খেজুর, খেজুরে আলাপ; খেজুরের রস বনাম খেজুর গাছের রস

খেজুর, খেজুরে আলাপ; খেজুরের রস বনাম খেজুর গাছের রস

ড. মোহাম্মদ আমীন

খেজুর ও খেজুরে আলাপ

খেজুর থেকে খেজুরে। বাংলা খেজুরে শব্দের অর্থ— (বিশেষণে) খেজুরের রস থেকে তৈরি (খেজুরে গুড়); আলংকারিক অর্থ— বিরক্তিকর ও অবান্তর ।  খেজুর আলাপ অর্থ— (বিশেষ্যে) অবান্তর কথাবার্তা। যাও এখন খেজুরে আলাপ শোনার সময় নেই।  যে আলাপ বা কর্থাবার্তা প্রাসঙ্গিক নয়, অবান্তর ও বিরক্তিকর

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

হিসেবে শ্রোতৃবৃন্দের কাছে প্রতিভাত, শ্রোতৃবৃন্দ বক্তার কথামালা যে অবান্তর, মিথ্যা এবং হাস্যকর সেটি আগে থেকে জানে সাধারণত সেরূপ আলাপকে খেজুরে আলাপ বলা হয়।  কোনো আলাপকে খেজুরে আলাপ হতে হলে শুধু বিরক্তিকর হলে হবে না, অবান্তরও হতে হবে। প্রশ্ন হলো: অবান্তর বিরক্তিকর আলাপের সঙ্গে খেজুরে গুড়ের কী সম্পর্ক? আছে।

খেজুর গাছ থেকে কীভাবে খেজুরে গুড় উৎপাদিত হয় সে বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ এক ব্যক্তি খেজুরে গুড় তৈরির কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির কাছে গুড়  তৈরির বিষয়ে বর্ণিত অবান্তর ও বিরক্তিকর কাহিনি থেকে খেজুরে আলাপ কথাটির উদ্ভব। এবার কাহিনিটি পুরো শোনা যাক— খেজুর গাছ থেকে খেজুড়ে গুড়। এটি তৈরির প্রক্রিয়া যারা দেখেনি বা শুনেনি তাদের কাছে খেজুরে গুড় কীভাবে তৈরি হয় বা কীভাবে উৎপাদিত হয়—  তা জানতে পারার কথা নয়। কিন্তু অনেকে নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য না-জানা সত্ত্বেও বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ দাবি করে বানিয়ে বানিয়ে অনেক লম্বা কাহিনি জুড়ে দেয়। ওই বর্ণনার সময় যে, ওই বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকও থাকতে পারে সে বিষয়টি তাদের মনে  আসে না। খেজুরে গুড় তৈরি নিয়ে এরূপ অবান্তর ও বিরক্তিকর এক কাহিনি থেকে খেজুরে আলাপ কথাটির উদ্ভব।

এবার তাহলে কাহিনিটি পুরো শোনা যাক— অষ্টাদশ শতকের কথা। শ্রীবাস মাহাতো নামের এক লোক সস্ত্রীক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদাগরি জাহাজে চাকরি করতেন। তাদের ছেলের নাম অনিমেষ মণ্ডল। জাহাজে তার জন্ম। কৃষিকাজ  এবং গাছপালা সম্পর্কে কোনো ধারণা তঁঅর নেই। খেজুরের গাছ থেকে কীভাবে গুড় উৎপাদন করা হয় তাও জানেন না। তবে বিলাতি জাহাজে চাকুরি করেন বলে তার জ্ঞান ও মেজাজ সর্বদা বিলাতি কায়দা অনুসরণ করে। এক বনেদি কৃষক পরিবারের কন্যার সঙ্গে অনিমেষের  বিয়ে । বিয়ের কিছুদিন পরের কথা। অনিমেষ  শ্বশুর বাড়ির পথে। দেখলেন  এক লোক ঝুড়িতে করে কিছু নিয়ে বাজারে যাচ্ছেন।

মাথায় কী? অনিমেষ জানতে চাইলেন।

“খেজুরের গুড়”, বিক্রেতা বললেন, “খেয়ে দেখুন, ভারি মিষ্টি।”

ভালো লাগল খেয়ে। ভাবলেন— এমন সুস্বাদু জিনিস পেলে শ্বশুর বাড়ির সবাই খুশি হবে।   

কয়েক কেজি গুড় কিনে নিয়ে অনিমেষ বাবু বিক্রেতাকে বললেন, এগুলো কোথায় হয়?

গাছে। ওই যে গাছ দেখছেন— খেজুর গাছ;  ওখানে হয়।

কীভাবে হয়?

বিক্রেতার বাজারের সময় চলে যাচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে বললেন, আরে ভাই এই সাধারণ জিনিসটা জানেন না। বললাম-না, এগুলো খেজুর গাছ থেকে হয়। ওই যে খেজুর গাছ।

অনিমেষ বাবু লজ্জা পেয়ে গেলেন ভীষণ। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর কোনো প্রশ্ন করতে পারলেন। জানারও প্রয়োজন নেই। গাছে যেভাবে নানা ফল ধরে সেভাবে হয়। এত জানার কী! শ্বশুর বাড়ির চৌকাঠে পা দিতে শালাশালিরা এসে ঘিরে ধরে, কী এনেছেন দাদাভাই?

খেজুরে গুড়। অনেক মিষ্টি।  এগুলো কীভাবে হয় জানো?

বলল, জানি।

কচু জানো না। আমি বলি, শোনো।

খেজুরের রসে জ্বাল দিয়ে খেজুরে গুড়  তৈরিতে ব্যস্ত অনিমেষ বাবুর বড়ো শ্যালক বললেন, বলুন।

 ‘খেজুরে গুড়’ গাছে ধরে। প্রথমে খেজুর গাছে লাল লাল ফুল ফোটে। এয়া বড়ো।  ফুল থেকে হয় ফল। এককেটা ফল চালতার মতো। ওগুলো মাথায় পড়লে মাথা ফেটে চৌচির। আমি কতজনকে খেজুর পড়ে মরে যেতে দেখিছ। ওই ফল পাকলে বাসায় এনে খোসা ছড়িয়ে বের করা হয়  খেজুরে গুড়। ওগুলো জলে ভেজালে শক্ত হয়ে যায়। তারপর – – -।

থামুন দাদাভাই, আপনার ‘খেজুরে আলাপ’ শুনতে ভালো লাগছে না।  তার চেয়ে বরং জাহাজের গল্প করুন। আপনি তো আবার আদার ব্যাপারী।

খেজুরের রস নাকি খেজুর গাছের রস
“খেজুরের রস না কি খেজুর গাছের রস?“ প্রশ্নটির উত্তর জানার আগে ‘খেজুর’ কথার অর্থ কী জানা প্রয়োজন। অভিধানমতে, ‘খেজুর’ শব্দের অর্থ দুটি:
  • প্রধান অর্থ: খেজুর নামক ফলের গাছ এবং
  • দ্বিতীয় অর্থ: খেজুর নামক গাছ হতে প্রাপ্ত ফল।
অন্যদিকে, অভিধানমতে, খেজুররস বা খেজুরের রস কথা অর্থ হলো: শীতকালে খেজুর গাছের বাকল কেটে যে রস সংগ্রহ করা হয়। সুতরাং, কথাটি হলো খেজুররস বা খেজুরের রস। যেহেতু, খেজুর নামক ফল ও খেজুর নামক ফল জন্মদানকারী গাছ পরস্পর সমার্থক। তাই ‘খেজুর গাছের রস’ বললে বাহুল্য হয়ে যায়। কথাটি হবে ‘খেজুররস বা খেজুরের রস’।

Leave a Comment

You cannot copy content of this page