ড. মোহাম্মদ আমীন
এই পোস্টের লিংক: https://draminbd.com/বাংলা-ভাষা-সিলেটে-আহত-চট্/
বাংলা ভাষা: সিলেটে আহত চট্টগ্রামে নিহত সমগ্র উপন্যাস

এই পোস্টের লিংক: https://draminbd.com/বাংলা-ভাষা-সিলেটে-আহত-চট্/
ভূমিকা
এক
ইংরেজি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে সবুজ।
সেই ষষ্ঠ শ্রেণির ঘটনা। মনে পড়ে গেল হঠাৎ
হাতে বই। ঠোঁটে জপ। চোখ মিটমিট। মন অনাগত প্রশ্নপত্রে হাবুডুবু। হঠাৎ তাকালে মনে হবে মনে মনে জপছে। হিন্দু হলে বলা যেত— রামনাম। পরীক্ষাকেন্দ্র দূরে নয়। স্বভাবিকভাবে হাঁটলে হেলেদুলে বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। সবুজ আসলে আল্লাহ-রসুল জপছে না; রামনামও নয়। পরীক্ষার পড়া জপছে। জামাকাপড় পরার সময় মা বলেছে, পড়া, পড়াগুলো পথে পড়ে পড়ে যেতে। হাঁটা-পড়া নাকি বহুদিন মনে থাকে। মায়ের কথায় সবুজের বড়ো আস্থা।
সবুজের মা তসলিমা খাতুন।
তিনি খান বাহাদুর আবদুল আলিমের বড়ো ছেলের বড়ো মেয়ে। দাপুটে পরিবারের আদুরে কন্যা ছিল একসময়। ফারসি জানেন, উর্দু জানেন। ইংরেজিতে অনর্গল— ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি শেক্সপিয়র সাহেবের হ্যামলেট তাঁর মুখস্থ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভ্রান্তিবিলাসও আছে। এটি শেক্সপিয়র সাহেবের “কমেডি অব দ্যা এররস”-এর ভাবানুবাদ।
প্রাথমিক বিদ্যালায়ে অধ্যয়নকালে মা এসব কাহিনি সবুজকে গল্প করে শোনাত। সবুজ অবাক হয়ে শুনত। তখন সে কচি গাছের কচি পাতার মতো ভালো ছেলে ছিল। ছোটোবেলায় সবাই সবুজের মতো সবুজ থাকে। রবীন্দ্রনাথ বুড়োদের পছন্দ করতেন না; নজরুলও। অথচ দুজনই মরছেন জরাজীর্ণ বুড়ো হয়ে। মরার সময় কারো শরীরে বিশ কেজির বেশি মাংস ছিল না।
বালিকাবেলায় মা বঙ্কিমচন্দ্র পড়েছে। পড়েছে শরৎবাবুর বড়দিদি, পল্লীসমাজ, দেবদাস, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, পথের দাবী। রবীন্দ্রনাথও পড়েছে প্রচুর— গল্পগুচ্ছ বহুবার পড়েছে। চোখের বালি মায়ের খুব প্রিয়। সবুজ মনে করত চোখের বালি মানে স্যান্ড ইন আই। মা বলেছে, রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি আসলে বালি নয়। খালি খালি লোকে বালি বলে।
তাহলে কী? সবুজ জানতে চেয়েছিল।
একটি উপন্যাস।
ইস, কোথায় বালি আর কোথায় উপন্যাস। মানুষ কত্তো খারাপ।
সবুজের মা অনেক জানেন। মায়ের কথা ফেলতে নেই। পরীক্ষার হলে যাবার সময় মায়ের কথা না-রাখলে উত্তরপত্রে আন্ডা জোটে। তাই সুবজ মায়ের নির্দেশ পালন করছে। মনে মনে শব্দার্থ পড়ে পড়ে পথ চলছে—
জেন্ডার (gender) অর্থ লিঙ্গ, বডি (body) অর্থ শরীর,
পিক (peak) অর্থ শৃঙ্গ, ডিপ (deep) অর্থ গভীর।
টলেমি (Ptolemy)-তে পি, নাইফে (knife) লাগে কে।
হর্ন (horn) অর্থ পশুর শিং, কাদামাটি ক্লে (clay) ।
পরীক্ষার হলে যেতে যেতে পড়তে হবে কেন? সিরাজ চাচাকে জিজ্ঞাসা করেছিল সবুজ।
সিরাজ চাচা বলেছিলেন, বাঙালিরা কোনো বিষয় বেশিক্ষণ মনে রাখতে পারে না। এজন্য তোমার চেয়ারম্যান দাদা ভোটের এক দিন আগে ভোটারদের টাকা দেওয়ার জন্য বের হন। এর বেশি সময় আগে দিলে ভুলে যায়। বাঙালির স্মৃতি বাঙালির শরীরের চেয়েও ক্ষীণ। তুমি বাঙালি। তাই তুমি সবুজের স্মরণ শক্তিও বাঙালির মতো ক্ষীণ এবং ক্ষণস্থায়ী।
চাচার কথাটা বেশ মনে ধরেছে সবুজের। এ বিষয়ে সবুজের নিজেরও একটা ব্যাখ্যা আছে। তাও কম যৌক্তিক নয়। পথে যেতে যেতে পড়লে ভুলে যাবার আগে পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দেওয়া যায়। হজম হওয়ার আগে বমি আসার মতো। মুখস্থ করে উত্তরপত্রে উগড়ে দিতে পারলেই হলো। তাজা তাজা নম্বর। ফার্স্ট ডিভিশন পাশ।
এটাই বাঙালির পরীক্ষা।
পথের পড়ায় মায়ের দোয়া আছে। বাড়িতে পড়লে সবুজ ভুলে যায়। ওই পড়ায় থাকে বাবার শাসন। শাসন এক প্রকার অভিশাপ। অভিশাপের ছোবল সাপের চেয়েও বিষাক্ত। এজন্য বাবার বেতটা সাপের মতো চিকন আর কালো। শ এর স। তাই শাপ-এর পর সাপ।
সিরাজ চাচা বিদেশ যাওয়ার আগে সবুজের বাবাকে বলেছিলেন, দাদা, শিশুদের কখনো মারবেন না। বেত যেখানে সচকিত, আগ্রহ সেখানে শঙ্কিত। শাস্তি যেখানে উলঙ্গ, স্মরণশক্তি সেখানে কাতর বিহঙ্গ। বিদ্যায় যদি ভয় ঢুকে তাহলে লেখাপড়া আহত পাখির মতো মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। শিশুদের কখনো মারতে নেই।
বুঝেছি, বাবা বলেছিলেন।
সবুজকে মারবেন না তো?
সিরাজ চাচা বিদেশ যাওয়ার সময় বাবা কথা দিয়েছিলেন— মারবেন না, কিন্তু কথা রাখতে পারেননি। তিনি তাঁর চেয়ারম্যান বাবার মতো কথাখেকো চণ্ডাল। সবকথা খেয়ে ফেলে। চেয়ারম্যানের ছেলে হলে কি শপথ ভাঙতে হয়? রাজনীতি করলে কি সর্বক্ষণ মিথ্যা না বলে পারা যায় না?
সবুজ লেখাপড়ায় এখন তেমন ভালো না-হলেও একদম খারাপও না। রোল নম্বর মাঝামাঝি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খুব ভালো ছিল। ক্লাসে প্রথম হতো বরাবর। তখন মা পড়াতেন। মিডল স্কুলে আসার পর বিদ্যা কমতে শুরু করে। অবাক ব্যাপার হলো— বিদ্যা যত কমছে শয়তানি বুদ্ধি তত বাড়ছে।
সিরাজ চাচা একদিন বলেছিলেন, জ্ঞানহীন মাথায় শয়তান এসে ভর করে। এই যেমন আমার বাবা।
সবুজ বলেছিলেন, দাদু তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স।
মাস্টার্স পাশ জ্ঞানিক তকমা নয়। এটি সানদিক বিষয়। এটি মগজ নয়, কাগজ। সাড়ে তিন টাকা দিস্তা।
তাহলে জ্ঞান কী?
ভালোবাসার সর।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে আসার পর সবুজের লেখাপড়ায় অবনতির সূচনা। সপ্তম শ্রেণিতে আসার পর আরো ভোতা হয়ে যায় সবুজের ধারালো মাথা। তারপর দিনের পর দিন শুধু অবনতি ঘটেছে। একদম পড়তে ইচ্ছে করে না। সারাদিন খেলতে আর দুষ্টোমি করতে ইচ্ছে করে।
বাবা বলেন, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তোমার বই পড়ার আগ্রহ গোল্লায় গেছে।
আসলে কি বাবার মন্তব্য ঠিক?
ঠিক নয়।
বাবার পিটুনি খেতে খেতে সবুজের মাথার মগজের কিয়দংশ অবশ হয়ে গেছে। বাবা শুধু শাসন করেন। শুধু মারেন। শুধু বকেন। বাড়িতে এলে যখন তখন পড়ার টেবিলে নিয়ে যান। বন্ধুদের সামনে অপদস্থ করেন। মায়ের সামনে শাস্তি দেন। শাসনে শাসনে ক্লান্ত সবুজ সুযোগ পেলে দুষ্টোমি করে প্রফুল্ল হতে চায়।
এটা কী তার দোষ?
শিশু হলেও তারও তো মন আছে!
বাবার সঙ্গে সম্পর্ক যেমন হোক না, মায়ের সঙ্গে ভালো ভাব সবুজের। একদম বন্ধুর মতো। মনের সব কথা মাকে মনের মতো করে খুলে বলা যায়। বাবার সঙ্গে মোটেও জমে না তার। অবশ্য শিশুকালে বাবাই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। সবচেয়ে আপন এবং কাছের। বাবার সঙ্গেই ঘুমাত। মায়ের কাছে সহজে যেত না। তখন কত স্নেহশীল আর মমতাবান ছিলেন তার ক্ষমতাবান তার বাবা!
এখন বাবা একটা আজরাইল।
পড়াতে আসে বেত নিয়ে। হেডস্যারের মতো ভাব ধরে থাকেন সারাক্ষণ। সর্বদা মেজাজটা কেমন জানি বদ বদ করে রাখেন। আপনি করে বলতে হয়। এভাবেই শিখিয়েছেন। মাকে আপনি বলতে হয় না। তুমি সম্বোধন করে। আপনি করে বললে কেউ আপন হয় না।
আপন হতে হলে মনে মনে হতে হয়।
যার হাতে সাপের মতো বেত থাকে সে আপন হয় কীভাবে?
ক্রমশ
— — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — — —