বাংলা নীচ জাতের ভাষা: বাংলা ভাষার মজা

বাংলা নীচ জাতের ভাষা: বাংলা ভাষার মজা

ড. মোহাম্মদ আমীন

শুভ রাত্রি কিন্তু শুভ রাত নয় কেন?

কারণ, সংস্কৃতভাষীর কাছে বাংলা ছিল নীচ জাতের ভাষা। সাধারণ ও প্রাকৃতরা ছিল তাদের কাছে জানোয়ার তুল্য। শুভ’ ও রাত্রি’ দুটোই তৎসম, কিন্তু ‘রাত্রি’ থেকে উদ্ভূত ‘রাত’ অতৎসম। তাই জাতচ্যুত অতৎসম ‘রাত’ শব্দকে উঁচুজাত বলে কথিত সংস্কৃত ‘শুভ’ তার পাশে বসতে দেয় না— জাত যাওয়ার ভয়ে। ছোটো জাতের পাশে বসবে কেন সে? এজন্য ‘শুভ রাত্রি’, ‘শুভরাত্রি’। পাশে বসালে বলা হয়— গুরুচণ্ডালী। বাংলা হচ্ছে চণ্ডাল, সংস্কৃত হচ্ছে গুরু।

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণের প্রত্যেকটি স্তরে এখনও মৃত ভাষা সংস্কৃতের ঘৃণার্হ রীতি লক্ষণীয়। অনেকে আবার বলে বসবেন— ঘৃণার বিষয় নয়, কানে যেটা শুনতে ভালো লাগে। ভালো আবার কী! যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা; আমাদের ওভাবে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে।

‘শুভ রাত্রি’ কিন্তু ‘শুভ রাত’ নয় কেন? এর কারণ শব্দের জাতপ্রথা। সংস্কৃত ভাষা প্রবল জাত্যভিমান নিয়ে সৃষ্ট ও পরিচালিত একটি প্রচন্ড পণ্ডিতম্মন্য ও অহংকারীদের ভাষা। এ ভাষায় কেবল উচ্চবংশীয়দের প্রবেশাধিকার ছিল। বৈয়াকরণগণ সংস্কৃতকে এমনভাবে লালন করেছেন যাতে উচ্চবংশীয় সংস্কৃত ছাড়া নীচু বলে কথিত প্রাকৃত বা বাংলা ভাষার সঙ্গে তার কোনো শব্দ না-মেশে। এটাকে এককথায় ঘৃণা বলা যায়।

একসময় সংস্কৃত ভাষার কোনো কথা নীচুজাত বলে কথিত কেউ শুনে ফেললে কানে গরম সিসা ঢেলে দেওয়া হতো। কানে গরম সিসা যাওয়ার ভয়ে তৎসম বা সংস্কৃত কোনো শব্দ আজও সহজে অতৎসমের সঙ্গে মিশে না এবং মিশে সুখের শব্দবন্ধন বা বাক্য-সংসার রচনা করতে পারে না। যদিও এখন কানে সিসা যাওয়ার ভয় নেই, কিন্তু মৃত সংস্কৃতপ্রেমী বুদ্ধিজীবীদের দাপটকে আমরা কতটুকু উপেক্ষা করার সামর্থ্য রাখি? তাঁদের সম্মিলিত স্বার্থ আছে, তাই ঐক্য আছে। আমাদের নেই।

বাংলায় বাংলায় ‘শুভ রাত’ বা ‘শুভরাত’ বললে কোনো অসুবিধা হবে কি না। কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ, বাংলা সংস্কৃত ভাষা নয়, সংস্কৃত হতে আলাদা একটি সম্পূর্ণ নতুন ভাষা। কিন্তু আমাদের দীর্ঘকালের সংস্কার ও অভ্যস্ততা এবং সংস্কৃতসেবী পণ্ডিতগণ তা কি হতে দেবে সহজে? তেমনি ‘শুভ সকাল’ বলা হয়, কিন্তু ‘শুভ ভোর’ বলা হয় না। কারণ ‘ভোর’ অতৎসম।

বাংলাকে এভাবে অপদস্থ দেখতে চাই না আর। আমি শুভরাত্রি বলব না, শুভ রাত বলব। আমি যেখানে সেখানে সমাস করব না। শহিদ মিনার লিখব, শহিদমিনার লিখব না।

অর্থ অভিন্ন হলেও বাংলায় এমন কিছু শব্দ আছে যেগুলো শুধু অতৎসম হওয়ার কারণে তৎসম শব্দের পাশে বসতে দেওয়া হয় না, অপাঙ্‌ক্তেয় গণ্য করা হয়। বাংলার পাশে বসলে জাত যাবে। যেমন: ‘বাঘ’ ও ‘শার্দুল’ একই অর্থ বহন করে; তবু ‘বাঘের বাচ্চা’ হয়, কিন্তু ‘শার্দুলের বাচ্চা’ বা ব্যাঘ্র-বাচ্চা হয় না। বলতে হয় শার্দুলশাবক বা ব্যাঘ্রশাবক। ‘মড়া’ ও ‘শব’ অভিন্ন অর্থ-দ্যোতক। তারপরও ‘মড়া-পোড়ানো’ বলে, ‘শবপোড়ানো’ বলে না। অভিধানের কোথাও পাওয়া যায় না। বলতে হয় শবদাহ। তেমনি বলা যায় না ‘মড়াদাহ’।মড়াকে পোড়াতে হয়, শবকে দাহ করতে হয়।

এমন আরও কিছু উদাহরণ: কুকুরের বাচ্চা, কিন্তু সারমেয়শাবক; সাদাকাপড়, কিন্তু শ্বেতবস্ত্র; ফুলের তোড়া কিন্তু পুষ্পস্তবক; খবরের কাগজ, কিন্তু সংবাদপত্র; সাগরপাড়ি কিন্তু সমুদ্রযাত্রা; লালরঙ, কিন্তু লোহিতবর্ণ; কালোরঙ, কিন্তু কৃষ্ণবর্ণ; বিয়েবাড়ি, কিন্তু বিবাহবাসর; ফুলের বাগান, কিন্তু পুষ্পোদ্যান; শুয়োরের বাচ্চা, কিন্তু বরাহশাবক। জলপ্রপাত, জলযোগ, জলখাবার হয়; কিন্তু পানিপ্রপাত, পানিযোগ ও পানিখাবার হয় না।

এগুলো শব্দের জাতপ্রথা। সংস্কৃত শব্দ ব্রাহ্মণদের মতো। তারা যার-তার সঙ্গে বসে না, নিজ জাত ছাড়া ছোটো জাত বলে কথিতদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায় না।আমরা এমন জাতপ্রথা ভাঙতে চাই। ভাষার আবার জাত কী? প্রবীণ যদি নবীনকে অবহেলা করে, ঘৃণা করে তাহলে প্রবীণ শেষ পর্যন্ত নাশ হয়ে যায়। যা ঘটেছে সংস্কৃতের কপালে। সে এখন মৃত ভাষা। কিন্তু বাংলা জীবিত হয়েও কেন ‍মৃতবৎ, কারণ ভাষাভাষীর অজ্ঞতা।

বাংলা কোনো ভাষাকে অবহেলা করে সংস্কৃতের মতো তাড়াতাড়ি মরে যেতে চায় না। সে সংস্কৃত-সহ সব ভাষাকে যথামর্যাদা প্রদান করবে। প্রয়োজনমতে সব ভাষা থেকে নেবে, ঋণ স্বীকার করবে; মূল্যায়ন করবে । তবে কারো কাছে চণ্ডাল হয়ে থাকবে কেন?

সূত্র: বাংলা ভাষার মজা, . মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

Leave a Comment

You cannot copy content of this page