চোখ : কাব্যিক ভাবনা ব্যাকরণিক অভিধা

 চোখ : কাব্যিক ভাবনা ব্যাকরণিক অভিধা

ড. মোহাম্মদ আমীন

চোখ কী? কাব্য জগতে যা মনের কথা বলে, প্রেমে দেয় জীবন, জীবনে দেয় দৃষ্টি— মুক্তিতে যে বিশালতা দিয়ে হৃদয়ের কোনাগুলো ভরিয়ে দেয়  স্মৃতির প্রগাঢ়তায়— সেটিই চোখ। রঙ তার কালো, কিন্তু ভেতরে আর বাহিরে সব জ্বলজ্বলে আলো। চোখ যদি কালো হয়, তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:

“কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।”

 চোখ মনের কথা বলে। শিল্পীর গলায় পাওয়া যায় তার প্রমাণ: চোখ যে মনের কথা বলে – -।  চোখ এমন একটি বিস্ময়কর বস্তু, যার ভেতরের আলো দিয়ে বাহিরের পৃথিবী দেখা যায়। এই চোখ বিস্ময়ের  ঐশ্বর্য। রবীন্দ্রনাথ এই চোখের ভেতরের আলো দিয়ে বাহিরের জগৎ প্রত্যক্ষ করেছেন: চোখের আলোয় দেখেছিলাম, চোখের বাহিরে।

প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অভিধানের ‘চোখ’ একটি দেশি শব্দ। বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত চোখ শব্দের অর্থ (১) মাথার সম্মুখভাগে অবস্থিত যে অঙ্গের সাহায্যে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণী দেখতে পায়, চক্ষু, নয়ন, লোচন, দর্শনেন্দ্রিয়। (২) দৃষ্টি, নজর (স্নেহের চোখে দেখা)। (৩) সুদৃষ্টি, অনুকূল দৃষ্টি, খেয়াল (চোখ রাখা)।(৪) লোলুপ দৃষ্টি (চোখ দেওয়া), (৫) যে স্থানে বাঁশ, আখ আনারস প্রভৃতির অঙ্কুরোদগম হয়। অভিধানেও বলা হচ্ছে চোখ দিয়ে প্রাণী দেখে। উদ্ভিদ সৃষ্টি করে।

তবে মানুষের চোখের সঙ্গে নজর তথা মনের সম্পর্ক বেশ নিবিড়। মন বা নজর না থাকলে চোখের দেখা আর দেখা থাকে না। চোখের নিজের যদি নজর কম হয় তাহলে আর কোনো কিছু দিয়ে তা পূরণ করা যায় না। তাই শ্যামল মিত্রের প্রশ্ন: চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে?  আমার চোখের নজর এত কম যে, দুনিয়ার সব কাজল ঢেলে দিলেও কিছু হবে না। আমার মন আর চোখ একসঙ্গে একাগ্র হতে পারে না— চোখে দেখেও অনেক কিছু দেখা হয় না, তাই ভুল হয়ে যায় বহু। দেখুন এই নিবন্ধেও কত ভুল পেয়ে যাবেন। যাই হোক, এ তো গেল শুধু চোখ। চোখের পরে কিছু এলে বা গেলে চোখের অর্থ এবং অনর্থে আরও কত কী কাণ্ড ঘটে যায় তা দেখুন:

চোখ ওঠা/ চোখ উঠা: /চোখের প্রদাহজনিত ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হওয়া/ চোখ উঠলে আপনি আর কোথাও নন্দিত হতে পারবেন না। কারণ, এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ।যত্রতত্র গেলে লোকে ভালো চোখে দেখবে না। চোখ ওলটানো/ চোখ উলটানো: [(১)মৃত্যুর ঠিক পূর্বমুহূর্তে চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে আসা, (২)অকৃতজ্ঞতার ভাব প্রকাশ করা।] শুধু মরার সময় মানুষ চোখ ওল্টায় না, বন্ধুবান্ধবের বিপদের সময়ও অনেকে চোখ উলটিয়ে ফেলে।

চোখ খাওয়া: [দৃষ্টিশক্তি হারানো] এই খাওয়া কিন্তু মাছের চোখ খাওয়ার মতো গালে দিয়ে দাঁতে চিবিয়ে খাওয়া নয়। এই খাওয়াা সারাদিন কম্পিউটারে কাজ করে অল্প বয়সে চোখ-দুটো নষ্ট করে ফেলা। চোখখাকি/চোখখেকো: [দৃষ্টিহীন (গালিবিশেষ)] চোখ শুধু দেখে না, গালিও দেয়; চোখখাকি বেটি, আবার কথা বলে লম্বা! চোখ খোলা : [জেগে ওঠা, জাগা, সতর্ক হওয়া, জ্ঞান লাভ করা।] চোখ খোলার পর প্রতিদিন চোখ খুলে সে চোখ খোলার জন্য বই পড়া শুরু করে।]

চোখ গেল: [পূর্ব এশিয়ার কোকিলজাতীয় পাখিবিশেষ, যার ডাক শুনতে অনেকটা ‘চোখ গেলো’-র মতো, পাপিয়া।] পাপিয়ার চোখ  গেল কান্নায় সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে নজরুল গেয়েছেন:  চোখ গেলো চোখ গেলো কেন ডাকিস রে, চোখ গেল পাখি রে। 

চোখ ঘুরানো/চোখ ঘোরানো: (১) চোখের মণি ঘুরিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা, (২) রেগে তাকানো।

চোখ ছলছল করা: দুঃখ সুখ অভিমান ইত্যাদির কারণে চোখ অশ্রুসিক্ত হওয়া। মানুষের চোখ কত কারণে ছলছল করে, ভূপেন হাজারিকার সেই চোখ ছলছল করা গানটি শুনলে কার চোখ না ছলছল করে- চোখ ছল ছল করে, ওগো মা কী ব্যাথা অন্তরে– 

চোখ ছানাবড়া: ভয় বা বিস্ময়জনিত চোখের স্ফীতি।শুধু ভয়ে নয়, আনন্দ বিস্ময়েও চোখ ছানাবড়ার মতো হয়ে যায়। চোখ ঝলসানো/ চোখ ঝাঁ ঝাঁ করা : (১) তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে ওঠা, (২) রূপে মুগ্ধ হওয়া। চোখ টাটানো: (১) চোখে বেদনা অনুভব করা, (২) অন্যের শ্রীবৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত হওয়া। চোখ টেপা: চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করা; এক চোখ বন্ধ করে অশোভন ইঙ্গিত করা। চোখ ঠারা: (১) চোখ কুঁচকে ইশারা করা।(২) নিজেকে মিথ্যা প্রবোধ দেওয়া। চোখ দেওয়া: (১) ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকানো, (২) কুনজর দেওয়া। চোখ নাচা: চোখের পাতা স্পন্দিত হওয়া। 

চোখ পড়া: [মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়া, (২) (অসাধু উদ্দেশ্যে) কোনো কিছুর প্রতি নজর পড়া।] চোখে চোখ পড়ায় কত কিছু হয়েছে, হয়েছে কত প্রেম, কত যুদ্ধ তার ইয়ত্তা নেই। তাই তো কবির গলায় গান হয়েছে সুর: তোমার চোখে চোখ পড়েছে ভেঙে গেছে লজ্জা ভয়, ভালোবাসা সবাই বলে এমনই করে হয়।

চোখ পাকানো: ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করা,  রেগে তাকানো। চোখ ফোটা: জন্মের পর মনুষ্যেতর প্রাণীর প্রথম চোখের পাতা খোলা। চোখ বুলানো/চোখ বোলানো: মনোযোগ না দিয়ে দ্রুত পড়া। চোখ বোজা: চোখ বন্ধ করা; ঘুমানো, (২) মত্যৃবরণ করা, আমলে না আনা। চোখ মটকানো: চোখ টিপে ইঙ্গিত করা। চোখ মারা:  এক চোখ বন্ধ করে অশালীন ইঙ্গিত করা। চোখ রাখা: তত্ত্বাবধান করা, (২) সতর্ক থাকা, (৩) মনোযোগী হওয়া চোখ রাঙানো: (১) রেগে কোনো কিছুর দিকে তাকানো (২) ভীতি প্রদর্শন করা।

এতক্ষণ হলো কেবল ‘চোখ’-এর কথা; এবার দেখুন ‘চোখ’ শব্দের সঙ্গে প্রত্যয়-বিভক্তি যুক্ত হলে কী হয়।

চোখাচোখি: (১) পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় (২) হঠাৎ একে অপরের প্রতি দৃষ্টিপাত। পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেলে কী হয়? দেখুন কী না হয় এবং নজরুলের কী হয়েছিল: তোমারই মতন যেন কাহারো সনে, সেদিন পথে চোখাচোখি; হলো গো বনে–।

চোখে চোখে কথা: চোখের ইশারায় পরস্পর ভাব বিনিময়।যে কথা সহজে মুখে বলা যায় না, বলা গেলেও মজা পাওয়া যায় না— তেমন কথায় হয় চোখেচোখে। আশা ভোঁসলের কণ্ঠে চোখে চোখে কথা বলার স্পন্দন যৌবনকে কী মধুর শিহরনে স্পন্দিত করে রেখেছিল, মনে পড়ে কি:  চোখে চোখে, কথা বলো মুখে কিছু বলো না।  

চোখে চোখ রাখা: মনের ভাব বিনিময়,  হার্দিক প্রকাশ, সৌহার্দ্য। চোখে চোখ রাথার মধ্যে যে অনুভূতি তা চোখে চোখ না রাখলে অনুভব করা যায় না। বিমোহিত হলেই কেবল এমন কাজটি করা যায়, বিমোহিত হওয়ার জন্যই এ কাজটি করা হয়: চোখে চোখ রেখে যাও, যদি পার বুঝে নাও, মুখে যায় না বলা ইশারাতে বুঝে নাও।

চোখে চোখে রাখা : (১) দৃষ্টির বাইরে যেতে না দেওয়া (২) সতর্ক পাহারায় রাখা, (৩) সজাগ দৃষ্টিতে রাখা। চোখে চোখ রাখার সঙ্গে  চোখে চোখে রাখার সম্পর্ক দা-কুমড়ো। অন্য কারও চোখ যাতে না পড়ে সেজন্য কাউকে চোখে চোখে রাখতে হয়।  চোখে ঠুলি দেওয়া : দেখেও না দেখার ভান করা। উদাসীন থাকা। চোখে ধুলো দেওয়া: প্রকৃত তথ্য গোপন করে প্রতারণা করা।

 

চোখের চামড়া: (১) চোখের পাতা, (২) অন্যের দৃষ্টিতে লজ্জাজনক ঠেকে এমন কিছু করতে কুণ্ঠাবোধ, চক্ষুলজ্জা।

চোখের দেখা: কথা না বলে ক্ষণেকের তরে দেখা।ক্ষণেকের দেখাতেও অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। কারণ, চোখ মনের প্রতিভূ হয়ে মনকে কব্‌জা করে নিতে পারে সহজে। অবশ্য চোখের দেখা ভুল হলেও মন জানার পর তা ঠিক হয়ে যায়:  আমার চোখের দেখা ভুল হলো তোমার মনটা জানার পরে, তোমার বাইরে থেকে-–।

চোখের নেশা: কেবল চোখে দেখার বাসনা। এই বাসনা মনপ্রাণ আর হৃদয়কে কাব্যিক করে তোলে অনবদ্য কষ্টের নন্দিত যাতনায়। নজরুল এই কষ্টের কথা জানেন, বুঝেছিলেন হাড়ে হাড়ে। তাই মোহনীয় বেদনায় গেয়েছেন:  চোখের নেশার ভালোবাসা, সে কী কভু থাকে গো, জাগিয়া স্বপনে স্মৃতি, স্মরণে কে রাখে গো– – -।

চোখের পলক:  নিমেষ, ক্ষণকাল। নিমেষেও অনেকে কিছু ঘটে যেতে পারে। শিল্পীর ভাষায়: চোখের পলকে এত কাছে, কখন এলে যে তুমি–। এর চেয়েও মারাত্মক ঘটনা ঘটে। অনেকে অনেক সময় আকুল হয়ে যায় একটি পলকের জন্য। কিশোর কুমার তা আমাদের জানিয়ে গেছেন: এক পলকের একটু দেখা, আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী!

চোখের পাতা: চোখের ওপরের চামড়া, নেত্রপল্লব। চোখের বালি: চোখের জন্য পীড়াদায়ক বালিকণা, (২) যাকে দেখলে চোখে বালিকণা পড়ার মতো পীড়া অনুভূত হয়। চক্ষূশুল। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত একটি উপন্যাসের নাম চোখের বালি।

চোখের ভুল:  দেখার ভুল। অনেক সময় মানুষ যা দেখে তা ঠিক হয় না, নানা কারণে বিভ্রান্তি এসে ভিড় করতে পারে। এটাকেই বলে চোখের ভুল। ভুল আবার ঠিকও হয়ে যেতে পারে। কুমার বিশ্বজিতেরও এমন হয়েছে: আমার চোখের দেখা ভুল হলো তোমার মনটা জানার পরে, তোমার বাইরে থেকে-–।

চোখের মাথা খাওয়া: চোখের আসলে কোনো মাথা নেই। তাহলে চোখের মাথা খাওয়া বাগ্‌ভঙ্গি এল কীভাবে? এটাও একটা চোখের ভুল। আসলে এর অর্থ দৃষ্টি শক্তি হারানো।  চোখে সরষে ফুল দেখা: এ সরষে ফুল সরষে ক্ষেতের সরষে ফুল নয়। চোখের ক্ষেতে  ফোটা সরষে ফুল। এই সরষে ফুল  দেখা মানে বিপদে পড়ে দিশেহারা বোধ করা। বিপদে পড়লে যে-কোনো সময়  এবং যে-কোনো মৌসুমে যে-কোনো স্থানে  চোখ সরষে ফুল দেখে।

চোখ দেশি হোক আর বিদেশি হোক, চোখ কিন্তু পাথর নয়। সুবীর নন্দীর গলায় ভালোই লাগে বেশ: আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে।


ইদ বনাম ঈদ

জল বনাম পানি

খাঁটি গোরুর দুধ শুদ্ধ না কি অশুদ্ধ

বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন

আশীর্বাদ দোয়া : আদব ও আদাব 

নিচ নীচ বনাম নিচে নিচু

আপদ্‌ বনাম বিপদ : বিপৎকাল না কি বিপদকাল

সাধারণ জ্ঞান সমগ্র/২

সূত্র: বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবিলিকেশন্স লি.।

[su_heading size="21" margin="30"] চোখ : কাব্যিক ভাবনা ব্যাকরণিক অভিধা[/su_heading]

চোখ কী? কাব্য জগতে যা মনের কথা বলে, প্রেমে দেয় জীবন, জীবনে দেয় দৃষ্টি— মুক্তিতে যে বিশালতা দিয়ে হৃদয়ের কোনাগুলো ভরিয়ে দেয়  স্মৃতির প্রগাঢ়তায়— সেটিই চোখ। রঙ তার কালো, কিন্তু ভেতরে আর বাহিরে সব জ্বলজ্বলে আলো।

ড. মোহাম্মদ আমীন

চোখ যদি কালো হয়, তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:

“কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।”

 

Your Dream Vacation is Here

Enjoy Some You-Time

I am text block. Click edit button to change this text. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

The Perfect Surrounding

I am text block. Click edit button to change this text. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

Fine Food Cuisine

I am text block. Click edit button to change this text. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

The Best Experience Ever

"Click edit button to change this text. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo"
Chris Jones
Travel Blogger

Savour Your Next Holiday

Language
error: Content is protected !!