অপরূপ: অপরূপ অর্থ অপ যে রূপ; খারাপ রূপ; দ্বন্দ্বার্থক দ্ব্যর্থক সাংঘর্ষিক বা বিপরীত অর্থদ্যোতক শব্দ

অপরূপ: অপরূপ অর্থ অপ যে রূপ; খারাপ রূপ; দ্বন্দ্বার্থক দ্ব্যর্থক সাংঘর্ষিক বা বিপরীত অর্থদ্যোতক শব্দ

#subach

ড. মোহাম্মদ আমীন

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘অপ’ শব্দের দুটি ভুক্তি। একটি বিশেষ্য এবং অন্যটি অব্যয়। বিশেষ্য, ‘অপ’ মানে জল। অব্যয় ‘অপ’ হচ্ছে অপকর্ষ, নিন্দা, বিরোধ, প্রতিকূল প্রভৃতিসূচক সংস্কৃত উপসর্গ। যখনই কোনো বিষয়ের সঙ্গে ‘অপ’-যুক্ত হয়েছে, তখনই বিষয়টি ভালো হলেও খারাপ হয়ে গেছে।

কর্ম স্বভাবতই ভালো, কিন্তু খারাপ হলে তা অপকর্ম। কীর্তি মহাগৌরবের, কিন্তু খারাপ হলে তা অপকীর্তি হয়ে যায়। যা ‘অপ’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ঠিক তেমিন

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

অপচিকীর্ষু, অপব্যবহার, অপব্যয়, অপভাষা, অপভ্রষ্ট প্রভৃতি। এই শব্দগুলো বাক্যে সাধারণত নিন্দার্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ‘অপরূপ’ এমন একটি শব্দ, যেটি ‘অপ’ হয়েও কৃষ্ট এবং আকর্ষণীয় অর্থ ধারণের বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছে। এটি ব্যবহৃত হয় প্রশংসার্থে। ‘অপরূপ’ শব্দের আদি অর্থ কদাকার। আধুনিক অভিধানেও ‘অপরূপ’ শব্দের অর্থ কদাকার রয়ে গেছে। এরূপ একটি কদাকার শব্দ দিয়ে বলা হচ্ছে, মেয়েটি অপরূপ, মানে মেয়েটি কাদাকার, মেয়েটি কুৎসিত, মেয়েটি অপয়া, মেয়েটি রূপবান, মেয়েটি রূপসি, মেয়েটি সুন্দরী। আসলে মেয়েটি কী? বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত অপূর্ব শব্দ হতে উদ্ভূত ‘অপরূপ’ শব্দের অর্থ অপূর্ব, অতুলনীয়, কদাকার, বেয়াড়া, অদ্ভুত, বিস্ময়কর, আশ্চর্য প্রভৃতি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, ‘অপরূপ’ শব্দের অন্যতম অর্থ কদাকার, বেয়াড়া প্রভৃতি এখনো বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। এবার দেখা যাক, কদাকার ও বেয়াড়া শব্দের অর্থ কীভাবে অপূর্ব, অতুলনীয়, সুন্দরী ও রূপবান হয়ে গেল।

‘রামরাজত্ব’একটি দ্বন্দ্বার্থক বা বিপরীত অর্থদ্যোতক শব্দ। যেসব শব্দের অর্থ একই সঙ্গে ইতিবাচক ও নেতিবাচক কিংবা বিপরীত অর্থও ধারণ করে তাদের দ্বন্দ্বার্থক বা বিপরীত অর্থদ্যোতক শব্দ বলে। যেমন: অপরূপ। এর অর্থ অতি সুন্দর এবং অতি কুৎসিত। অনুরূপ, অগণ্য, দারুণ, পর্যাপ্ত, ফাজিল।
রাম হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহে তাঁকে অযোধ্যার রাজা বলা হয়েছে। রাম সূর্যবংশে (ইক্ষ্বাকুবংশ; পরবর্তীকালে রাজা রঘুর নামানুসারে রঘু বংশ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। একদল বলে, রামের শাসন ছিল সুখ ও শান্তিতে পূর্ণ। আরেক দল বলে, সুখ-শান্তি ছিল রাম ও তাঁর অনুগতদের জন্য, বিরোধীদের জন্য নয়। বিরোধীদের মতে, রামের শাসন ছিল স্বেচ্ছাচারের শাসন।
‘রাম’ ও ‘রাজত্ব’ মিলে রামরাজত্ব (রাম+রাজত্ব)। এর শাব্দিক অর্থ রামের রাজত্ব। বাংলা একাডমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, তৎসম ‘রামরাজত্ব’ অর্থ (বিশেষ্যে) ১. সুখ ও শান্তিপূর্ণ রাজত্ব। ২. (আল.) স্বেচ্ছাচারের রাজত্ব।
  • দেশ সুখ আর শান্তিতে ভরপুর, কোথাও কোনো অভাব নেই— এ যেন রামরাজত্ব। আহ্ কী শান্তি!
  • যার যেমন ইচ্ছে তেমন করছে; কোনো প্রতিকার নেই; অসহ্য এক রামরাজত্ব চলছে।
  • জিনিসপত্রের দাম বেড়ে আগুন, নিশ্বাসের মতো বিদ্যুৎ যায় আর আসে; রাস্তায় হাঁটা যায় না হকারের জ্বালায়; কী এক অসহনীয় রামরাজত্ব চলছে দেশে! হে রাম, কোথায় তোমার সেই ঐশ্বর্যভরা রামরাজত্ব থেকে এক চিলতে শান্তি ছুড়ে দাও-না!
তৎসম ‘গণ্ডগ্রাম (গণ্ড+গ্রাম)’ অর্থ (বিশেষ্যে) ১. জনাকীর্ণ বড়ো গ্রাম, জনাকীর্ণ সমৃদ্ধ গ্রাম। ২. দূরবর্তী ক্ষুদ্র গ্রাম। শব্দটির উচ্চারণ /গন্‌ডোগ্‌গ্রাম্‌/।
‘গণ্ডগ্রাম’একটি দ্বন্দ্বার্থক/দ্ব্যর্থক/সাংঘর্ষিক অর্থদ্যোতক বা বিপরীত অর্থদ্যোতক শব্দ। যেসব শব্দের অর্থ একই সঙ্গে ইতিবাচক ও নেতিবাচক কিংবা বিপরীত অর্থও ধারণ করে তাদের দ্বন্দ্বার্থক/দ্ব্যর্থক/সাংঘর্ষিক অর্থদ্যোতক বা বিপরীত অর্থদ্যোতক শব্দ বলে। যেমন: অপরূপ। এর অর্থ অতি সুন্দর এবং অতি কুৎসিত। অনুরূপ, অগণ্য, দারুণ, পর্যাপ্ত, ফাজিল, রামরাজত্ব…।

অপরূপ শব্দের আদি অর্থ কদাকার। শারীরিক সৌন্দর্যের মতো আর্থিক সম্পদও একপ্রকার রূপ। সঞ্চয় ব্যবস্থাকে ঘৃণা করা হতো বলে, একসময় রূপই ছিল সব

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

নিকৃষ্টতা ও অবজ্ঞার মূল। “আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী” কথাটির মধ্যেও ‘রূপ’-এর নিকৃষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভুসুকুর কথায় রূপের কদর্যতাই ঘোষিত হয়েছে।এখনও অনেককে রূপের জন্য হেয় হতে হয় নানাভাবে।সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ সঞ্চয়ের স্বীকৃতি, রূপের প্রতি কিছু লোকের আগ্রহ এবং তা সংরক্ষণে সীমিত হলেও নানা ব্যবস্থা গড়ে উঠায় ‘অপরূপ’ এর কদর্য অর্থ পরিবর্তন হয়ে গেছে। বিভিন্ন ধর্মেও বিশেষ করে নারীর রূপসজ্জাকে কদর্য অথে দেখানো হয়েছে। অন্যতম প্রাচীন বাঙালি কবি ও চর্যকার ভুসুকু সৌরাষ্ট্রের রাজপুত্র ছিলেন। মহাযান বৌদ্ধমতে শান্তিদেবের অপর নাম ভুসুকু। পিতার মৃত্যুর পর ইনি সিংহাসন ত্যাগ করে নালন্দায় চলে আসেন। এখানে তিনি বৌদ্ধাচর্য জয়দেবের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন।সেখান থেকে রাজনীতিক নিরাপত্তার কারণে চলে যান, চট্টগ্রামের দেয়াঙ পাহাড়ে। ইনি নিজের কুটিরে সর্বক্ষণ গোপনে অধ্যায়ন করতেন। এজন্য অন্যান্য ভিক্ষুরা মনে করতেন যে, ইনি সব সময় আহার এবং নিদ্রায় সময় কাটান।তাই ভিক্ষুরা তাকে ভুসুকু (ভু=ভক্ষণ, সু=সুপ্তি, কু=কুটির) নামে ডাকতেন।।

বর্তমানকালের মতো প্রাচীনকালে  রূপের এমন বেসাতি ছিল না। রূপকে নানাভাবে ঢেকে রাখা হতো। এখনও তেমন দেখা যায়। কদর্যতা বা অবাঞ্ছিত কিছু রোধ করার জন্য এমন করা হতো বা হয়। বোরকা এর একটি উদাহরণ হতে পারে। রাস্তায় স্বাভাবিক চলাফেরায় মহিলাদের হয়রানি কদর্যতার প্রমাণক। কর্ম —–অপকর্ম …………রুপ —অপরূপ । অপরূপ [ aparūpa ] বিণ. 1 অপূর্ব; অতুলনীয় রূপবিশিষ্ট (অপরূপ শিল্পসম্পদ); 2 (ব্যঙ্গে) আশ্চর্য, কিম্ভূত; 3 কদাকার, কুরূপ; বেয়াড়া। [(1)সং. অপূর্ব > প্রাকৃ. অপরূব > (2) সং. অপ (=অপগত) + রূপ (=সৌন্দর্য বা তুলনা)]।

কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী রচিত “বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ” গ্রন্থে বর্ণিত, ‘অপরূপ’ শব্দের অর্থ জানার আগে ‘অলঙ্কার’ শব্দের অর্থ জানা দরকার। অলঙ্কার = অলম+/কৃ+অ(ঘঞ্‌); যে করণ (কাজ করা) অলম্‌ (নিষিদ্ধ); নিষেধ সত্ত্বেও যা করা হয়েছে। যার দ্বারা মণ্ডন সাধিত হয় । অলম্‌ শব্দের অর্থ ‘করিও না’ । অহঙ্কার,

অলঙ্কার, সত্যঙ্কার, – ‘কার’ যুক্ত এই তিনটি শব্দই যৌথসমাজের উদ্বৃত্ত সম্পদকে ব্যক্তিগত করার প্রাচীন চেষ্টার নিদর্শন । প্রজাপতিতন্ত্রের আগে, উদ্বৃত্ত জমানো নিষিদ্ধ ছিল, ফেলে দেওয়া হয়ত আবর্জনা রূপে। যে আবর্জনা ভাগাড়ে যেত তাকে অবজ্ঞা করে ‘কিরাত’ বলা হতো । কারণ সামাজিক উৎপাদনের ‘অবশেষ’ থেকে সমাজদেহে পুঁজ (abscess) জমতে পারে । তাই এই উদ্বৃত্ত ছিল ‘ভূষা’ পদবাচ্য, যা খাদ্যবস্তুর ছোবড়ার সঙ্গেই ফেলে দেওয়া হতো । ‘ভূষা’ কথাটি বর্তমানেও খুব ভালো কথা নয় । এজন্য গহনাদি ‘ভূষা’ পদবাচ্য হয়ে যায় ।

পরে সমাজে সম্পদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হলে, অলঙ্কারের মর্যাদা বেড়ে যায় । যদিও ভারতবর্ষে ‘অহঙ্কার’-এর (আমার দ্বারা কৃত, অতএব এটি আমার) মর্যাদা তেমন

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং নিন্দিতই রয়ে গেছে। আর একটি দিক থেকেও বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে, ‘অল’ মানে ‘নিবারণ’ ও ‘ভূষণ’ । ভূষণের দ্বারা নিজেকে গোপন করে শত্রুনিবারণ করা যায়। হয়তো এজন্য ‘অল’ শব্দের আরেকটি অর্থ ‘শত্রুনিবারক’। অন্যথায় প্রকৃষ্টরূপ সাধন বা প্রসাধনের সঙ্গে ভূষণের সম্পর্ক থাকত না । অপরূপ = অপকৃষ্ট রূপ যাহার। এর অন্য অর্থ অদ্ভুত, অনুপম, অদৃষ্টপূর্ব্ব, পরমসুন্দর, অলৌকিকরূপসম্পন্ন, অচিন্তিতপূর্ব্ব, অতর্কিত । ‘অপ’ শব্দটি নিন্দাসূচক, সবাই জানেন । অথচ রূপের আগে ‘অপ’ থাকা সত্ত্বে ‘অপরূপ’ কথাটি বর্তমানে ‘অতি সুন্দর’ অর্থে প্রচলিত। এটা হওয়ার কারণ আছে। ‘অলঙ্কার’ শব্দটি থেকে জানা যায়, গহনাদি একসময় নিষিদ্ধ ছিল । শারীরিক সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেখানোও সেকালে মন্দকাজ বলে মনে করা হতো । বঙ্গীয় শব্দকোষ উল্লেখ করছে, ‘বাচস্পত্যে’ ‘আশ্চর্য্যরূপ’ অর্থে সংস্কৃত ‘অপরূপ’ ধৃত হয়েছে । অর্থাৎ ‘আশ্চর্য’ শব্দের ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায়, কারো কারো আশামূলক আচরণ (সবাই মিলে চাষ করার ফলে যে ফলগুলি ফলেছে, তার মধ্যে যে-লতায় ওই বড় ফলটি ফলেছে, তাতে আমি জল ঢালতাম, অতএব ভাগের সময় আমি যেন ওই ফলটি পাই – এইরূপ আচরণকে আশামূলক আচরণ বলা যায়।) দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত, সেরকম নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে (অপকৃষ্ট করে) অন্যদের দেখিয়ে আকর্ষণ করার মধ্যেও লোকে সেকালে এইরূপ ‘আশামূলক আচরণ’ দেখত এবং ঘৃণায় মূখর হয়ে উঠত । সেজন্য রূপসজ্জা অপকর্ম বলে নিন্দিত ছিল । পরবর্তীকালে সেটা সমাজে গ্রহণীয় হয়ে গৌরবজনক হয়ে যায়। যেমন হয়েছে ‘অলঙ্কার’-এর ক্ষেত্রে, যেমন হয়েছিল ‘মৎসগন্ধ্যা’র ক্ষেত্রে – দুর্গন্ধবতী হয়ে গিয়েছিল সুগন্ধবতী । তাই অপরূপ শব্দের শব্দগত অর্থ ‘মন্দ রূপ’ হলেও সমাজ-ইতিহাসের বিচারে প্রাচীন কালে তা মন্দই ছিল । পরে সমাজ ব্যবস্থা যতই ব্যক্তিমালিকানার দিকে এগোতে থাকে, ততই শব্দটির অর্থ ক্রমশ ‘অতি সুন্দর রূপ’ হয়ে যায় ।

সূত্র:

  • কোথায় কী লিখবেন বাংলা বানান: প্রয়োগ অপপ্রয়োগ, . মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
  • পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রমবিবর্তন, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
  • বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন,পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

 

Leave a Comment

You cannot copy content of this page