্র ছাড়া ‘আমি’ প্রত্যয়যুক্ত শব্দ সাধারণত নেতিবাচক অর্থ প্রকাশ করে। যেমন:
আঁতেলামি ইতরামি কুঁড়েমি গিধড়ামি গুণ্ডামি গোঁড়ামি, ঘাউরামি চামচামি চোরামি চ্যাংড়ামি ছাগলামি ছেলেমি ছ্যাঁচড়ামি ছ্যাবলামি ছ্যামড়ামি জ্যাঠামি ঠকামি ডেপোমি ত্যাঁদড়ামি ত্যাড়ামি দুষ্টামি ধূর্তামি ধৃষ্টামি নষ্টামি নোংরামি ন্যাকামি পাকামি পাগলামি পান্ডামি ফাজলামি ফাতরামি বলদামি বাঁদরামি বাচালামি বিটলেমি বোকামি, ভাঁড়ামি ভণ্ডামি মাতলামি মূর্খামি লুচ্চামি শঠামি ষণ্ডামি ষাঁড়ামি হ্যাংলামি। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে পেশা প্রকাশেও ‘আমি’ প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়। যেমন: ঘরামি। স্মর্তব্য, ‘হারামি’ কিন্তু ‘আমি’ প্রত্যয় দিয়ে গঠিত শব্দ নয়।
অনেকে প্রশ্ন করেন, ‘বাংলা’ ইতিবাচক শব্দ। তাহলে ‘আমি’ প্রত্যয়যুক্ত ‘বাংলামি (বাংলা+আমি’ নেতিবাচক হবে কেন? কারণ, বাংলায় ‘আমি’-প্রত্যয়টি সাধারণত নেতিবাচক অর্থ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রত্যয়টি (আমি) কোনো ইতিবাচক বা শোভন অর্থসমৃদ্ধ শব্দের সঙ্গে যুক্ত হলেও ওই শব্দটির অর্থ সাধারণত নেতিবাচক হয়ে যায়। যেমন: ‘ছেলে’ ইতিবাচক বা শোভন শব্দ, কিন্তু ‘ছেলেমি (ছেলে+আমি)’ নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়; অর্থ: অপরিণতবুদ্ধি, বিরক্তিকর ও অনভিজ্ঞতা। ‘বুড়ো’ বা ‘বুড়া’ নেতিবাচক শব্দ নয়। কিন্তু ‘বুড়োমি’ বা ‘বুড়ামি’ নেতিবাচক অর্থ দেয়; অর্থ: ইচড়েপাকা, বুড়োর মতো অসংলগ্ন আচরণ; অযথা মাতবরি, অহেতুক উপদেশ দেওয়া। অনুরূপ, ‘ভদ্র’ ইতিবাচক শব্দ, কিন্তু ‘ভদ্রামি’ অর্থ: অতি ভক্তি, তোষামুদে, ব্যক্তিত্বহীন আচরণ— এগুলো নেতিবাচক ।
‘বাংলা’ একটি ভাষার নাম। এর সঙ্গে ‘আমি’ প্রত্যয় যে কারণে বা যে অর্থ প্রকাশের জন্যই যুক্ত করা হোক না, দীর্ঘকাল নেতিবাচক অর্থ নিয়ে ব্যবহার বা প্রচলনের কারণে ‘আমি’-যুক্ত বাংলা (বাংলামি) অনেকের কাছে নেতিবাচক/অশালীন অর্থ নিয়ে উপস্থিত হবে। আমি নিশ্চিত ‘বাংলামি’ শব্দটি নিশ্চয় নেতিবাচক অর্থে ব্যবহারের জন্য তৈরি বা ব্যবহার করা হয়নি; অবশই ইতিবাচক অর্থে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছে; কিন্তু দীর্ঘকালের বহুল নেতিবাচক প্রচলন/প্রয়োগ এবং ব্যাকরণগত অভিধা শব্দটিকে (বাংলামি) নেতিবাচক অর্থে ব্যবহারের অনুকূলে অকাট্য যুক্তি ও অবারিত সুযোগ করে দিয়েছে। এজন্য ‘বাংলামি’ শব্দ তৈরির কাজটিকে অনেকে আঁতেলামি ইতরামি ছেলেমি ছ্যাঁচড়ামি ছ্যাবলামি ছ্যামড়ামি জ্যাঠামি ত্যাঁদড়ামি ধূর্তামি নষ্টামি নোংরামি ন্যাকামি পাকামি পাগলামি ফাজলামি ফাতরামি মূর্খামি বাঁদরামি বাচালামি বোকামি, ভাঁড়ামি ভণ্ডামি মাতলামি হ্যাংলামি প্রভৃতি নেতিবাচক শব্দ দিয়ে দ্যোতিত করছেন।
অতএব, ‘বাংলামি’ শব্দটি পহেলা বৈশাখের আলপনায় ব্যবহার করা আদৌ সমীচীন হয়নি। ‘আমি’ শব্দ যুক্ত করে ‘বাংলা’ শব্দটাকেও নেতিবাচকের কাতারে শামিল করে দেওয়া হলো, যদিও ব্যবহার করা হয়েছে ইতিবাচক অর্থে। সাড়ে তিন লাখের অধিক শব্দে সমৃদ্ধ বাংলায় কি শব্দের এমন আকাল পড়েছে যে, একটি বিতর্কিত শব্দ ব্যবহার করতে হবে?যারা এসব করেছেন তাদের আবেগ আছে, কিন্তু বোধবুদ্ধির বড়ো অভাব। বোধহীন আবেগ পাগলামি; পাগলামি থেকে আসে ইতরামি। ‘বাংলামি’ বাংলার প্রতি ভালোবাসা হতে সৃষ্ট নয়, এটি আয় বাড়ানোর জন্য বিবেচনাহীন বিজ্ঞাপনোন্মাদনা মাত্র।

You cannot copy content of this page