লিলুয়া বাতাস বনাম লু হাওয়া; হ য ব র ল এবং প্রাইজ

লিলুয়া বাতাস বনাম লু হাওয়া; হ য ব র ল এবং প্রাইজ

ড. মোহাম্মদ আমীন

শুবাচির প্রশ্ন “লিলুয়া বাতাস— এখানে লিলুয়া আর লিলুয়া বাতাস অর্থ কী?” লিলুয়া হলো লীলা শব্দের শাব্দিক বংশধর। লীলা থেকে প্রথমে এসেছে লীলায়িত ও লীলায়িতা। অতঃপর এদের বংশ থেকে জন্ম নিয়েছে লিলুয়া । তৎসম লীলায়িত (√লীলায়্‌+ত) অর্থ— মনোহর ভঙ্গিযুক্ত। সুতরাং, লিলুয়া বাতাস মানে— লীলায়িত বাতাস; মনোরম হাওয়া; মুগ্ধকর বাতাস; নির্মল ও সুন্দর বাতাস; মধুর চঞ্চলতায় পূর্ণ বাতাস; আউলা বাতাস; যে বাতাসে বসন এলোমেলো হয়ে যায়; মৃদুমন্দ বাতাস- – – —G

লিলুয়া চৈত্র মাসের দুপুরে আকস্মিক আবেগে ঝিরঝির করে বয়ে যায়। যার নির্মল পরশ শরীরে প্রশান্তি এনে দেয়, রমণীর হালকা শাড়ির নরম আঁচল পলকে চঞ্চল হয়ে পড়ে নাড়ির টানের মতো অনুলোম মমতায়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান গ্রন্থে লিলুয়া শব্দটি পাওয়া যায় না। তবে তার স্ত্রীকে পাওয়া যায়। লিলুয়া শব্দের স্ত্রী লিলুয়ারী। বাঙ্গালা ভাষার অভিধান মতে, লিলুয়ারী হলো লিলুয়ার স্ত্রীবাচক পদ।
লীলা থেকে উদ্ভূত লিলুয়ারী অর্থ— (বিশেষণে) ক্রীড়াশীল, উচ্ছ্বাসময়, প্রাণচঞ্চল, আউলা, এলেমেলো, বিরামহীন প্রভৃতি। মৈমনসিং-গীতিকায় শব্দটির ব্যবহার আছে আউলা বা এলোমেলো অর্থে। সুতরাং, লিলুয়া বাতাস মানে আউলা বাতাস— যে বাতাসে পরিধেয় বসন এলোমেলো হয়ে যায়। যে বাতাসে রমণীর রমণীয় শরীর ঢেকে-রাখা হালকা শাড়ি পলকে পলকে বকের পালকের মতো নৃত্য করে; উড়ে যেতে চায় অঙ্গ ছেড়ে ওই সুদূরে; দূর বিধুরে মোহনীয় মমতায় তবু যেতে পারে না, আটকে থাকে।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, লু হিন্দি উৎসের শব্দ। অর্থ (বিশেষ্যে)— গ্রীষ্মকালে মরু অঞ্চলে প্রবাহিত তপ্ত বায়ু। অভিধানে লু-এর অর্থ যাই থাক, কবির মন আর কবিতায় লু হাওয়ার সঙ্গে লিলুয়ার গভীর সম্পর্ক দেখা যায়। নজরুলের গানে দেখুন লু হাওয়ার আনন্দ তাণ্ডব কেমন মনোহর—
“মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়
বিহ্বল চঞ্চল পায়
উড়িয়ে ওড়না লু হাওয়ায়
পরী নটিনী নেচে যায়।”
সূত্র: পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রম বিবর্তন, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
হ য ব র ল
এটি একটি বহুল প্রচলিত বাগ্‌ভঙ্গি যার আভিধানিক অর্থ: বিপর্যস্ত, বিশৃঙ্খলা, গোঁজামিল, অব্যবস্থা প্রভৃতি। বাংলায় স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ একটি নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে সুশৃঙ্খলভাবে সজ্জিত থাকে। যেমন: অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ; ক খ গ ঘ ঙ প্রভৃতি। শিশুদের যখন বর্ণপরিচয় শুরু হয়, তখন বর্ণগুলো শিশুরা শুধু মুখস্থ করেছে না কি চিনে চিনে ভালোভাবে রপ্ত করেছে তা পরীক্ষা করার জন্য বর্ণগুলো পর পর না-দেখিয়ে এলোমেলো ও বিশৃঙ্খলভাবে দেখানো হয়। এটাই ছিল বর্ণমালা পরিচয় পরীক্ষার রেওয়াজ। যেমন: ‘য র ল ব শ হ’ এ নির্ধারিত ক্রম ভেঙে হয়তো শিশুদের দেখানো হতে পরে: ‘হ য ব র ল’। বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষার জন্য বর্ণসমূহের ক্রমবিন্যাসের চ্যুতি, গোঁজামিল বা বিশৃঙ্খল বিন্যাস থেকে ‘হ য ব র ল’ কথাটির উদ্ভব।
প্রাইজ
‘প্রাইজ’ মানে দখলদার বা ডাকাত কর্তৃক ডাকাতির মাধ্যমে অর্জিত মালামাল। আর ‘প্রাইজ মানি’ হচ্ছে ওই মালামালের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত অর্থ। যতটুকু জানা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দ থেকে যুদ্ধে শত্রুর মালামাল অবরোধ করে নিজেদের অধিকার নিয়ে আসাকে বৈধ এবং অতি সম্মান/মর্যাদার মনে করা হতো। বিজয়ী পক্ষ পরাজিতের যেসব সম্পদ নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসত তাকে বলা হতো প্রাইজ। এর আকাশচুম্বী সম্মান ছিল।
.
যুদ্ধকালীন শত্রুপক্ষের কোনো জলযান ধৃত হলে জলযানের মালামাল বিজয়ীরা নিয়ে যেতে পারত। ওই মালামলাই হচ্ছে প্রাইজ। ‘প্রাইজ ল’ গ্রন্থে এভাবে লুণ্ঠনের মাধ্যমে পাওয়া প্রাইজ বন্টনের বিবরণ রয়েছে। লুটের মাধ্যমে উদ্ধার করা মালামাল অর্থমূল্যে রূপান্তরিত হলে তা ‘প্রাইজ মানি’। কোনো নিরপেক্ষ জাহাজ নিষিদ্ধ পণ্য নিয়ে শত্রুর এলাকার দিকে যেতে থাকলে তা যদি ধরা পড়ে সেই নিরপেক্ষ জাহাজের পণ্যও ‘প্রাইজ’। এ ছাড়াও জলদস্যুর জাহাজ, দাস প্রথা বিলোপের পরও কোনো স্লেভশিপ এবং নেভিগেশন অ্যাক্ট অমান্য করা জলযান ধরতে পারলেও প্রাইজ মানি প্রদান করা হতো। প্রাইজ মানি কত ধরা হবে তা নির্ভর করবে অবরুদ্ধ জাহাজের পাওয়া বন্দুক গোলাবারুদ ও অন্যান্য সামগ্রীর মূল্যমানের উপর। এই প্রাইজ থেকে নোবেল প্রাইজ-সহ বিশ্বের সকল প্রাইজ-এর উদ্ভব। প্রাইজ নিয়ে সেনেকার (Lucius Annaeus Seneca) বিখ্যাত উক্তি, ‘In war there is no prize for runner up’।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page